Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১৭:৩৫, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

সাংবাদিক কর্মশালায় বক্তারা

নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা অপসারণ জরুরি

নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা অপসারণ জরুরি
ছবি: সবার দেশ

রাজধানীর বিআইপি কনফারেন্স রুমে ২৯ এপ্রিল, ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত ‘সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল: অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়’ শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন, দেশে রোগমুক্ত সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেলের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ড্রামে খোলা তেল বাজারজাতকরণ, অপর্যাপ্ত ভিটামিন সমৃদ্ধকরণ, নিম্নমানের প্যাকেজিং এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগ এ লক্ষ্যে প্রধান বাধা। 

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এ কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ার ২৬ জন সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

ভিটামিন ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি

কর্মশালায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ প্রকাশ করে, প্রাক্‌-বিদ্যালয়গামী প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দুজন ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতিতে ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি রাতকানা রোগ, অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যু এবং শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের কারণ হয়। অন্যদিকে, ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব শিশুদের রিকেটস, প্রাপ্তবয়স্কদের হাড় ক্ষয়, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। 

বিশেষজ্ঞরা জানান, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার ভোজ্যতেল ব্যবহার করে, তাই এটি ভিটামিন সরবরাহের আদর্শ মাধ্যম হতে পারে। তবে, বর্তমানে বাজারে প্রাপ্ত তেলের গুণগত মান এবং ভিটামিন সমৃদ্ধকরণের অভাব এ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

খোলা তেল বাজারজাতকরণ: একটি বড় বাধা

আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে বিক্রিত ভোজ্যতেলের ৬৫% ড্রামে খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫৯% তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি, ৩৪%-এ প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে এবং মাত্র ৭% তেলে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেছে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, ভিটামিন ‘এ’ ছাড়া ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে ভোক্তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কর্মশালায় জানানো হয়, খোলা তেল সাধারণত নন-ফুড গ্রেড ড্রামে পরিবহন করা হয়, যেগুলো পূর্বে কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট, মবিল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এসব ড্রামে সংরক্ষিত তেল জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভেজাল মেশানোর সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া, এসব ড্রামে কোনো লেবেল বা উৎস-সংক্রান্ত তথ্য না থাকায় তেলের উৎপত্তি বা সরবরাহকারী শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে ভোক্তারা নিরাপদ তেল থেকে বঞ্চিত হন।

আইন ও নির্দেশনার বাস্তবায়নে ব্যর্থতা

শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ থেকে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বর ২০২২ থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধ করার কথা ছিলো। কিন্তু বাস্তবে এ নির্দেশনার প্রয়োগ দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ ভোজ্যতেল ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। 

গুণগত প্যাকেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা

কর্মশালায় ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ের মান নিয়েও আলোচনা হয়। সূর্যরশ্মি বা অন্যান্য আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন ‘এ’ নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে বাজারে ব্যবহৃত বেশিরভাগ তেলের বোতল আলো-প্রতিরোধী নয়, ফলে তেলের পুষ্টিগুণ ও ভিটামিনের মাত্রা হ্রাস পায়। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ে আলো-প্রতিরোধী অস্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া, প্যাকেজিংয়ে তেলের উৎপত্তি, ভিটামিনের মাত্রা এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।

কর্মশালার আলোচক ও উপস্থাপনা

কর্মশালায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন:

  • এস এম আবু সাঈদ, উপপরিচালক (সিএম), বিএসটিআই
  • অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, প্রধান, ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন
  • মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার, কনসালটেন্ট ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব
  • আবু আহমেদ শামীম, অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ
  • মোর্শেদ নোমান, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলাদেশ ফার্স্ট
  • এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা

বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন:

  • ডা. রীনা রাণী পাল, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি এডভোকেসি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন
  • হাসান শাহরিয়ার, কর্মসূচি প্রধান, প্রজ্ঞা

কর্মশালার তাৎপর্য

কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকরা জানান, ভোজ্যতেলের নিরাপত্তা এবং ভিটামিন সমৃদ্ধকরণের গুরুত্ব নিয়ে এ আলোচনা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তারা বলেন, গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর আইন প্রয়োগে চাপ সৃষ্টি হবে এবং ভোক্তারা নিরাপদ তেল প্রাপ্তিতে উপকৃত হবেন।

করণীয়

বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত বিষয়ে জোর দিয়েছেন:

  • খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
  • ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ আইনের কঠোর প্রয়োগ।
  • আলো-প্রতিরোধী এবং তথ্যসমৃদ্ধ প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা।
  • নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং অভিযান পরিচালনা।
  • সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি।

এ কর্মশালা ভোজ্যতেলের নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন অংশগ্রহণকারীরা।

সবার দেশ/কেএম