ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি: বাংলাদেশে এক নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি কখনোই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আমরা অসংখ্য অন্যায়, দুর্নীতি, গুম, খুন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সাক্ষী হয়েছি, কিন্তু এসবের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এ প্রেক্ষাপটে, সাম্প্রতিক সময়ে আসিফ মাহমুদের তার পিতার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং এনসিপির এক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাময়িক অব্যাহতির ঘটনা এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল, তবে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ, যা আমাদের সমাজে জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।
আসিফ মাহমুদের ক্ষমা প্রার্থনা: একটি নজির
আসিফ মাহমুদ, একজন তরুণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তার পিতার ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর বিষয়ে জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, তিনি তার পিতার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তর্কের খাতিরে এটি ধরে নিলেও যে ব্যাপারটি তিনি জানতেন; কিন্তু তিনি ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে তার পিতার পক্ষ নেননি। বরং, তিনি নিজেকে এ বিষয় থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। আমাদের সমাজে, যেখানে লক্ষ-কোটি টাকার দুর্নীতি, হাজার হাজার গুম-খুন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনায় কেউ কখনো দায় স্বীকার করেনি, সেখানে আসিফ মাহমুদের এ পদক্ষেপ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আরও পড়্রন <<>> দেড় দশকের স্বপ্ন: অল্প চাওয়ায় বড় পাওয়া
এ ঘটনা আমাদেরকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—কেনো আমাদের সমাজে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি? কেন আমরা ভুল স্বীকার করতে এত দ্বিধাবোধ করি? আসিফ মাহমুদের ক্ষমা প্রার্থনা দেখিয়ে দিলো, ভুল স্বীকার করা দুর্বলতা নয়, বরং সাহস ও নৈতিকতার প্রমাণ। এটি আমাদের সমাজের জন্য একটি শিক্ষা, যা অনুসরণ করা উচিত।
এনসিপির সিদ্ধান্ত: জবাবদিহিতার একটি পদক্ষেপ
একইভাবে, এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্তও প্রশংসার দাবিদার। যদিও এ অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি, তবু দলটির এ পদক্ষেপ দেখায় যে, তারা জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল, যেখানে কোনো দল অভিযোগের প্রেক্ষিতে এত দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি, প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতিবাজ বা অপরাধী নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এনসিপির এ পদক্ষেপ তাই একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
খালেদা জিয়ার নজির: ভুল সংশোধনের সাহস
এ প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণ করতে হয় গণতন্ত্রের নেত্রী মহিয়সী নারী বেগম খালেদা জিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ভুল সিদ্ধান্তের পর তিনি সে ভুল থেকে তাৎক্ষণিক সরে এসে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নিজ থেকেই। এটি ছিলো তার নৈতিক দায়িত্ববোধ ও সাহসের প্রমাণ। কিন্তু এমন উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে খুবই কম। আমরা দেখেছি, অনেক নেতা তাদের ভুল বা অপরাধকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে আরও বেশি অহংকার প্রদর্শন করেছেন।
ক্ষমা চাওয়ার বিপরীত চিত্র
দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে এখনো এমন অনেকে আছেন, যারা ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, তাদের অপরাধের জন্য কোনো অনুশোচনাও প্রকাশ করেন না। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী পলাতক শেখ হাসিনা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, শাজাহান খান বা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি ছাত্রলীগ নেতা সৈকতের মতো ব্যক্তিরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে প্রতিদিন হুমকি ও অহংকার প্রদর্শন করছেন। এমনকি, যিনি ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ও মন্ত্রিত্বের অধিকারী হয়েও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও সম্পদের মালিক, তিনিও তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাননি। বরং, প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যাচারের মাধ্যমে নিজের অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।
ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি কেন প্রয়োজন?
ক্ষমা চাওয়া কেবল ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয় নয়, এটি একটি সমাজের সুস্থতা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। যখন কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের ভুল স্বীকার করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন তা জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। এটি সমাজে জবাবদিহিতার একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সহায়ক। আমাদের সমাজে, যেখানে দুর্নীতি জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠলে তা পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়। আমাদের সমাজে এখনো অনেকে এটিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখেন। রাজনৈতিক নেতারা ভয় পান যে, ক্ষমা চাওয়া তাদের জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। কিন্তু আসিফ মাহমুদ, এনসিপি এবং খালেদা জিয়ার মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করেছে যে, ক্ষমা চাওয়া বা ভুল সংশোধন করা দুর্বলতা নয়, বরং শক্তি ও নৈতিকতার প্রকাশ। তাদের এ পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা উচিত।
একই সঙ্গে, আমাদের সমাজে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ক্ষমা চাওয়াকে উৎসাহিত করা হবে। এটি কেবল রাজনৈতিক নেতাদের জন্য নয়, প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম এ সংস্কৃতি প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আসিফ মাহমুদের ক্ষমা প্রার্থনা, এনসিপির জবাবদিহিতার পদক্ষেপ এবং খালেদা জিয়ার ভুল সংশোধনের উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এ পদক্ষেপগুলো আমাদের সমাজে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হতে পারে। এটি আমাদেরকে শেখায় যে, ভুল স্বীকার করা এবং তার জন্য ক্ষমা চাওয়া দুর্বলতা নয়, বরং একটি সুস্থ ও নৈতিক সমাজ গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা আশা করি, এ উদাহরণগুলো অনুসরণ করে আমাদের সমাজ আরও জবাবদিহিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক হবে। এ পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সকলের প্রতি আহ্বান—আসুন, ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করি এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
২৫ এপ্রিল ২০২৫
সম্পাদক