তীব্র সমালোচনার ঝড়
হাসিনার পক্ষে ববি শিক্ষকদের গোপন সভা ফাঁস

২০২৪ সালের জুলাই মাসে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) একদল শিক্ষকের মাফিয়ারাণী হাসিনার পক্ষে গোপন জুম সভার ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে ভাইরাল হয়েছে।
৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত এ সভায় শিক্ষকরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন, ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকার পতন ঠেকাতে যেকোনো উপায়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, অনেকে জড়িত শিক্ষকদের গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন।
সভার বিস্তারিত
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সভাটি পরিচালিত হয়। সভার শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম উপস্থাপনা বক্তৃতায় বলেন, জরুরি ভিত্তিতে এ মিটিং আয়োজন করা হয়েছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবদুল বাতেন চৌধুরী বিস্তারিত বলবেন, এবং উপাচার্য মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা একে একে কথা বলবো।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবদুল বাতেন চৌধুরী বলেন, দেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সময়ে আমাদের সকলের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এক দফা দাবির কোনও যৌক্তিকতা নেই। আমি এ আন্দোলনকে ঘৃণা করি এবং প্রত্যাখ্যান করি। আমরা সবাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, তারা আজ শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়াতে চায়। এখন আমাদের সময় শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর।
শিক্ষকদের অবস্থান
সভায় অংশ নেয়া শিক্ষকদের অধিকাংশই ড. বাতেনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিল আফরোজ খানম আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, গত দু’দিন ধরে আমার গলা ধরে আসছে, কথা বের হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। অন্যান্য শিক্ষকরাও শেখ হাসিনার পক্ষে তাদের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন।
তবে, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীন এ সভায় ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আমরা সবাই একমত ছিলাম যে শিক্ষার্থীরা যেন আহত বা হয়রানির শিকার না হয়। আমরা তাদের আগলে রাখতে চাই। তার এ বক্তব্য সভায় উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষকদের সমালোচনার মুখে পড়ে।
সভার অংশগ্রহণকারী
সভায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবদুল বাতেন চৌধুরী, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিল আফরোজ খানম, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীনসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন।
জনরোষ ও সমালোচনা
ভিডিওটি ফাঁস হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নেটিজেনরা শিক্ষকদের এ অবস্থানকে ‘শিক্ষকতার পেশার প্রতি কলঙ্ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে মনে করেন, শিক্ষকদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা উচিত ছিলো, কিন্তু তারা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বে জড়িয়েছেন। কেউ কেউ জড়িত শিক্ষকদের শাস্তি এবং গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন। বিশেষ করে, ছাত্র আন্দোলনের প্রতি তাদের ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের ভাষা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
প্রেক্ষাপট
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারবিরোধী বৃহত্তর গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এ আন্দোলনের এক দফা দাবি ছিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ। এ সময়ে দেশব্যাপী তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। পাখির মতো গুলি করে খুনি হাসিনার পেটুয়াবাহিনী হাজার হাজার নিরস্র ছাত্র-জনতাকে গুলি করে, পিটিয়ে মেরেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ৩ আগষ্ট লাখো মানুষের উপস্থিতিতে হাসিনা পতনের একদফা আন্দালনের ঘোষণা হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। এরকম সময়ে শিক্ষকদের এ সভা সে প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়। ফাঁস হওয়া ভিডিওটি প্রমাণ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ সরকারের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করার পরিকল্পনা করছিলেন, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলেছে।
সম্ভাব্য প্রভাব
এ ঘটনা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি জনগণের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষকদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া, এ ঘটনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য নীতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ভিডিও নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন। এ ঘটনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার গুরুত্ব পুনরায় সামনে এনেছে।
সবার দেশ/কেএম