মরিচের সাতকাহন
দুনিয়াতে সম্ভবত মরিচই একমাত্র ফল বা সবজি যা কামড়ালে পাল্টা কামড় দেয়। এ পাল্টা কামড়ের প্রতিক্রিয়া মরিচের জাতভেদে নানা ধরনের হতে পারে। কোনটা কামড় দেয়ার সাথে সাথে মুখের ভেতর জ্বালা শুরু হয়, কোনটা গলাধঃকরণ না করা পর্যন্ত টের পাওয়া যায়না। কোনটা জিহ্বার আগায় জ্বালা ধরিয়ে দেয়, কোনটা আবার সমস্ত মুখগহবরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিশ্বে প্রায় ২০ থেকে ২৭ জাতের মরিচ আছে। এর মধ্যে ৫টি জাতের আবাদ হয়। রং, আকার, আকৃতিতে ও ঝালের মাত্রায় সবগুলোই ভিন্ন ধরনের।
অনেকে মরিচ পছন্দ করেন না কারণ তারা মনে করেন ঝাল হওয়ায় খাদ্যের স্বাদ বোঝা যায় না। আসলে ব্যাপারটা উল্টো। ঝাল মুখের ভিতরে খাদ্যের স্বাদ উপলব্ধিকারী কোষগুলোর মধ্যে সাড়া জাগিয়ে খাবারের সুবাস গ্রহণে উজ্জীবিত করে তোলে।
জাপানে সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রফেসর লেকচার দেয়ার সময় হঠাৎ মরিচের প্রসঙ্গ চলে আসে। বিভিন্ন জাতের মরিচের স্বাদে পার্থক্য আছে একথা বলতেই ভদ্রলোক প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে পড়েন।
মরিচ মানে ঝাল। ঝালের স্বাদে আবার পার্থক্য কোথায়? এক কোরিয়ান ছাত্র এসে প্রফেসরকে রক্ষা করে। সে তার সাথে একমত পোষণ করে সাক্ষ্য দেয় যে তাদের দেশেও ভিন্ন স্বাদের মরিচের জাত আছে। এর বেশ কিছু বছর পর সিউলে যেয়ে ঐ প্রফেসর দেখেন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে শুকানো লাল মরিচ প্লাস্টিকের বড় বড় ব্যাগে বিক্রি হচ্ছে। মনে হলো কোরিয়ানরা যথেষ্ট মরিচ খায়। কোরিয়ান কিমচি প্রচণ্ড ঝালের এবং সারা বিশ্বে বিখ্যাত। ঢাকায়, গুলশান-বনানীতে পাওয়া এ মরিচ পাওয়া যায়।
মরিচে ক্যাপসেইসিন নামের বর্ণহীন একটি রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ঝালের তিব্রতা নির্ধারণ করে। ঝালের তিব্রতার উপর ভিত্তি করে মরিচকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হতো – ঝাল, বেশ ঝাল, খুব ঝাল, প্রচণ্ড ঝাল, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার মত ঝাল, ইত্যাদি।
একজন আমেরিকান ফার্মাসিস্ট ১৯১২ সালে মরিচের ঝালের মাত্রা পরিমাপের একটি পদ্ধতি বের করেন। এ পদ্ধতিতে ঝালের মাত্রা স্কভিল হিট ইউনিট (এসএইচইউ) হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। এ হিসেবে বিশ্বে শূন্য থেকে ৩০০,০০০ এসএইচইউ পর্যন্ত মরিচের জাত পাওয়া গেছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে নাগা জাতের মরিচ সংগ্রহ করে দক্ষিণ পশ্চিম ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টিতে জয় ও মাইকেল মিচাউড দম্পতি পলি-টানেলে উৎপাদন করে ঝালের মাত্রা ১০,৩২,৩১০ এসএইচইউ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। তারা এ মরিচের নামকরণ করেছে ডরসেট নাগা। এটাই এখন বিশ্বে রেকর্ডধারী সর্বাধিক ঝালের মরিচ।
আমাদের দেশে নাগা মরিচ পাওয়া যায়। সিলেটে নাগা মরিচের ব্যাপক চাষ হয়। একে নাগাবিহ জলকিয়া বা ভূত মরিচও বলা হয়। আমাদের দেশের ধান্য (বার্ডস আই) ধেনো মরিচের ঝালের মাত্রা ১০০,০০০ থেকে ১২৫,০০০ এসএইচইউ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। মেক্সিকোতে উৎপাদিত হাবানেরো মরিচের ঝালের মাত্রা ৬০০,০০০ এসএইচইউ।
হাবানেরো মরিচের কামড় সাংঘাতিক, দুর্দান্ত। খাওয়ার সাথে সাথে মনে হবে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে স্বস্তিকর ও সুগন্ধিময় অনুভূতি তৈরি হবে। একটু আগে আক্রান্ত হওয়ার কথা মনেই থাকবে না। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত নিজকে হালকা বধির মনে হবে। ঝালের চোটে নিজের চিল্লেপাল্লা নিজেই শুনতে পাওয়া যাবে না।
