ভারতের সঙ্গে সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু
৫৮ দিন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ
ভারতের সঙ্গে সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আমাদের সাগরের মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আগে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশে আমাদের জেলেরা নির্যাতনের শিকার হতো, মাছ লুট হতো। এখন এ সমস্যা অনেকাংশে কমবে।

বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পরিবর্তন করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এ বছর প্রথমবারের মতো ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের জন্য সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এ সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের জলসীমায় একযোগে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে, তবে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের তুলনায় দুদিন বেশি চলবে। জেলেদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন হিসেবে এ সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক হিসেবে দেখছেন উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিক মৎস্য-২ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে এ প্রজ্ঞাপন জারি করেন। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) থেকে বঙ্গোপসাগরে যান্ত্রিক ফিশিং ট্রলার, ইঞ্জিনচালিত কাঠের ট্রলার থেকে শুরু করে ছোট ডিঙ্গি নৌকা পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩-এর আওতায় কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিষেধাজ্ঞার পটভূমি ও তাৎপর্য
মৎস্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ২০১৫ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার
উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারের জন্য প্রযোজ্য ছিলো। তবে ২০১৯ সাল থেকে সব ধরনের নৌযান—যান্ত্রিক হোক বা দাঁড়বাহী—এর আওতায় আনা হয়। পূর্বে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিলো, যা জেলেদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিলো। এ সময়ে উপকূলীয় জেলেরা দুর্বিসহ জীবনযাপনের মুখোমুখি হতেন।
বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামের জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাসের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা নৌ অবরোধ, মানববন্ধন ও বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জেলেদের অভিযোগ ছিলো, বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ভারতীয় জেলেরা তাদের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যেতো, যা দেশীয় মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর ছিলো। নতুন সময়সীমায় ভারতের সঙ্গে সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা এ সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জেলেদের জীবিকায় প্রভাব
৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ জেলে অস্থায়ীভাবে বেকার হয়ে পড়বেন। বরগুনা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার, যার মধ্যে পাথরঘাটায় রয়েছে ১৬,৮১১ জন। এছাড়া কয়েক হাজার অনিবন্ধিত জেলেও উপকূলীয় এলাকায় রয়েছেন। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ফিশিং ভেসেল এবং উপকূলীয় ইলিশ শিকারী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ায় জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা বিকল্প উপায়ের উপর নির্ভর করবে।
জেলেদের জীবনযাত্রা আরও জটিল করে তুলেছে অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ ধরায় ২২ দিন, জাটকা ধরায় ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস, এবং মার্চ-এপ্রিলে অভয়ারণ্যে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে পূর্বে জেলেদের বছরে ১৪৭ দিন কাজ বন্ধ রাখতে হতো। নতুন সময়সীমায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা ৬৫ দিন থেকে কমে ৫৮ দিনে নির্ধারিত হওয়ায় জেলেরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।
জেলেদের প্রতিক্রিয়া
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। পূর্বের সময়সীমায় আমাদের জলসীমায় ভারতীয় জেলেরা প্রায় ৩৯ দিন মাছ ধরে নিয়ে যেত, যা আমাদের মৎস্য সম্পদ ও ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর ছিলো। সম্প্রতি মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বিষয়টি বোঝাতে পেরেছি। ভারতের সঙ্গে সমন্বিত নিষেধাজ্ঞার এ সিদ্ধান্তে আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা আমাদের সাগরের মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আগে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশে আমাদের জেলেরা নির্যাতনের শিকার হতো, মাছ লুট হতো। এখন এ সমস্যা অনেকাংশে কমবে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মাসুম জানান, ইতিমধ্যে জেলেরা সাগর থেকে ফিরতে শুরু করেছে। আমরা নিষেধাজ্ঞা সফল করতে সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবো। এটি আমাদের জীবিকার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
সরকারি নজরদারি ও সহায়তা
নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান খান বলেন, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পাথরঘাটা স্টেশনকে বিষখালী নদীতে এবং নৌ পুলিশ ফাঁড়ি চরদুয়ানীকে বলেশ্বর নদীর মোহনায় চেকপোস্ট স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটি নিশ্চিত করবে যে কোনো নৌযান মাছ ধরতে সমুদ্রে যেতে পারবে না।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সফিউল আলম জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবারগুলোর জন্য সরকার বিশেষ সহায়তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ভিজিএফ কার্ডের আওতায় জেলে পরিবারগুলো রেশনিং সুবিধা পাবে। এছাড়া বিকল্প জীবিকার জন্য বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হবে, যাতে জেলেরা মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
নতুন সময়সীমায় নিষেধাজ্ঞা কমে ৫৮ দিনে নির্ধারিত হওয়ায় জেলেদের অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ সময়ে জেলে পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা নির্বাহে সরকারি সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলে নেতারা মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা মৎস্য সম্পদের টেকসই বৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। বরগুনার জেলে নেতা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা সাগরের মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময়ে এসেছে। আমরা আশা করি, এটি আমাদের জীবিকার জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে।
১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা বঙ্গোপসাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভারতের সঙ্গে সমন্বিত এ উদ্যোগ জলসীমার মৎস্য সম্পদ রক্ষায় আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি নজির স্থাপন করেছে। সরকারি সহায়তা ও জেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞা সফল হলে বাংলাদেশের মৎস্য খাত আরও সমৃদ্ধ হবে। তবে নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা নিশ্চিত করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।
সবার দেশ/এমকেজে