প্রযুক্তির নতুন মাইলফলক
বেইজিং হাফ-ম্যারাথনে মানুষ-রোবটের যুগ্ম দৌড়

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে শনিবার (১৯ এপ্রিল ২০২৫) অনুষ্ঠিত ইয়িঝুয়াং হাফ-ম্যারাথনে প্রথমবারের মতো মানুষের পাশাপাশি মানবিক রোবটরা (হিউম্যানয়েড রোবট) অংশ নিয়ে প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
২১ কিলোমিটারের এ দৌড়ে প্রায় ১২,০০০ মানব দৌড়বিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ২১টি হিউম্যানয়েড রোবট, যারা চীনের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি সংস্থা, গবেষণা কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তৈরি। এ ঐতিহাসিক ইভেন্টটি চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং রোবটিক্স খাতে অগ্রগতির একটি উজ্জ্বল প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ম্যারাথনের বিশেষত্ব
বেইজিং ইকোনমিক-টেকনোলজিকাল ডেভেলপমেন্ট এরিয়া (ই-টাউন) আয়োজিত এ হাফ-ম্যারাথনটি ছিল বিশ্বের প্রথম ইভেন্ট, যেখানে হিউম্যানয়েড রোবটরা মানুষের সঙ্গে একই কোর্সে পূর্ণ ২১ কিলোমিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে বেইজিংয়ের ইয়িঝুয়াং হাফ-ম্যারাথনে ‘তিয়ানগং’ নামের একটি রোবট শেষ ১০০ মিটার দৌড়ে প্রতীকী অংশগ্রহণ করেছিলো। কিন্তু এবারই প্রথম রোবটরা পুরো কোর্সে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দৌড়েছে।
ম্যারাথনটি শুরু হয় নানহাইজি পার্কের দক্ষিণ চত্বর থেকে এবং শেষ হয় তংমিং লেকের কাছে ন্যাশনাল ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাপ্লিকেশন ইনোভেশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। নিরাপত্তার জন্য মানুষ ও রোবটদের আলাদা লেনে দৌড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে ব্যারিয়ার ও গ্রিনবেল্ট ব্যবহার করা হয়।
রোবটদের বৈশিষ্ট্য ও প্রস্তুতি
এ ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারী রোবটগুলো চীনা প্রযুক্তি সংস্থা যেমন DroidUP, Noetix Robotics, এবং Beijing Humanoid Robot Innovation Center-এর তৈরি। এছাড়া সিংহুয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা কেন্দ্রের টিমও অংশ নেয়। রোবটগুলোর উচ্চতা ছিল ০.৫ মিটার (৩.৯ ফুট) থেকে ২ মিটার (৫.৯ ফুট) পর্যন্ত। কিছু রোবট নারীশরীরের আদলে তৈরি, যারা হাসতে এবং চোখের পাতা ফেলতে পারে।
নিয়ম অনুযায়ী, রোবটদের মানুষের মতো দ্বিপদ (বাইপেডাল) হতে হবে, চাকা বা চার পায়ের রোবট অংশ নিতে পারেনি। স্বয়ংক্রিয় এবং রিমোট-চালিত উভয় ধরনের রোবট অংশগ্রহণের অনুমতি পায়। রোবটদের হিপ জয়েন্ট থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য হতে হবে ০.৪৫ মিটার। দৌড়ের মাঝে রোবটদের ব্যাটারি পরিবর্তনের অনুমতি দেয়া হয়, যদিও কোনও রোবট প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ১০ মিনিটের জরিমানা আরোপ করা হতো।
প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এ ম্যারাথনের জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের রোবটদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কিছু রোবটকে জুতো পরানো হয়, কারও হাতে ছিল বক্সিং গ্লাভস, এমনকি একটি রোবটের মাথায় হেডব্যান্ডে চীনা ভাষায় লেখা ছিল ‘জিততেই হবে’। এ প্রস্তুতিগুলো রোবটদের শুধু কার্যক্ষমতাই নয়, বরং দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
ম্যারাথনের ফলাফল ও চ্যালেঞ্জ
ম্যারাথনের রোবট বিভাগে জয়ী হয় Beijing Humanoid Robot Innovation Center-এর তৈরি ‘Tiangong Ultra’, যিনি ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে দৌড় সম্পন্ন করেন। তবে মানব বিভাগের পুরুষ বিজয়ী (ইথিওপিয়ার একজন দৌড়বিদ) মাত্র ১ ঘণ্টা ২ মিনিটে এবং মহিলা বিজয়ী ১ ঘণ্টা ১১ মিনিটে দৌড় শেষ করেন। Tiangong Ultra-এর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা তাং জিয়ান জানান, রোবটটির লম্বা পা এবং মানুষের দৌড়ের অনুকরণে তৈরি অ্যালগরিদম এর সাফল্যে সহায়ক ছিল। তিনি দাবি করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় Tiangong Ultra-এর ক্রীড়াগত অর্জন অতুলনীয়।
