Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ১৬:১৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভাষণ, সময়ের ম্যাগনাকার্টা

খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভাষণ, সময়ের ম্যাগনাকার্টা
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যিনি কয়েক যুগ ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছেন। দীর্ঘ ৭ বছর পর দলের বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তার সাম্প্রতিক ভাষণে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘সময়ের ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। 

বেগম জিয়ার এ ভাষণে তাৎপর্যপূর্ণ দুটি বক্তব্য উঠে এসেছে। প্রথমত, দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো এবং দ্বিতীয়ত, সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থের একটি গভীর প্রতিফলন। বেগম জিয়ার ভাষণের এ দিকগুলো শুধুমাত্র বিএনপি নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সকল রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের মানুষের জন্যও শিক্ষণীয় হতে পারে।

খালেদা জিয়া তার ভাষণে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, এমন কোন কাজ করবেন না যাতে আপনাদের এতোদিনকার সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও শ্রম বিফলে যায়। আমাদের সবসময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সে উক্তি মনে রাখা দরকার— ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। এ বক্তব্য মূলত রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়া মূলত নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেনো কোনও ব্যক্তিস্বার্থ বা হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দলের বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষতি না করেন। রাজনৈতিক দলে মাঝে মাঝে স্বার্থান্বেষী বা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী প্রবেশ করতে পারে, যারা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এ ধরনের মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদে দলের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই, তার নির্দেশনা ছিলো দলের সংহতি রক্ষা করা এবং পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখা।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উক্তি— ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’— একটি আদর্শিক বার্তা বহন করে। এটি শুধু বিএনপির জন্য নয়, বরং যে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দলে ব্যক্তির ইগো বা স্বার্থের চেয়ে দলকে প্রাধান্য দিতে হয় এবং দলের চেয়েও বড় বিষয় হলো দেশের স্বার্থ। রাজনীতি যদি কেবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের জন্য কল্যাণকর হয় না।

বিএনপি একটি দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছে। এর নেতাকর্মীরা আন্দোলন-সংগ্রাম, কারাবরণ ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। খালেদা জিয়া তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সে আত্মত্যাগ যেনো বিফলে না যায়। একক ভুল সিদ্ধান্ত বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যদি সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সে আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে।

খালেদা জিয়ার ভাষণের দ্বিতীয় অংশ ছিলো— বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের প্রতি স্নেহভাবাপন্ন, যারা আজ এক ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, তরুণদের ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। 

বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা রাজনৈতিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। খালেদা জিয়া তরুণদের এ পরিবর্তনকামী মানসিকতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাদের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। তরুনদের স্বীকৃতি দিয়ে তিনি মূলত তার মনোভাব বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেও পৌঁছে দিয়েছেন।

বেগম জিয়া তার ভাষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়েছেন। 'ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন' বলতে তিনি এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশের কথা বোঝাতে চেয়েছেন, যেখানে জনগণের মতামত, ভোটের অধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, কারণ বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে।

রাজনীতিতে প্রায়ই দলীয় সংকীর্ণতা ও বিভাজন সৃষ্টি হয়, যা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেছেন, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বুঝিয়েছেন, শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থে রাজনীতি করলে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় এবং বিরোধীদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতে চায় না। খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য সে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার বার্তা দেয়।

খালেদা জিয়ার ভাষণের বিষয়বস্তু শুধু বিএনপির জন্য নয়, বরং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষনের অন্তর্নিহিত বার্তা হলো—

১. দলের ভেতরের বিশৃঙ্খলা এড়ানো: রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি দলকে দুর্বল করে। বিশেষ করে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া তার দলের কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের ভুলের কারণে যেন দল আরও দুর্বল না হয়।

২. নেতৃত্বের দূরদর্শিতা: তার ভাষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে অনুধাবন করেন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। বিএনপির বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে তিনি যে এখনও স্পষ্ট ধারণা রাখেন, তার ভাষণ তারই প্রমাণ।

৩. জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা: রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা বিভক্তির চেয়ে দেশের সার্বিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। তার বক্তব্যে এ বার্তাটি পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। অর্থাৎ, জাতীয় রাজনীতিতে যদি দলীয় সংকীর্ণতা কমে এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার ঘটে, তবে সেটি শুধু বিএনপি নয়, পুরো দেশ ও জাতির জন্যই মঙ্গলজনক হবে।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি যে কোনও জাতীয় সংকট শুরুর আগেই সেটা অনুধাবন করতে পারেন এবং মুখফুটে খুবই সাবলীল ভাষায় সেটা সবার সামনে তুলেও ধরতে পারেন। অসুস্থ অশীতিপর খালেদা জিয়া এখনও তার দলের বহু এক্টিভ নেতাকর্মীর চেয়েও বর্তমান সময়কে যে ভালো রিড করতে পারেন, তার কথাগুলো হলো তার বাস্তব প্রমাণ। একজন খালেদা জিয়া যে কতোটা ভিশনারী এবং আনকম্প্রোমাইজিং ক্যারেক্টারের মানুষ তার প্রমাণ তিনি এখনও রেখেই যাচ্ছেন।

খালেদা জিয়াকে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছে বিগত ১৭ বছর। অথচ তার দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি নির্মোহ ভালোবাসা তাকে আরও জনসম্পৃক্ত করেছে। বরং তার দলের মধ্যে যারা ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে সমঝোতা করে উন্মুক্ত  জীবনযাপন করেছেন, তাদের অনেকেই এখন জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। 

২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকান্ডের পর তার বক্তব্য শুনেছে বিশ্ব। সরকারকে ওই সংকট উত্তরণে তার সহযোগিতা করার মানসিকতাও দেখেছে বিশ্ব, যদিও ফ্যাসিস্ট দখলদার সরকার সঙ্গত কারণেই সেটা গ্রহণ করেনি। আজ উন্মুক্ত পরিবেশে বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারে ওঠে হুআসা তথ্য বেগম জিয়ার তখনকার বক্তব্যের সাথে মিলে যায় হুবহু। 

একসময় বেগম জিয়া বলেছিলেন, আমরা এ আওয়ামী লীগকে পঁচার সময় দিচ্ছি! এ আওয়ামী লীগ একদিন পঁচে, গলে সারাদেশে দুর্গন্ধ ছড়াবে। আজ বিশ্ব দেখছে আওয়ামিলীগের দুর্গন্ধ দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব ছড়াচ্ছে।

বেগম জিয়ার ২৭ ফেব্রুয়ারির ভাষণ শুধু দলীয় রাজনীতির জন্য নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষণ, দলীয় সংহতি বজায় রাখা এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করা- রাজনীতির জন্য সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা।

খালেদা জিয়ার দূরদর্শিতা, অভিজ্ঞতা এবং অনড় রাজনৈতিক অবস্থান তার ভাষণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। একজন অসুস্থ ও বয়স্ক নেত্রী হয়েও তিনি যে এখনও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, তার বক্তব্য তা আবারও প্রমাণ করে। তার এ দিকনির্দেশনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে দলীয়ভাবে শুদু বিএনপি নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েও ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারক হতে পারে।

সম্পাদক
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