ডরসেট নাগা আরো ভয়ঙ্কর। অর্ধেকটাই তরকারির জন্য যথেষ্ট, পুরোটা খেলে হাসপাতালে যেতে হতে পারে বলে সাবধান করে দেয়া হয়। এমনকি সিলেটে, অনেকে নাগা মরিচ খেতে ভয় পান। তরকারিতে এ মরিচের বোটা ধরে একটু ছুঁইয়ে দিলে নাকি ঝাল হয়ে যায়। তবে সাবধান, কাচা নাগা মরিচ স্পর্শ করলে সাথে সাথে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত।
মরিচের মধ্যে স্বাস্থ্যকর উপাদান আছে। একটা কাঁচা মরিচে একটা কমলার থেকেও বেশি 'ভিটামিন সি' থাকে। এছাড়া ভিটামিন এ, বি-১, বি-২, নিয়াসীন, লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, শর্করা ও আমিষ থাকে। মরিচে বিদ্যমান ক্যাপসেইসিন শরীরে রক্তচাপ এবং রক্ত জমাট বাঁধা হ্রাস করতে পারে। নাসিকা বন্ধ হলে ঝাল স্যুপ বা তরকারি বেশ কার্যকরি। ক্যাপসেইসিন দিয়ে তৈরি ক্রিম শিঙ্গেলস বা জোনা (ভাইরাস জনিত চর্মরোগ) নিরাময়ের জন্য কার্যকর। বাতরোগের চিকিৎসায় ক্যাপসেইসিন ব্যবহৃত হয়।
মরিচ হজম শক্তি বৃদ্ধি করে ও খাওয়ার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ক্যাপসেইসিন কাশির সিরাপে ব্যবহার করা হয়। মরিচ খেলে পাকস্থলীতে আলসার হয় এটা অনেকেই স্বীকার করেন না। বরং মরিচ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে আলসার প্রতিরোধ করে বলে তারা যুক্তি দেন। তবে ডাক্তারেরা পাইলস অপারেশনের পর পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মরিচ খেতে নিষেধ করেন।
আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিকাল নিউট্রিশন-এর মতে নিয়মিত মরিচ খাওয়া আহারের পরে শরীরের ইনসুলিন মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে যাওয়ায় যাদের ওজন অতিরিক্ত বা ডায়াবেটিকস্ আছে তারা উপকৃত হন। যা হোক সারা বিশ্বে এখন মরিচ খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মরিচ কীভাবে প্রতিক্রিয়া করে যার ফলে মুখের মধ্যে জ্বালা ধরে, চোখ দিয়ে পানি ঝরে এবং বুকের মধ্যে ফুসফুস আকড়ে ধরে? মনোবিজ্ঞানীদের মতে মরিচ খাওয়ার পর জ্বালা শুরু হওয়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কে সাড়া পড়ে যায়। ক্যাপসেইসিন যখন স্নায়ুর শেষ প্রান্ত জ্বিহ্বা ও মুখের সংস্পর্শে আসে তখন ব্যাথার সংবাদ বহনকারী দূত যাদেরকে নিউট্রোট্রান্সমিটার বলা হয় তারা – আগুন! আগুন! এই সম্ভাব্য দুঃসংবাদ বহন করে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়। ফলে মস্তিষ্ক সতর্কতা অবলম্বন করে এবং দেহকে সাবধান করে দেয়। হৃদকম্পন বাড়তে থাকে, মুখে লালা তৈরি হয়, নাক থেকে পানি নির্গত হতে শুরু করে এবং মাথা, কপাল ও চোয়াল থেকে ঘামের স্রোত বইতে থাকে। দেহ যখন রাসায়নিক পদার্থ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট এবং মস্তিষ্ক ভাবতে থাকে যে দেহ আক্রান্ত বা ক্ষত হয়েছে, তখন প্রাকৃতিক ব্যথানাশক এন্ডরফিন্স নিঃসরিত হতে থাকে। যেহেতু মরিচ প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষতি করে না, কামড় দেয়ার সাথে ওপিয়াম সেবনের মত মস্তিষ্কে সাড়া পড়ে যায়। পরবর্তী কামড়ে মস্তিষ্ক ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে বলে অনুভব করে আরো এন্ডরফিন্স নিঃসরিত করে দেয়। এ থেকে বোঝা যায় যে অনেক মরিচ ভক্ত ধীরে ধীরে কেন তাদের খাদ্যে ঝালের মাত্রা বৃদ্ধি করেন।
