Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ১২ মার্চ ২০২৫

ফলন ভালো কিন্তু দাম কম

আলু বিক্রি নিয়ে বিপাকে কৃষক

আলু বিক্রি নিয়ে বিপাকে কৃষক
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে আলু চাষীরা এ বছর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে চরম বিপদে পড়েছেন। ভালো ফলন হলেও বাজারে আলুর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় চাষীরা নিজেদের খরচ তুলতে পারছেন না। 

ঠাকুরগাঁও, মুন্সিগঞ্জ এবং মেহেরপুরের মতো শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী অঞ্চলের কৃষকরা এ দুঃখজনক পরিস্থিতিতে পড়ে নিজদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

এ বছরে আলুর উৎপাদন ভালো হলেও বাজারে দাম কম থাকার কারণে কৃষকরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। আলু চাষের জন্য খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও বাজারে বিক্রির জন্য যে দাম পাওয়া যাচ্ছে তা তাদের পুঁজি উদ্ধার করতে যথেষ্ট নয়। 

উদাহরণস্বরূপ, ঠাকুরগাঁওয়ের আলু চাষী আহসানুর রহমান হাবিব বলছেন, ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিলো, অথচ তার বদলে এখন আহাজারি করতে হচ্ছে। তিনি জানান, তার ৯০ বিঘা জমিতে আলু চাষে প্রায় ২০ টাকা খরচ হয়েছে প্রতি কেজি, কিন্তু বাজারে এখন প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৩ টাকায়। এর ফলে তাকে ব্যাপক লোকসান গুনতে হচ্ছে। একদিকে ভালো ফলন, অন্যদিকে নিম্ন দামে বিক্রি—এ সংকট কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও আলু চাষীরা অভিযোগ করছেন যে, তাদের খরচ তুলতে পারার জন্য প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই। সঠিক হিমাগারের সংখ্যা কম থাকায় আলু চাষীরা তাদের উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না। মুন্সিগঞ্জ জেলার শফিকুর রহমান জানাচ্ছেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম না ওঠায় আমরা একেবারে ধরা খেয়ে গেছি। মেহেরপুরের সাদ্দাম হোসেনের মত অনেকেই জানান, তারা প্রতি কেজি আলু চাষে ২০ টাকা খরচ করলেও, এখন বাজারে ৮ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এখন সমস্যাটা হচ্ছে যে, কৃষকরা ভালো ফলন পেলেও তা বিক্রি করতে গিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেক সময় ফলন এত বেশি হয়ে যায় যে, সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার কারণে কিছু আলু নষ্ট হয়ে যায়। মুন্সিগঞ্জ জেলার তথ্য অনুযায়ী, আলুর উৎপাদন সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে মাত্র ৫৮টি হিমাগার রয়েছে যেগুলোর ধারণ ক্ষমতা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। ফলে অনেক চাষী বাধ্য হচ্ছেন তাদের আলু দ্রুত বিক্রি করতে, যাতে তা নষ্ট না হয়ে যায়।

এ বছর সরকার আলুর বাজার স্থিতিশীল রাখতে হিমাগারের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করেছে। কিন্তু হিমাগার মালিকরা বলেছেন, তাদের খরচ বেড়ে গেছে, তাই ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর উপায় ছিলো না। ঠাকুরগাঁওয়ের হিমাগার মালিক সালাম হাওলাদার বলছেন, এখন যে টাকাটা চাওয়া হচ্ছে, সেটাই আমাদের সত্যিকারের খরচ। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে এতদিন আমরা নিজেরা লস দিয়ে কম টাকা নিয়েছি। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, বিদ্যুতের খরচ দিতেই তো সাত টাকা চলে যায়। এসব কারণেই হিমাগার ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এদিকে, কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি দেশের অর্থনীতিবিদদের কাছে অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, এটা সরকারের অজানা থাকার কথা না। এরপরও প্রতিবছর একই ঘটনা ঘটছে, যা খুবই দুঃখজনক। তার মতে, কৃষিক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবের কারণেই এ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে বছরে আলুর চাহিদা কতটুকু এবং সেটার বিপরীতে কী পরিমাণ জমিতে আলু চাষ হচ্ছে, সে তথ্য সরকারের কাছে নেই? সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এমন সংকটের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।

এ বছর কৃষকরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংকটের মুখে পড়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাসির-উদ-দৌলা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে আমরা কোল্ড স্টোরেজগুলোর ভাড়া নির্ধারণ করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে, সমস্যাটি পুরোপুরি সমাধান করতে হলে সরকারকে আরো অধিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগে কৃষকদের জন্য কিছু ঘর তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তারা আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন। কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার জানান, ইতোমধ্যেই আমরা প্রাকৃতিকভাবে আলু সংরক্ষণের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। সেখানে অন্তত পাঁচ মাস আলু সংরক্ষণ করা যাবে। এছাড়া, কিছু হিমাগারের নির্মাণও পরিকল্পনা রয়েছে, যার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আলু ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারবেন।

কৃষকদের জন্য সরকারের কিছু উদ্যোগ ইতোমধ্যে সফলতা দেখিয়েছে, যেমন নেপাল, দুবাই এবং মালয়েশিয়ায় আলু রফতানি করা হয়েছে। তবে, হিমাগারগুলোর সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার যদি পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে এ ধরনের সংকট সামাল দেয়া সম্ভব হতে পারে।

এ সংকটের মধ্যে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। কৃষকদের যদি যথাযথ দামের নিশ্চয়তা না দেয়া হয়, তবে তাদের উৎপাদনে আগ্রহ কমে যাবে এবং দেশের কৃষি খাতের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সরকারের উচিত, কৃষকদের সাহায্য করতে প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

সবার দেশ/কেএম