Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

প্রত্যেক ইসরায়েলি সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীর সন্তান

রানি এলিজাবেথের ইসরায়েলবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি

ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন বলেন, রানি এলিজাবেথের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জটিল ছিলো। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক ইসরায়েলি সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীর সন্তান। তিনি আন্তর্জাতিক আয়োজন ছাড়া কোনো ইসরায়েলিকে বাকিংহাম প্যালেসে প্রবেশ করতে দিতেন না।

রানি এলিজাবেথের ইসরায়েলবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি
ফাইল ছবি

প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় রাজত্বকারী রাষ্ট্রনায়কদের একজন, তার ৭০ বছরের শাসনকালে ১২০টিরও বেশি দেশ সফর করেছেন। তবে তিনি কখনো ইসরায়েল সফর করেননি এবং তার শাসনামলে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বাকিংহাম প্যালেসে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। 

ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিনের মতে, রানি প্রত্যেক ইসরায়েলিকে ‘সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীর সন্তান’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। এ বিস্ফোরক মন্তব্য ইসরায়েল-ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কের জটিলতা এবং রানির ইসরায়েলবিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়।

রানির ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান

ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন (২০১৪-২০২১) ২০২৪ সালে লন্ডনে হাইফা টেকনিয়ন ইনস্টিটিউটের শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে বলেন, রানি এলিজাবেথের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কিছুটা জটিল ছিলো। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক ইসরায়েলি সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীর সন্তান। তিনি আন্তর্জাতিক আয়োজন ছাড়া কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে বাকিংহাম প্যালেসে প্রবেশ করতে দিতেন না।

রানির এ মনোভাবের পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪০-এর দশকে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় ইহুদিবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন ইরগুন ও লেহি ব্রিটিশ সেনা ও কর্মকর্তাদের উপর হামলা চালায়। ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে ইরগুনের বোমা হামলায় ৯১ জন নিহত হন, যার মধ্যে ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও ছিলেন। এ ঘটনা ব্রিটিশ রাজপরিবার ও জনগণের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

রানির ইসরায়েল সফর না করার কারণ

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার ৭০ বছরের শাসনকালে ১২০টিরও বেশি দেশ সফর করলেও ইসরায়েলে কখনও যাননি। এটি অনেকের কাছে একটি ‘অঘোষিত বয়কট’ হিসেবে বিবেচিত হয়। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ঐতিহাসিক বৈরিতা: ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় ইহুদিবাদী গোষ্ঠীগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ড ব্রিটিশ রাজপরিবারে ইসরায়েলের প্রতি অসন্তোষ তৈরি করে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের স্বাধীনতার পরও এ মনোভাব অব্যাহত থাকে।
  • কূটনৈতিক বিবেচনা: ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (ফরেন অফিস) ইসরায়েল সফরের বিরোধিতা করতো, কারণ এটি আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারতো। তেল সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ব্রিটেনের জন্য অগ্রাধিকার ছিলো।
  • রানির ব্যক্তিগত অবস্থান: ১৯৮৪ সালে জর্ডান সফরের সময় রানি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উড়তে দেখে এটিকে ‘ভয়ংকর’ বলে বর্ণনা করেন এবং দখলকৃত অঞ্চলের মানচিত্র দেখে ‘হতাশাজনক’ মন্তব্য করেন। এ ঘটনা তার ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়।

তবে হারেৎজ-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক ডেভিড লানডাও ২০১২ সালে লিখেছিলেন, রানি একজন স্বাধীনচেতা শাসক। তিনি যদি ইসরায়েল সফরে যেতে চাইতেন, কেউ তাকে আটকাতে পারতো না। এটি ইঙ্গিত করে যে রানির সফর না করার সিদ্ধান্ত তার নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন হতে পারে।

বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

রিভলিনের মতে, রানি আন্তর্জাতিক আয়োজন ছাড়া বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তবে এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। রানি বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যদিও সেগুলো বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যে বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছিলো:

  • ১৯৭৬ সালে: ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ্রাইম কাটজির উইন্ডসর ক্যাসেলে রানির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন।
  • ২০০৮ সালে: প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেসকে রানি সম্মানসূচক নাইটহুড প্রদান করেন।
  • ১৯৫৯ সালে: ইসরায়েলের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত এলিয়াহু এলাথ উইন্ডসর ক্যাসেলে রানির সঙ্গে রাত্রিভোজে অংশ নেন।

এ সাক্ষাৎগুলো সত্ত্বেও, বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক প্রবেশ সীমিত ছিলো, যা রানির সতর্ক কূটনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।

ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম

রানি এলিজাবেথের বিপরীতে তার পুত্র ও নাতি ইসরায়েলের প্রতি তুলনামূলকভাবে উষ্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন:

  • রাজা তৃতীয় চার্লস: তিনি ১৯৯৫ ও ২০১৬ সালে যথাক্রমে ইটজাক রাবিন ও শিমন পেরেসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এবং ২০২০ সালে অফিসিয়ালি ইসরায়েল সফর করেন। রিভলিন তাকে ‘অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
  • প্রিন্স উইলিয়াম: ২০১৮ সালে তিনি ইসরায়েলের ৭০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রথম রাজকীয় সফর করেন, যা অঘোষিত বয়কটের অবসান ঘটায়।

সম্প্রতিক ব্রিটিশ-ইসরায়েল সম্পর্ক

১৫ এপ্রিল ২০২৫-এ যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড লেমি লন্ডনে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সারের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। এ বৈঠক ব্রিটিশ রাজনীতিতে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে রানির ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। ব্রিটিশ রাজনীতিকদের একাংশ এ বৈঠকের বিরোধিতা করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটেনে এখনও মিশ্র মনোভাব রয়েছে।

রানির মনোভাবের সমালোচনা ও প্রশংসা

রানির ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে:

সমালোচনা: ইসরায়েল ও ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ রানির এ অবস্থানকে ইসরায়েলের বৈধতা অস্বীকারের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু রবার্টস ২০০৯ সালে বলেন, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ইসরায়েলের প্রতি বৈষম্যমূলক।

প্রশংসা: কেউ কেউ, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি অধিকারের সমর্থকরা, রানির এ অবস্থানকে ইসরায়েলের সহিংস উৎপত্তি ও ফিলিস্তিনি দখলের প্রতি প্রতিবাদ হিসেবে দেখেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় রানিকে ফিলিস্তিনি কাফিয়া পরা অবস্থায় চিত্রিত করে তার এ অবস্থানের প্রশংসা করা হয়েছে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ঐতিহাসিক, কূটনৈতিক, এবং ব্যক্তিগত বিষয়ের সমন্বয়। তার শাসনামলে ইসরায়েল সফর না করা এবং বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রবেশে সীমাবদ্ধতা তার নিজস্ব মনোভাব এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতির প্রতিফলন। রিউভেন রিভলিনের মন্তব্য এ জটিল সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা উন্মোচন করেছে, যা ব্রিটিশ-ইসরায়েল সম্পর্কের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তবে রানির পুত্র রাজা তৃতীয় চার্লস ও নাতি প্রিন্স উইলিয়ামের সফর ইঙ্গিত দেয় যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী।

সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর, জেরুজালেম পোস্ট, হারেৎজ, নিউ আরব, টাইমস অব ইসরায়েল।

সবার দেশ/কেএম