ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা: কে কী চায়?

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দফা ‘গঠনমূলক’ আলোচনার পর তৃতীয় দফার জন্য প্রস্তুতি চলছে। প্রথম বৈঠক ওমানের মাসকাটে এবং দ্বিতীয় বৈঠক ১৯ এপ্রিল ২০২৫-এ ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হয়, ওমানের মধ্যস্থতায়।
আগামী বুধবার ওমানে ‘টেকনিক্যাল আলোচনা’ শুরু হবে, যার পর আরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। এ আলোচনায় উভয় পক্ষের লক্ষ্য, টেকনিক্যাল আলোচনার বিষয়বস্তু এবং চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে নিচে বিশ্লেষণ করা হলো।
টেকনিক্যাল আলোচনার বিষয়বস্তু
টেকনিক্যাল আলোচনায় মূলত দুটি বিষয়ে ফোকাস করা হবে:
- নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কাঠামো: ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো জটিল এবং বহু-স্তরবিশিষ্ট। বিশেষজ্ঞরা নিষেধাজ্ঞার প্রতিটি স্তর পর্যালোচনা করবেন এবং এর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে গ্রহণ করা পদক্ষেপ বা নিশ্চয়তার সম্পর্ক স্থাপন করবেন। এর মধ্যে তেল রফতানি, আর্থিক লেনদেন এবং শিল্প খাতের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
- পারমাণবিক কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা: ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা (বর্তমানে ৬০%), মজুতের পরিমাণ (২৭৪.৮ কেজি), এবং সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা ও প্রকার নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) পরিদর্শন ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর (যেমন নাতানজ, ফোর্ডো) তদারকি নিয়েও আলোচনা হবে।
এ আলোচনার তিন দিন পর মাসকাটে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে, যেখানে টেকনিক্যাল আলোচনার ফলাফলের ভিত্তিতে চুক্তির কাঠামো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ইরান কী চায়?
ইরানের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো:
- নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: ইরান চায় তেল রফতানি, আর্থিক লেনদেন এবং শিল্প খাতের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠিয়ে নেয়া হোক। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ফলে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে তেল রফতানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে যায়।
- পারমাণবিক কর্মসূচির বৈধতা: ইরান জোর দিয়ে বলছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং এটি চালিয়ে যাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। তারা ৩.৬৭% সমৃদ্ধকরণ এবং ৩০০ কেজি মজুতের সীমা মেনে চলতে রাজি, তবে সম্পূর্ণ সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করবে না।
- চুক্তির নিশ্চয়তা: ইরান চায় যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি মেনে চলার গ্যারান্টি দেবে, কারণ ২০১৮ সালে ট্রাম্পের চুক্তি থেকে সরে যাওয়া তাদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে।
- অন্যান্য বিষয় বাদ: ইরান পারমাণবিক আলোচনাকে শুধু পারমাণবিক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নয়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ধর্মীয় ফরমানের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করেছেন, তবে তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কেউ থামাতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্র কী চায়?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো:
- পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধ: যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। ট্রাম্প বারবার বলেছেন, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না। এজন্য তারা ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৩.৬৭%-এ সীমাবদ্ধ করতে এবং মজুত ৩০০ কেজির মধ্যে রাখতে চায়, যা JCPOA-এর শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- কঠোর পরিদর্শন ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্র IAEA-এর মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে নিয়মিত এবং স্বচ্ছ পরিদর্শন নিশ্চিত করতে চায়। ২০১৮ সালের পর ইরান IAEA-এর ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়ায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
- ব্রেকআউট সময় বাড়ানো: যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানের ‘ব্রেকআউট সময়’ (অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম তৈরির সময়) এক বছর বা তার বেশি রাখা হোক। বর্তমানে ইরানের ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে এ সময় প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা: যদিও ইরান এটি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং হিজবুল্লাহ, হামাসের মতো প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন কমানোর বিষয়ে চাপ দিতে পারে।
ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, আলোচনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং অস্ত্রায়নের যাচাই-বাছাইয়ের ওপর জোর দেয়া হবে।
চুক্তির সম্ভাবনা
কোনো চুক্তি হবে কিনা, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে কিছু আশাব্যঞ্জক লক্ষণ রয়েছে:
- অগ্রগতির ইঙ্গিত: রোমে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় উভয় পক্ষ কিছু সময় একই কক্ষে ছিলো, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, আমরা কিছু নীতি ও লক্ষ্যে আরও ভালো বোঝাপড়ায় পৌঁছেছি। তিনি আশাবাদী, তবে সতর্কতার কথাও বলেছেন।
- পারস্পরিক স্বার্থ: ইরান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চায়, আর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমাতে চায়। এ পারস্পরিক স্বার্থ একটি চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।
- ওমানের মধ্যস্থতা: ওমানের কূটনৈতিক ভূমিকা (JCPOA-এর সময়ও তারা মধ্যস্থতা করেছিলো) আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে রয়েছে চ্যালেঞ্জও:
- অবিশ্বাস: ২০১৮ সালে ট্রাম্পের JCPOA থেকে সরে যাওয়া ইরানের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ইরান চায় যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি মেনে চলার গ্যারান্টি দেবে।
- ইসরায়েলের চাপ: ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে হুমকি হিসেবে দেখে এবং সম্পূর্ণ বন্ধের দাবি জানায়, যা আলোচনাকে জটিল করে তুলতে পারে।
- সময়ের চাপ: ইউরোপীয় দেশগুলো (ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানি) জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবে, JCPOA-এর ‘স্ন্যাপব্যাক’ নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করবে কিনা। এটি আলোচনার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
সম্ভাব্য চুক্তির কাঠামো
- একটি সম্ভাব্য চুক্তি হতে পারে JCPOA-এর আদলে, তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু সমন্বয় সহ:
- ইরান ৩.৬৭% সমৃদ্ধকরণ এবং ৩০০ কেজি মজুতের সীমা মেনে চলবে।
- IAEA-এর কঠোর পরিদর্শন ব্যবস্থা পুনরায় চালু হবে।
- যুক্তরাষ্ট্র তেল এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে।
- চুক্তির দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে একটি যাচাই প্রক্রিয়া থাকবে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজেকে একজন ‘চুক্তি সম্পাদনকারী’ হিসেবে দেখেন এবং একটি নতুন চুক্তিকে তার কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চাইতে পারেন, এমনকি তা JCPOA-এর মতো হলেও।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় ইরান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার চায়, আর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি দূর করতে সমৃদ্ধকরণ সীমিত এবং কঠোর পরিদর্শন চায়। টেকনিক্যাল আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কাঠামো এবং পারমাণবিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত হবে। ওমানের মধ্যস্থতা, পারস্পরিক স্বার্থ এবং অগ্রগতির ইঙ্গিত চুক্তির সম্ভাবনাকে বাড়িয়েছে, তবে অবিশ্বাস, ইসরায়েলের চাপ এবং সময়ের সীমাবদ্ধতা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। আগামী বৈঠকগুলো এ আলোচনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
সবার দেশ/কেএম