আওয়ামী লীগের উৎখাত এতো নির্মম হয় কেনো?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এখানে ক্ষমতার উত্থান-পতন প্রায়শই সহিংস ও রক্তাক্ত পথে ঘটে থাকে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের শক্তি ও জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, শুধুমাত্র দলীয় আনুগত্য বা প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। জনগণের সম্মতি ছাড়া কোনো সরকারই চিরস্থায়ী হতে পারেনি।
১৫ আগস্ট, ৫ আগস্ট, ৫ ফেব্রুয়ারি— বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নির্দেশ করে, যা আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এসব ঘটনা কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্মম বাস্তবতাকেও তুলে ধরে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া প্রশ্নবিদ্ধ একটি দল। ২০০৮ সালের পর থেকে একটানা রাষ্ট্রক্ষমতায় জোরদখল করে রেখেছিলো দলটি। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো- প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, এবং গোয়েন্দা সংস্থা পর্যন্ত তাদের নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় ক্যাডারদের জঙ্গি বাহিনীরূপে গড়ে তুলেছিলো।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়- যখন একটি সরকার প্রশাসনিক শক্তি, দলীয় কর্মী এবং ভোটারদের নিয়ন্ত্রণে রাখে, তখনও তাদের উৎখাত এতো নির্মমভাবে হয় কেনো? এর উত্তর খুঁজতে হলে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায়, কোনো সরকারই জনসমর্থন হারিয়ে গেলে প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অথচ, সেসময় তিনি প্রায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীসহ গোটা প্রশাসন তার সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তবুও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে জমে থাকা অসন্তোষ একদিন প্রবল বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার পতন ডেকে আনে।
একইভাবে, ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক শক্তির সমর্থন পেয়েও টিকতে পারেনি। জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়নি। কোন নেতা-কর্মীও পালিয়ে যায়নি। কারাগারে থেকে নির্বাচন করেও এরশাদ ৫টি আসনে জয়লাভ করেছিলেন।
২০০৬-০৭ সালে বিএনপি সরকারের সময়ও একই ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলেও দলটির বিরুদ্ধে যখন জনগণের অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়, তখন সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন আসে। তৎকালীন মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার অনেক চাপ তৈরি করেও বিএনপি নেত্রীকে দেশ ত্যাগ করাতে পারেনি। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র নেতা যিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একাধিক আসনে নির্বাচন করে কোনও আসনে হারেননি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় কর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কোন কোন সরকার টিকে থাকতে পারে না, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ভোটারদের ভূমিকা। আমাদের ভোটারদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করলে আর রক্ষে নেই। না খেয়ে থাকলেও তারা কথা না বলে থাকতে পারে না। যদিও এখানে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়, দিনের ভোট রাতে করা হয়, আমি-ডামি-মামী নির্বাচন হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদকে ভোটগ্রহণ ছাড়াই প্রতিনিধি ঘোষণা করা হয়, তবুও জনমতের প্রকৃত অবস্থা কখনোই চেপে রাখা সম্ভব নয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের জনগন অংশগ্রহণ- করেনি। মাত্র ৫ শতাংশ ভোট কাস্ট করেও পেশীশক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করেছিলো।
কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন যেখানে রাতেই ভোট সম্পন্ন হয়েছিলো বলে প্রমানিত, সেখানে জনগণের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ জমতে থাকে। এর প্রতিফলন ২০২৪ সালে দেখা যায়, যখন ব্যাপক দমন-পীড়নের পরও জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখনই কোনো সরকার ব্যাপক গণঅসন্তোষের মুখোমুখি হয়, তখন নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা প্রশাসনের ওপর শতভাগ ভরসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জনগণেরই অংশ। তাদের মধ্যেও বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব ছিলো। সেনাবাহিনীর নিপীড়িত একটি অংশ এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়, অন্য অংশ নিষ্ক্রিয় থাকে। তারাও মুজিবের পতন চেয়েছে। জনগন সায় দিয়েছে।
১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের সময়ও দেখা যায়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী চূড়ান্ত সময়ে তার প্রতি আনুগত্য দেখাতে ব্যর্থ হয়।
২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটেও কিছুটা একই বিষয় লক্ষ করা যায়। দীর্ঘদিনের শাসনকাল এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও যখন জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা বা নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় ভূমিকা রাখে।
অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি দল, যার সংগঠন শক্তিশালী, কেন তারা নিজেদের পতন রোধ করতে পারে না? এর কারণ হলো—
১. জনবিচ্ছিন্নতা- দীর্ঘ শাসনকালে সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করেন, তারা বাস্তব তথ্য জানানোর পরিবর্তে দলীয় উচ্চপর্যায়ের নেতাদের আশ্বস্ত করতে থাকেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে নেতৃত্ব বাস্তব চিত্র বুঝতে ব্যর্থ হয়।
২. রাষ্ট্রযন্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহার- যখন সরকার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও একপর্যায়ে বুঝতে পারেন যে, পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
৩. সাংগঠনিক দুর্বলতা- একটি দল যখন দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকে, তখন কর্মীদের মধ্যে সুবিধাবাদী মনোভাব বাড়তে থাকে। ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন, এবং দলে প্রকৃত কর্মীদের সংখ্যা কমে যায়। ফলে সংকটের সময় সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. আন্তর্জাতিক প্রভাব- বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক চাপও একটি বড় ভূমিকা রাখে। যখন কোনো সরকার আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা হারায়, তখন দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের ওপরও এর প্রভাব পড়ে।
ইতিহাস সাক্ষী, কোনো সরকারই চিরস্থায়ী নয়। দলীয় কর্মী, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, যদি জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে সরকার টিকে থাকতে পারে না। সেটা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও ঘটেছে, কিন্তু কেউ জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য মাত্রতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেনি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুন, গুম, ধর্ষণ করেনি, অপরাধীদের পুরস্কৃত করেনি। ব্যংকসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান অবাধ লুটপাট করেনি। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আয়নাঘর তৈরি করেনি। সুশাসন দিতে না পারলেও তারা জনগনের সঙ্গে তামাশা করেনি। জনগনের অনভিূতি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনি। সে সবের সবগুলোই আওয়ামীলীগ করেছে।
১৫ আগস্ট, ৫ আগষ্ট, ৫ ফেব্রুয়ারি- আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতিতে ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। একটি দল বা সরকার যদি জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকে, তাহলে ইতিহাস নির্মমভাবে তার জবাব দিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম শিক্ষা হলো- শক্তি দিয়ে নয়, বরং জনগণের আস্থাই দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার আসল চাবিকাঠি। উল্লেখ্য, শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে তার প্রার্থীকে ভোটে জেতানোর জন্য ব্যলটবাক্স দাউদকান্দি থেকে ঢাকা এনেছিলেন নির্বাচনে জালিয়াতি করার জন্য। তারপর তো সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলো। কথা বলার অধিকার কেঁড়ে নিয়েছিলো সংবাদপত্র বন্ধ করে। আর তার কন্যা শেখ হাসিনা তো রাতেই ভোট করে ফেললেন। জনগণ মাইন্ড করেছে এতে। তাই জনগন এদর ক্ষমতাচ্যুতই শুধু করেনি, উৎখাত করেছে।
আওয়ামী ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ আর ২০২৪ এর নির্বাচন, ২০০৮ এবং ২০১৮ থেকে তুলনামূলক ভালো বলা যেতে পারে। কেননা, জনগণ প্রতারণার চেয়ে ডাকাতিটা মেনে নিতে পারে। ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে দেশের জনগনের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
সম্পাদক
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