বাণিজ্য যুদ্ধে নতুন মোড়
আমেরিকার বোয়িং কেনা বন্ধ করলো চীন

মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে চীন সরকার তাদের বিমান সংস্থাগুলোকে বোয়িং থেকে নতুন বিমান কেনা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি বোয়িংয়ের বিমানের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম কেনার ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বেইজিং।
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম বিমান বাজারগুলোর একটি। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের শীর্ষ তিন বিমান সংস্থা—এয়ার চায়না, চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস এবং চায়না সাদার্ন এয়ারলাইনস—২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে যথাক্রমে ৪৫, ৫৩ এবং ৮১টি বোয়িং বিমান কেনার পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু শি জিনপিং সরকারের নতুন নির্দেশনার ফলে এ পরিকল্পনা বাতিলের পথে। এছাড়া, বোয়িংয়ের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম কেনার ওপর বিধিনিষেধের কারণে চীনে বোয়িংয়ের ব্যবসা কার্যত গুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ পদক্ষেপে বোয়িংয়ের শেয়ার মূল্য প্রাক-বাজার ট্রেডিংয়ে ৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
চীনের এ সিদ্ধান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় বিমান নির্মাতা এয়ারবাস এবং চীনের নিজস্ব কোম্যাক (কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফ্ট করপোরেশন অব চায়না)-এর জন্য সুবিধা বয়ে আনবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। চীনের বাজারে বোয়িংয়ের অবস্থান দুর্বল হওয়ায় এয়ারবাস এবং কোম্যাক তাদের বাজার শেয়ার বাড়াতে পারবে। তবে চীন সরকার বোয়িং বিমান ভাড়া নেয়া এয়ারলাইনসগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা করছে বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ গত কয়েক মাসে তীব্র আকার ধারণ করেছে। ২০২৫ সালের মার্চে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সব ধরনের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ রফতানি শুল্ক আরোপ করেন। এরপর ২ এপ্রিল এ শুল্ক বাড়িয়ে ৩৪ শতাংশ করা হয়। পাল্টা জবাবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে ট্রাম্প ৮ এপ্রিলের মধ্যে শুল্ক প্রত্যাহার না করলে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর হুমকি দেন। এরপর চীন মার্কিন পণ্যের শুল্ক ৮৪ শতাংশে উন্নীত করে। সর্বশেষ, ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশ এবং চীন মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
এ পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের মধ্যে চীন সম্প্রতি আমেরিকায় চুম্বক ও বিরল খনিজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এ খনিজগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি, সেমিকন্ডাক্টর এবং সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে মার্কিন শিল্প খাতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।[]
চীন বোয়িংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী ২০ বছরে বিশ্বের বিমান চাহিদার ২০ শতাংশ আসবে চীন থেকে। ২০১৮ সালে বোয়িংয়ের মোট বিমানের প্রায় ২৫ শতাংশ চীনে সরবরাহ করা হয়েছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য উত্তেজনা এবং ২০১৯ সালে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্সের দুটি দুর্ঘটনার পর চীন বোয়িংয়ের ওপর কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এবারের সিদ্ধান্ত বোয়িংয়ের জন্য আরও বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বোয়িং ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখোমুখি। ২০২৪ সালে একটি ম্যাক্স ৯ জেটের মাঝ-আকাশে দরজার প্যানেল খুলে যাওয়ার ঘটনা প্রতিষ্ঠানটির মান নিয়ন্ত্রণের ওপর প্রশ্ন তুলেছে। এছাড়া শ্রমিক ধর্মঘট এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার সমস্যাও বোয়িংকে চাপে রেখেছে। চীনের বাজার হারানো প্রতিষ্ঠানটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চীনের এ পদক্ষেপকে বাণিজ্য যুদ্ধের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। চীনের নিজস্ব বিমান নির্মাতা কোম্যাকের সি৯১৯ জেটলাইনার বাণিজ্যিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এবং বোয়িংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা কোম্যাকের বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক হবে। এদিকে, এয়ারবাস ইতোমধ্যে চীনের বাজারে প্রভাব বিস্তার করছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এ বাণিজ্য যুদ্ধ শিগগিরই কমার সম্ভাবনা কম। ট্রাম্প এবং জিনপিংয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে উভয় দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, বোয়িংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান এই দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে, যারা সরকারি নীতির ওপর নির্ভরশীল।
চীনের বোয়িং বিমান কেনা বন্ধের নির্দেশ বাণিজ্য যুদ্ধের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি বোয়িংয়ের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হলেও চীনের নিজস্ব বিমান শিল্প এবং এয়ারবাসের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে। পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য বিধিনিষেধের এ দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে থামবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। সূত্র: ব্লুমবার্গ, রয়টার্স
সবার দেশ/এমকেজে