ভারতের ভিক্ষার থলে, হচ্ছে কী মোদির হাত গলে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার একাধিক দৃষ্টিকটূ ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলেনি, বরং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। এসব সিদ্ধান্ত শুধু ভারতের কূটনৈতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ধীরে ধীরে একটি একঘরে রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
ভিসা ও ট্রানজিট নিষেধাজ্ঞা: প্রতিবেশীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি কঠিন করে তোলা, ট্রানজিট সুবিধা স্থগিত করে দেয়া এবং আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি করে ভারত কার্যত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ঠান্ডা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে। এ সিদ্ধান্তগুলো ভারতের জন্য যে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তা দিন দিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের কৃষি, ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা চোখে পড়ার মতো।
কোলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বাইসহ ভারতের বড় বড় শহরের অসংখ্য হোটেল, যেগুলোর প্রধান গ্রাহক ছিলো ভারতমুখী চিকিৎসা বা ভ্রমণে আগ্রহী বাংলাদেশিরা—তাদের আয় হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া অনেক রোগী এখন বিকল্প দেশ খুঁজছে, যা ভারতের চিকিৎসা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একইভাবে কোলকাতা, আগরতলা, ব্যাঙ্গালোর প্রভৃতি শহরের হাসপাতাল, যেখানে প্রতিদিন শত শত বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ভিড় করতো, তারা এখন খালি বিছানায় অপেক্ষা করছে। কোলকাতার অনেক হাসপাতাল, হোটেল ও দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক টেক্সিচালক না খেয়ে দিনাতিপাত করছে।
প্রতিবেশি নীতিতে পতন: মিত্রহীন ভারত
নরেন্দ্র মোদি ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ বা 'প্রতিবেশী অগ্রাধিকার' নীতির কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তার নীতির বিপরীতে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এমনকি ভুটান পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান তো তাদের ‘অহেতুক চিরশত্রু’র দেশ। চীনের মতো একটি শক্তি এ সুযোগে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছে, যেখানে ভারত একসময় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিলো।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ: একপাক্ষিক সমর্থনের বিপর্যয়
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বহুদিন ধরেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, কিন্তু মোদি সরকারের সময়ে তা যেনো অতিমাত্রায় একপাক্ষিক হয়ে উঠেছে। নিশিভোটের অবৈধ ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে ভারত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের বিরোধী দল ও জনগণের এক বড় অংশ ভারতের প্রতি হতাশা ও ক্ষোভ পোষণ করছে। এতে করে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমেই প্রবল হচ্ছে, যা ভারতের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।
এমনকি বর্তমানেও মোদি সরকার ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে এবং তাকে, তার দরকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে যাচ্ছে— যাদের দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী ঘৃণাভরে অপছন্দ করছে। এ একপাক্ষিক সমর্থন ভারতের নিজস্ব ভাবমূর্তিকে আরও কলুষিত করছে। শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও মোদির অবস্থান ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কারণ, বিশ্ব আজ মোদির পশ্চাদপদ ন্যারেটিভ নয়, বরং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বের কণ্ঠকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে। ড. ইউনূস গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছেন বিশ্বব্যাপী, আর মোদি-হাসিনা জোটকে দেখা হচ্ছে সে মূল্যবোধের পরিপন্থী শক্তি হিসেবে।
অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে সাম্প্রদায়িক উস্কানি: ওয়াকফ আইন ও মুসলিম নিপীড়ন
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে মোদি সরকারের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত পদক্ষেপ হলো ওয়াকফ আইন সংশোধন। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত জমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে সরকার একদিকে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
সিএএ-এনআরসি আইন, গোরু হত্যাকে কেন্দ্র করে মুসলিম হত্যা, হিজাব নিষিদ্ধকরণ, আজান ও মসজিদ নিয়ে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি সিদ্ধান্তে মুসলিম সম্প্রদায় আজ আতঙ্কগ্রস্ত। এ ধর্মীয় দমন নীতির ফলে ভারতের বহুসাংস্কৃতিক চরিত্র আজ বিপন্ন।
আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যর্থতা: ট্রাম্প ও তুলসী গ্যাবার্ড কার্ড
মোদি সরকারের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও আত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াস, ‘হাউডি মোদি’ ইভেন্ট আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং তুলসী গ্যাবার্ডের মতো কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রচারের মুখ বানানোর ফলে ভারত আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য হারিয়েছে।
আরও পড়ুন <<>> ট্রাম্পের ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’: আমাদের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের পথ
ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মোদি সরকারের এ ‘একজনের সঙ্গে সম্পর্ক’ কৌশল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুলসী গ্যাবার্ডকে সামনে এনে ভারতের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আরও বিতর্কিত হয়েছে।
অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের পূর্বাভাস
ভারতের এ সিদ্ধান্তগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ইতোমধ্যেই অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। মুসলিম ও সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করা, মুসলিমভিত্তিক পর্যটন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের সংকোচন, বাণিজ্যিক প্রতিবেশী হারানো—সব মিলিয়ে ভারতের অর্থনীতি একটি মহা সংকটে প্রবেশ করছে।
বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশ একা টিকে থাকতে পারে না। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা শুধু নৈতিক দায় নয়, এটি অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রয়োজন। মোদি সরকারের অদূরদর্শী ও একপাক্ষিক নীতির কারণে ভারত সে চিরায়ত কূটনৈতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে চলেছে।
ভারতের বর্তমান সরকারের পদক্ষেপগুলো কেবল স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে গৃহীত, যার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। মোদি সরকারের উচিত হবে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নীতিগত সংশোধন আনা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা। না হলে ভারত শুধু আন্তর্জাতিক পরিসরে নয়, নিজ দেশেও বিচ্ছিন্ন এক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
১১ এপ্রিল ২০২৫
সম্পাদক