ফ্যাসিজমের কেবলা গুড়িয়ে জাতির পাপমোচন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি। এটি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন হিসেবে পরিচিত। এ বাড়ি ছিলো একটি ঐতিহাসিক প্রতীক। এটি শুধু প্রয়াত শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত বাসভবন নয়, বরং বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলো, যা কারও কাছে গণতন্ত্রের প্রতীক। আবার কারও কাছে অহংকার ও ক্ষমতাচর্চার চরম প্রকাশ ফ্যাসিবাদী শাসনের কেবলা মনে হয়েছে।
বিগত প্রায় দেড় দশকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক শেখ হাসিনা ক্ষমতার যে রূপ দেখিয়েছেন, তা হিটলারের ফ্যাসিবাদকে হার মানিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ, আদালতকে প্রভাবিত করা, ভোটের নামে রাতের ভোটের প্রহসন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রবণতা এসব সমালোচনার কারণ। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ক্ষমতায় থেকে তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রতি তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি ভেঙে ফেলা আসলে তার এ দাম্ভিকতারই প্রতিফলন।
হাসিনার ক্ষমতার দাম্ভিকতা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি তাকে এক কর্তৃত্ববাদী গণবিচ্ছিন্ন শাসকে পরিণত করেছে। এ সময়ে তার ভাষণ দেবার সিদ্ধান্তই ছিলো উস্কানিমূলক। হাসিনা এবং তাদের দলের কারও মধ্যেই এখন পর্যন্ত তাদের অতীত খুন-গুম-লুটপাট-বিচারহীনতা নিয়া কোন সরি ফিলিং মানুষ দেখছে না। ফলে মানুষের মনে তাদের বিষয়ে ক্ষোভ কমে নাই। এরই মধ্যে তারা ফিরে আসার নানান হুমকি দিচ্ছে। দোষ অস্বীকার করছে। এটাও জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে পলাতক হাসিনার বক্তব্য ঘিরে দুটো অংশ আছে- একটা অংশ হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন শেখ হাসিনা তাদেরকে অপমান করেছেন। শহিদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা করেছেন ও অশ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি প্রতিটি শব্দচয়নে অবলীলায় মিথ্য বলেছেন। এগুলো কেউ পছন্দ করেননি। অনেকে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। যারা ভাষনের আগে বাড়ি ভাঙ্গার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন, ভাষনের পর তারাও বাড়ি ভাঙ্গার যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন যে সুরে কথা বলতেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও তিনি একই সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও এতে অংশ নেয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। এতে ছাত্রজনতা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙ্গার উস্কানি হাসিনা স্বয়ং দিয়েছেন। আর ছাত্রজনতার ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের পরিণতি হচ্ছে ৩২ নম্বর ধুলায় মিশিয়ে দেয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট, ২০২৪ এর ৫ আগষ্ট এটাকে অক্ষত রেখে দেয়া জাতির যে দায় ছিলো, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এ সে দায় ছাত্রজনতা পরিশোধ করেছেন। এখানে সরকার সেনাবাহিনীকে জনগণের বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে সঠিক কাজটিই করেছেন।
এটা শুরু হলো মাত্র, শেষ নয়। শেখ পরিবারের এ ফ্যাসিস্ট আইকন ভাঙ্গার বুলডোজার চলছে দেশজুড়ে। এ ধারাবাহিকতা বৃহস্পতিবারও চলমান ছিলো। যদিও সাদাকালো দৃষ্টিতে এটা কাম্য নয়।
এখানে আরও একটি বিষয়, ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার পুরো শাসন আমলে তার প্রয়াত পিতাকে সামনে রেখে তাকে দেবতা বানিয়ে তার সমস্ত অপকর্ম করে গেছে। ফলে স্বাধীন বাংলাদশ পূর্ব শেখ মুজিব আর হাসিনার বানানো ফ্যাসিস্ট আইকন শেখ মুজিবের পার্থক্য জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। ফলে ৩২ নাম্বারকে জনগণ ফ্যাসিবাদের কেবলা হিসেবেই দেখেছে। এ কেবলা সামনে রেখেই অভিনেত্রী শাওনদের মতো ফ্যাসিজমের দোসররা জুলাই আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে কটাক্ষ করে। আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আবারও ফ্যাসিজম কায়েমের চেষ্টা করে। যদিও গতকাল সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসাবাদে জন্য ডিবি তাকে আটক করে। পাশাপাশি এ কেবলাকে কেন্দ্র করে এ চরম ক্ষেভের সময়ে এক হৃদয়হীনা নারী জুলাইয়ে আহত তার সন্তানদের সামনেই ৩২ নাম্বারে এসেছিলো ‘জয় বাংলা’র পূজো দিতে। তাই এটা ভাঙ্গা অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো।
কিন্তু অন্যদিকে বর্তমান সরকার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখার শপথ করে আমরা আদতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রেখেছি। ফ্যাসিস্টের কেবলা বাড়ি ভেঙ্গে মাফিয়া হাসিনার বানানো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা প্রতারণারই নামান্তর
সম্পাদক
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