দেড় দশকের স্বপ্ন: অল্প চাওয়ায় বড় পাওয়া
এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার বিশ্বাসের ভাঙা সেতুগুলো আবার গড়ে ওঠবে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র কেবল তার জনগণের কর দিয়ে চলে না, বরং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে সম্মান করেই এগিয়ে যায়।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ সামুদ্রিক মৎস্যজীবী দীর্ঘদিন ধরে একটি ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি জানিয়ে আসছিলেন—সাময়িক মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময় যেন প্রতিবেশী ভারতীয় উপকূলরক্ষীদের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারণ করা হয়।
এ দাবি শুধু তাদের জীবিকার সুরক্ষার জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং আঞ্চলিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এ দাবিটি কোনো বিলাসিতাও নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য একটি মৌলিক শর্ত। অথচ গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এ দাবিকে সরকারগুলো উপেক্ষা করে এসেছে। ফলে প্রতি বছর যখন বাংলাদেশ সরকার মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতো, তখন ভারতের জেলেরা বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যেতো। আমাদের জেলেরা তখন নিরুপায়ভাবে তীরে বসে থাকতেন, আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন, কীভাবে সমুদ্রের রত্ন হাতছাড়া হচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য গৃহীত সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সরকারের এ সমন্বিত নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত শুধু মৎস্যজীবীদের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণই নয়, বরং এর বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশ সরকার এবছর ১৫ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ৫৮ দিনের জন্য সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা ভারতের সমুদ্র নিষেধাজ্ঞার সময়সীমার (৬৫ দিন) সঙ্গে প্রায় সমন্বিত। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সরকার একদিকে যেমন মৎস্যসম্পদ রক্ষায় আন্তঃদেশীয় কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করলো, অন্যদিকে উপকূলীয় জীবন-জীবিকাকে রক্ষা করার দিকেও দায়িত্বশীলতার নজির রাখলো।
সমন্বয়হীন নিষেধাজ্ঞার ফলে এতদিন মৎস্যজীবীরা ছিলেন দ্বিগুণ ক্ষতির শিকার। নিজেদের সরকারের বিধিনিষেধ মান্য করে যখন তারা সমুদ্রে নামতেন না, তখনই প্রতিবেশী দেশের জেলেরা বাংলাদেশ সীমান্ত লঙ্ঘন করে মাছ ধরে নিয়ে যেতো। এতে যেমন সীমান্তভিত্তিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতো, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের ক্ষতি হতো। এবারের সিদ্ধান্তে সে অসমতা অনেকটাই দূর হয়েছে।
সামান্য দাবি, অতিরিক্ত প্রাপ্তি
সরকারের ঘোষিত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা ভারতের ৬৫ দিনের তুলনায় ৭ দিন কম। অর্থাৎ, এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাংলাদেশের জেলেরা সমুদ্রে নামার সুযোগ পাচ্ছেন। যা অর্থনৈতিকভাবে একটি বড় সুবিধা। কারণ নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী সময়টা মাছ ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভজনক। তখন মাছের প্রাচুর্য থাকে, বাজারও থাকে অনুকূলে। সুতরাং এ সময়সীমার ব্যবধান বাংলাদেশি জেলেদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অনুকূল হবে।
এছাড়াও, দীর্ঘদিনের অবহেলা, উপেক্ষা ও অসমতার অবসান ঘটিয়ে সরকার যখন এ পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন তা শুধু প্রাপ্তির জায়গা নয়, বরং আত্মমর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠাও বটে। প্রতিবেশীর অন্যায়, অহমিকা আর সীমান্ত লঙ্ঘনের প্রতি দীর্ঘদিন যে রাষ্ট্রীয় নীরবতা বিরাজ করেছিলো, তা এ সিদ্ধান্তে খানিকটা হলেও ভাঙলো। সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিপক্ব ও বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করার ইঙ্গিত এভাবেই বোঝা যায়।
রাষ্ট্র-জনসম্পর্কে নতুন আস্থা
এ সিদ্ধান্তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাষ্ট্র ও মৎসজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে অংশীদারত্বের সম্পর্ক স্থাপন। সরকার যখন জনগণের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়, তখন এটি নাগরিকদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। মৎসজীবীরা এখন নিজেদের রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অনুভব করতে পারবে। এ আচরণগত পরিবর্তন তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করবে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে। এটি একটি সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক অংশগ্রহণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।
দীর্ঘদিন মৎস্যজীবীদের অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করার যে ধারা ছিলো, তার পরিবর্তন আনতে হলে এমন সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিলো। এখন সরকারের উচিত হবে এ ইতিবাচক পদক্ষেপকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানো। নিষেধাজ্ঞার সময়কাল জুড়ে মৎস্যজীবীদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সমুদ্রসীমায় টহল জোরদার করা—এ দু’টি পদক্ষেপ এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
সামনে এগিয়ে চলার দিকনির্দেশনা
এ সফল সমন্বয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আরও জোরদার করা যেতে পারে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সমুদ্রসম্পদকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত প্রতিযোগিতার যুগে বাংলাদেশের এ পদক্ষেপ একটি সাহসী শুরু।
পাশাপাশি, মৎস্যজীবী সমাজের প্রতি প্রশাসনিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটিকে সুসংহত করে নীতিনির্ধারকদের আরও কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উপকূলীয় অর্থনীতি, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের প্রশ্নগুলোকে একসূত্রে বেঁধে একটি টেকসই সমুদ্রনীতি গঠনের সময় এখনই।
দেড় দশকের অল্প চাওয়াই পেলো অতিরিক্ত প্রাপ্তির স্বীকৃতি। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের ক্ষুদ্র ও ন্যায়সঙ্গত দাবিকে সরকার যে আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার বিশ্বাসের ভাঙা সেতুগুলো আবার গড়ে ওঠবে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র কেবল তার জনগণের কর দিয়ে চলে না, বরং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে সম্মান করেই এগিয়ে যায়।
এ সম্পাদকীয় কেবল সরকারের প্রশংসা নয়, এটি একটি বার্তাও—রাষ্ট্র যখন জনগণের পাশে দাঁড়ায়, তখন জনগণও রাষ্ট্রকে আপন করে নেয়। মৎস্যজীবীদের এ প্রাপ্তি ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনেরই পূর্বাভাস।
১৮ এপ্রিল ২০২৫
সম্পাদক