Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ০০:৩৭, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ০০:৩৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

আদর্শিক পিতা-পোষ্য সন্তান, দায় পারস্পরিক

আদর্শিক পিতা-পোষ্য সন্তান, দায় পারস্পরিক
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতির আদর্শিক পিতৃত্ব, রাজনৈতিক সংগঠনের দায়বদ্ধতা এবং ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধের প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার বেশ কয়েক বছর আগের বক্তব্য- ‘আমি ছাত্রলীগের দায় নেবো না’ এবং গত সপ্তাহে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বক্তব্য ‘আমরা ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকার দায় নেবো না’- এ বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। 

একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান নেতা সাধারণত সে সংগঠনের আদর্শিক পিতা হিসেবে বিবেচিত হন। একটি সংগঠনের নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে, যখন সংগঠনের কিছু অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে বা অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন নেতৃত্ব সে দায় নেবে কি না- এটি একটি বিতর্কিত বিষয়।

উদাহরণস্বরূপ, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়েছে, যার মধ্যে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, ধর্ষণের সেঞ্চুরি, এমনকি সহিংসতাও রয়েছে। শেখ হাসিনা যখন বলেন, তিনি ছাত্রলীগের দায় নেবেন না, তখন এটি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে, যার মাধ্যমে তিনি সংগঠনের নেতিবাচক দিক থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চান।

অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন ধরে একাত্তরের ভূমিকার দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। তাদের যুক্তি, বর্তমান প্রজন্ম সে সময়ের ঘটনার জন্য দায়ী নয়। যে ছাত্রশিবিরের জন্ম ১৯৭৬ এ, তারা কেনো ৭১ এর দায় নেবে ইত্যাদি। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠে—যদি আদর্শগত উত্তরাধিকার স্বীকার করা হয়, তবে ইতিহাসের দায় কেন স্বীকার করা হবে না?

আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর সংগঠনটি ধীরে ধীরে ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন হয়ে ওঠে।

শেখ হাসিনার বক্তব্য- ‘আমি ছাত্রলীগের দায় নেবো না’-  এ সংগঠনের অনিয়ম ও অপরাধের দায় এড়ানোর একটি অপচেষ্টা। যদিও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অধীনস্থ একটি সংগঠন। আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা বরেছিলেন, বিরোধী দলকে রাজপথে মোকবেলা করতে আমাদের ছাতলেীগই যথেষ্ট। তারপরও শেখ হাসিনা চাইছেন না যে এর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক কৌশলে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, তবে এটি বাস্তবিক ও নৈতিকতা বিবর্জিত।

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, ধর্ষণের সেঞ্চুরি এবং সহিংসতায় অভিযুক্ত সংগঠনটির অনিয়ম যদি এত প্রকট হয়, তাহলে নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা কি থাকা উচিত নয়? শেখ হাসিনার বক্তব্য কিছুটা রাজনৈতিক কৌশল হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এটি তাদের দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো এবং নেতৃত্বের কেউ কেউ রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়েছিলো। একাত্তরের গণহত্যার দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অনেকে বিতর্কিত বিচারের সম্মুখীন হন এবং ফাঁসির দণ্ড পান। কিন্তু জামায়াতের বর্তমান প্রজন্মের নেতারা বলে থাকেন যে, তারা ৭১-এর দায় নেবেন না। ইসলামী ছাত্রশিবিরও একই সুরে কথা বলে থাকে।

যদি কোনো সংগঠন তার আদর্শিক শেকড় ও উত্তরাধিকার স্বীকার করে, তবে তার ইতিহাসের দায়ও স্বীকার করা উচিত। কিন্তু জামায়াত একদিকে ইসলামের নামে রাজনীতি চালিয়ে যেতে চায়, অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ভূমিকার দায় এড়াতে চায়। এটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ছাড়া কিছু নয়।

জামায়াত ও ছাত্রশিবির  প্রজন্মগত বিভাজন, আইনি ও রাজনৈতিক বিতর্ক, মতাদর্শগত দ্বৈততা ইত্যাদি কৌশলে ৭১-এর দায় এড়াতে চায়। কিন্তু চাইলেই ইতিহাস থেকে তো আর পালানো যায় না। জামায়াত ইসলামী যদি মতাদর্শগত দ্বৈততায় রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে চায়, তাহলে তাদের ৭১-এর ভূমিকা স্বীকার করা উচিত।

যে কোনোও সংগঠনের জন্য কৃতকর্মের দায় স্বীকার করা এবং ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে, আওয়ামী লীগ যদি ছাত্রলীগের অনিয়মের দায় স্বীকার করে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে, তবে সংগঠনটির প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে। অন্যদিকে, জামায়াত যদি ৭১-এর ভূমিকার দায় স্বীকার করে এবং ক্ষমা চায়, তবে তাদের রাজনৈতিক পথচলা অরও সুগম হতে পারে।

রাজনৈতিক ভুলের দায় স্বীকারের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত ইতিহাসেই অনেক আছে। জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি আমলের দায় স্বীকার করে এবং পরে দলটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পর ট্রুথ কমিশন গঠন করা হয়েছিলো, যেখানে অপরাধ স্বীকার করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের বেশ কিছুদিন পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচার বাশার আল আসাদকেও হাসনিার মতো দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়। ইতোমধ্যে দেশটির ডি ফ্যাক্টো সরকার সিরিয়ায় আসাদের দল বাথ পার্টি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দায় স্বীকার ও পরিত্যাগের এ প্রবণতা আদর্শিক দ্বৈততা তৈরি করেছে। শেখ হাসিনা যখন ছাত্রলীগের দায় নেন না, তখন এটি ক্ষমতা ও ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বাস্তবতা প্রকাশ করে। অন্যদিকে, জামায়াত ও ছাত্রশিবির যখন ৭১-এর দায় এড়িয়ে যেতে চায়, তখন এটি ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের সংগঠনের দায় স্বীকার করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দায় এড়ানো নয়, বরং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে।

সম্পাদক
৩১ জানুয়ারি ২০২৫