সারা বিশ্বে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টন মরিচ উৎপাদিত হয় এবং এর মধ্যে এশিয়াতে দুই-তৃতীয়াংশ। আমদের দেশে বছরে প্রায় দুই লক্ষ টন মরিচ উৎপাদিত হয়। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয়। সব মিলে বছরে মাথাপিছু প্রায় দেড় কেজি এবং খানা বা পরিবার প্রতি ৯ কেজি মরিচ খাওয়া পড়ে। এলাকা ভেদে এমনকি এক এক পরিবারে মরিচ খাওয়ার পরিমাণ আলাদা। বলা হয় উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা বেশি মরিচ খান। জাপানের ফুকুওকা শহরে ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক খাদ্য উৎসবে মরিচ খাওয়ার প্রতিযোগিতা হল। জাপানিজসহ বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিল। তবে ডক্টর কোর্সের ছাত্র আবুল হোসেন প্রথম এবং একজন জাপানিজ পরবর্তী স্থান দখল করেন। আবুল হোসেনের বাড়ি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।
অনেক বিদেশীরা বাংলদেশে এসে মরিচ খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। হার্ব উইব এমনই একজন। কানাডা থেকে এসেছেন। আমরা একসাথে একটি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করি। আর একজন কানাডিয়ানসহ সিলেটে যেয়ে সকালে নাস্তায় পরাটা ও মুরগী দোপেয়াঁজা খেলাম। দোপেয়াঁজা বেশ ঝাল। অপর কানাডিয়ান দোপেয়াঁজা না খেতে পেরে বাইরের দোকান থেকে রুটি ও জ্যাম নিয়ে এলেন। দুপুরে হার্ব উইব সাহেব ভাতের সাথে মুরগী দোপেয়াঁজা অর্ডার দিলেন। রাত্রেও একই অর্ডার। আমি মাফ চেয়ে বললাম, হার্ব, আপনি এত ঝাল খাওয়া শিখলেন কী করে? উত্তর ছিলো, আমি অনেক দিন নোয়াখালীতে ছিলাম। নোয়াখালীতে সবাই মরিচ বেশি খায় কি না জানি না। তবে তারা হয়ত মরিচের মহত্ত্ব সম্পর্কে অবগত আছেন। বলাবাহুল্য ড. আবুল হোসেন সাহেবের বাড়িও নোয়াখালীতে। খুলনা ও যশোহর এলাকায় গরুর মাংস, মরিচ, চুই (এক ধরনের লতানো উদ্ভিদের ডাল এবং বেশ ঝাল), গোল মরিচ ও নারিকেলের দুধসহ রান্না করে, ফলে খুব ঝাল হয়। থাইল্যান্ডে খাবারে বেশ ঝাল থাকে। ব্যাংককে সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের এক রেস্টুরেন্টে মাগুর মাছ খেতে যেয়ে ঝালের চোটে মাছ পানি দিয়ে ধুয়ে নিয়েছিলাম। এফএও ক্যাফেটারিয়ায় গরুর মাংস খেতে যেয়ে চোখ দিয়ে পানি বইতে শুরু করেছিল। জাপানে অনেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে ঝাল তরকারি খেতে পছন্দ করেন। অতিরিক্ত ঝালের তরকারি খাওয়াকে তারা অ্যাড্ভেঞ্চারাস মনে করে। আর বৃটেনে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে তো ভিড় লেগেই থাকে। এ সমস্ত রেস্টুরেন্টের অধিকাংশের মালিক বৃহত্তর সিলেট এলাকাবাসী।
মরিচ থেকে উৎপাদিত তাবাসকো সস্ বিশ্ববিখ্যাত, ১৬০টি দেশে বিক্রি হয়। এর ঝালের মাত্রা ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ এসএইচইউ। আমেরিকার ল্যুসিয়ানাতে প্রতিদিন ৭ লক্ষ বোতল তাবাসকো সস্ তৈরি হয়। সাধারণত প্রতিটি বোতলের ধারণক্ষমতা ৫৭ বা ১৪৮ মিলিলিটার। তাবাসকো সস্ রফতানি করে আমেরিকা বছরে শ' শ' কোটি ডলার উপার্জন করে থাকে। নামটি যদিও মেহিকোর একটি স্টেট-এর নামে। বাংলাদেশেও এই তাবাসকো এখন পাওয়া যায়। নাগা মরিচ থেকে তৈরি নাগা মামা হট চিলি সস্ বৃটেনে বেশ জনপ্রিয়, ১৪০ মিলিলিটারের এক বোতল ৬.৫ পাউন্ড বা সাড়ে ছয়শ' টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বৃটেনে মিচাউড দম্পতি ডরসেট নাগা বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেছেন। নিজেদের খামারে উৎপাদন করে প্রতিবছরে তারা প্রায় ৩ লক্ষ মরিচ বিক্রি করেন। সিলেটে কৃষকেরা নাগা মরিচ উৎপাদন করে প্রতিটি ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করছেন। বাংলাদেশে নাগা মরিচ উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রফতানির সুযোগ আছে ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: মরিচ খেয়ে ঝাল নিবারণে ঠাণ্ডা দুধ অথবা চিনির শরবত সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
সবার দেশ/কেএম