আছিয়া-মুনিয়াসহ সকল ধর্ষণের বিচার হোক শীঘ্রই
ক্ষমতার অপব্যবহার হোক বা সাধারণ অপরাধ, প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনা একই রকম নিন্দনীয় এবং এর দ্রুত ও কার্যকর বিচার হওয়া প্রয়োজন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করার কারণে ধর্ষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে সমাজে।

ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি যা প্রতিনিয়ত মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে। এটি কেবল একটি ব্যক্তির উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামোর উপর এক গভীর আঘাত। সাম্প্রতিককালের আছিয়াসহ বিগত ১৬ বছরের অনেক নির্যাতিত নারী ন্যায়বিচারের আশায় দিন গুনছেন, কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাদের আশাহত করছে।
ধর্ষণের বিচারে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ধর্ষণের মধ্যে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। যদিও বিগত ১৬ বছরে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষণের ভিন্নমাত্রা পেয়েছে দেশ। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রে সংগঠনের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন, নৌকা প্রতীকে ভোট না দেয়ার কারণে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিচার তো হয়-ই নি, বরং মুনিয়ার ধর্ষক ও হত্যাকারীকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পর্যন্ত বানিয়ে ছেড়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার হোক বা সাধারণ অপরাধ, প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনা একই রকম নিন্দনীয় এবং এর দ্রুত ও কার্যকর বিচার হওয়া প্রয়োজন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করার কারণে ধর্ষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে সমাজে।
ধর্ষণ কেবল একজন নারীর ওপর নির্যাতন নয়, এটি একটি সমাজের ওপরও আক্রমণ। এটি নারীর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
একটি ধর্ষণের ঘটনা একজন ভুক্তভোগীর জীবনকে স্থবির করে দিতে পারে। তারা সামাজিক লজ্জা, পারিবারিক অসমর্থন, এবং মানসিক আঘাতের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের আশায় পুলিশের কাছে যায়, কিন্তু সেখানেও তারা হয়রানি, অবহেলা, এবং দুর্নীতির সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। অনেক সময় ধর্ষণের মামলাগুলো বছরের পর বছর আদালতে পড়ে থাকে এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান না। ফলে অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যা আরও ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া, ভুক্তভোগীরা সামাজিক ও পারিবারিক কারণে মামলার শেষ পর্যন্ত যেতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী রাজনৈতিক বা ক্ষমতাশালী হওয়ায় মামলাগুলো প্রভাবিত হয়, এবং ভুক্তভোগী হুমকির সম্মুখীন হন। এমনকি অনেক সময় পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোও সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে না, যা বিচার প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করে তোলে।
রাজনৈতিক ধর্ষণ হলো সেসব ধর্ষণের ঘটনা, যেখানে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় বা ক্ষমতা ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত করে এবং বিচার থেকে রেহাই পায়। এটি একটি ভয়াবহ প্রবণতা, যেখানে অপরাধীরা তাদের প্রভাব খাটিয়ে ভুক্তভোগীকে চুপ করিয়ে দেয় অথবা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে। অভাগা বাংলাদেশ বিগত ১৬ বছর সাধারণ ধর্ষণের পাশাশাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বেশি। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকার পরও আইনের আওতায় আসে না। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সংগঠনগুলো মামলা তুলে নেয়ার জন্য ভুক্তভোগীদের চাপ দেয়। এমনকি অনেক সময় পুলিশ ও প্রশাসন রাজনৈতিক চাপের কারণে সঠিকভাবে তদন্ত করে না। রাজনৈতিক ধর্ষণ সাধারণ ধর্ষণকে প্রলুব্ধ করে।
রাজনৈতিক ধর্ষণের পাশাপাশি, সাধারণ অপরাধ হিসেবে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোরও সঠিক বিচার হওয়া প্রয়োজন। রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি ঘরেও নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অপরাধীরা আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে বারবার অপরাধ করে।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি, যা প্রতিহত করতে হলে সামাজিক সচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ, এবং বিচার বিভাগের দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
ধর্ষণের বিচার দ্রুত এবং কার্যকর করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন—
১. আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল:
ধর্ষণের বিচার দ্রুত করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন। অনেক সময় মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা:
কোনও ধর্ষণের ঘটনায় রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাব যাতে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও সহযোগিতা:
ধর্ষণের শিকার নারীদের আইনি সহায়তা, মানসিক পরামর্শ, এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। অনেক সময় ভয় বা লজ্জার কারণে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে ভয় পায়। এজন্য তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
৪. গণসচেতনতা বৃদ্ধি:
ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মান ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. ধর্ষণের সাজা কঠোর করা:
বর্তমান আইনে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর হলেও এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হয় না। অপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।
ধর্ষণ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, এটি একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি যা মানবাধিকারের পরিপন্থী। আছিয়াসহ সকল ধর্ষণের শিকার নারীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ধর্ষণের মধ্যে কোনও পার্থক্য না করে প্রত্যেক ধর্ষণের জন্যই দ্রুত বিচার হওয়া উচিত। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা, এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। তাই, এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। না হলে আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।
১৪ মার্চ ২০২৫
সম্পাদক