আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, দেশে লোডশেডিং বাড়ার শঙ্কা

ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়ায় লোডশেডিং বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটই বন্ধ রয়েছে, যা দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
কেন্দ্র বন্ধের বিবরণ
আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট রয়েছে, প্রতিটির ক্ষমতা ৮০০ মেগাওয়াট। পিডিবি সূত্র জানায়, কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রথম ইউনিটটি ৮ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে। এরপর শুক্রবার (১১ এপ্রিল) দিবাগত রাত ১টার দিকে দ্বিতীয় ইউনিটটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কেন্দ্র থেকে সাধারণত ১৪০০ থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করতো।
লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা
পিজিসিবি ও পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কম থাকলেও দিনভর সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৩,৫০০ মেগাওয়াট। এ সময় প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। তবে আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় শুরু না হলে রোববার থেকে লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আদানির বিদ্যুৎ না এলে ঘাটতি ১৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা গ্রামাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা
বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পিডিবি পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাড়তি গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, আদানি ত্রুটি মেরামত করে দ্রুত একটি ইউনিট চালুর চেষ্টা করছে। আমরা তেল ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বাড়তি উৎপাদনের মাধ্যমে ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছি। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হবে।
আদানির সঙ্গে বিরোধ ও পটভূমি
আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছরের জন্য কিনতে ২০১৭ সালে পিডিবির সঙ্গে চুক্তি হয়। প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে এবং দ্বিতীয় ইউনিট থেকে জুনে। তবে কয়লার দাম ও বকেয়া বিল পরিশোধ নিয়ে পিডিবি ও আদানির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। গত বছর এক পর্যায়ে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিলেও পরে চলতি বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরবরাহ পুনরায় শুরু হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে পিডিবির অনুরোধে দুটি ইউনিটই পুরোদমে চালু করা হয়।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একটি কমিটি আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তি পর্যালোচনা করছে। কয়লার দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও চুক্তির শর্তে ‘একতরফা’ সুবিধার অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, আদানির বকেয়া প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যা পরিশোধে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রভাব ফেলছে।
অর্থনৈতিক ও শিল্পের ওপর প্রভাব
আদানির বিদ্যুৎ বন্ধ হওয়ায় দেশের শিল্পখাত, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশের রফতানির ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে পোশাক খাত থেকে, যা স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, লোডশেডিং বাড়লে উৎপাদন ও রফতানি সময়সূচিতে ব্যাঘাত ঘটবে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পিডিবি ও পিজিসিবি কর্মকর্তারা জানান, আদানি শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে একটি ইউনিট চালুর চেষ্টা করছে। তবে পুরোপুরি সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে। এদিকে, গ্যাস ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
এ সংকট গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা এবং চুক্তির শর্তাবলী পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো এবং বৈচিত্র্যময় জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো এ ধরনের সংকট এড়াতে কার্যকর হবে।
সবার দেশ/এমকেজে