তবে সব রোবটের জন্য দৌড়টি সহজ ছিলো না। একটি রোবট শুরুতেই পড়ে যায় এবং কয়েক মিনিট স্থির থাকার পর প্রশিক্ষকের সহায়তায় উঠে দৌড় শুরু করে। আরেকটি রোবট কয়েক মিটার দৌড়ানোর পর রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে, সঙ্গে তার প্রশিক্ষকও পড়েন। কিছু রোবটকে মাঝপথে ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হয়, যেমন Tiangong Ultra-এর ব্যাটারি তিনবার পরিবর্তন করা হয়।
দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ও তাৎপর্য
ম্যারাথনটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে কর্মরত হে সিশু নামে একজন দর্শক বলেন, রোবটগুলো খুব ভালো ও স্থিতিশীলভাবে দৌড়াচ্ছে। আমি যেন রোবট ও এআই-এর বিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছি। আরেক দর্শক হুয়াং শিয়াওইউ তার মেয়ের উৎসাহের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার মেয়ে ভোরে উঠে এ রোবট ম্যারাথন দেখতে চেয়েছিলো। এটি একটি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।
বিশেষজ্ঞরা এ ইভেন্টকে প্রযুক্তি ও সভ্যতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে, ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির রোবটিক্স অধ্যাপক অ্যালান ফার্ন মনে করেন, এ দৌড়গুলো আকর্ষণীয় প্রদর্শনী হলেও এগুলো ব্যবহারিক কাজ বা বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি প্রকাশ করে না।
চীনের প্রযুক্তিগত লক্ষ্য
চীনের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে হিউম্যানয়েড রোবটিক্সকে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার একটি নতুন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে, যেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাপক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জন্মহার হ্রাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীন রোবটিক্সের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ই-টাউন, যেখানে ১৪০টির বেশি রোবটিক্স সংস্থা রয়েছে এবং বার্ষিক প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউয়ানের উৎপাদন হয়, তা চীনের রোবটিক্স শিল্পের একটি প্রধান কেন্দ্র।
এই ম্যারাথন ছিল চীনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রদর্শনের একটি অংশ। আগামী আগস্টে বেইজিংয়ে প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড হিউম্যানয়েড রোবট স্পোর্টস গেমস’ আয়োজিত হবে, যেখানে রোবটরা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, ফুটবলের মতো খেলায় প্রতিযোগিতা করবে।
পুরস্কার ও উদ্দেশ্য
ম্যারাথনে শীর্ষ তিন রোবটের জন্য নগদ পুরস্কার ছিলো, যার মধ্যে প্রথম পুরস্কার ৫,০০০ ইউয়ান (প্রায় ৬৯০ ডলার)। এছাড়া সেরা ধৈর্য, জনপ্রিয়তা, চলনভঙ্গি এবং সৃজনশীল ডিজাইনের জন্য বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়। আয়োজকরা জানান, এ ইভেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিলো রোবটদের বাস্তব পরিবেশে কার্যক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করা, জয়ী হওয়া নয়।
বেইজিংয়ের এ হাফ-ম্যারাথন শুধু একটি ক্রীড়া ইভেন্ট নয়, বরং মানুষ ও প্রযুক্তির সহাবস্থানের একটি প্রতীক। রোবটদের এ অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, হিউম্যানয়েড রোবটরা কেবল শিল্প বা গৃহস্থালির কাজে নয়, বরং ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও অংশ নিতে সক্ষম। এ ইভেন্ট চীনের প্রযুক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যৎ রোবটিক্সের সম্ভাবনার একটি ঝলক দিয়েছে।
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
সবার দেশ/কেএম