নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন
পাকিস্তানে হামলার সামরিক প্রস্তুতি ভারতের
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি উত্তেজনা বাড়ানোর পথ বেছে নিলে পাকিস্তান তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধ এবং ভারতের আগ্রাসনের জবাব পুলওয়ামার মতো শক্তভাবে দেয়া হবে।

কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল ২০২৫-এ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে (২৭ এপ্রিল ২০২৫) বলা হয়, ভারত উত্তেজনা প্রশমনের পরিবর্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রতিবেদনের মূল বিষয়:
ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা: হামলার পরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ডজনের বেশি বিশ্বনেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। নয়াদিল্লিতে ১০০টির বেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছে। চার কূটনীতিক সূত্র জানায়, এসব পদক্ষেপ উত্তেজনা কমানোর জন্য নয়, বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহের লক্ষ্যে।
- মোদির হুঁশিয়ারি: মোদি এক ভাষণে সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস ও কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও পাকিস্তানের নাম সরাসরি উল্লেখ করেননি। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে।
- কাশ্মীরে অভিযান: ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে, শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে তল্লাশি চালাচ্ছে। পুলিশ তিনজন সন্দেহভাজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে, যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক বলে দাবি করা হয়।
- ভারতের পদক্ষেপ: ভারত সিন্ধু পানিবন্টন চুক্তি (১৯৬০) স্থগিত, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল, আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ, এবং পাকিস্তানি দূতাবাসের কিছু কর্মীকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে।
- পাকিস্তানের পাল্টা জবাব: পাকিস্তান ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য স্থগিত, এবং শিমলা চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। তারা পানিপ্রবাহ বন্ধকে ‘যুদ্ধের কাজ’ হিসেবে বিবেচনা করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
- পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি: পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি উত্তেজনা বাড়ানোর পথ বেছে নেয়া হয়, তবে পাকিস্তান তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবে। রোববার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধ এবং ভারতের যেকোনও আগ্রাসনের জবাব পুলওয়ামার মতো শক্তভাবে দেয়া হবে।
হামলার প্রেক্ষাপট:
- ২২ এপ্রিল পেহেলগামের বাইসারান উপত্যকায় হামলায় ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি পর্যটক নিহত হন। এটি গত দুই দশকে কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা।
- হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে একটি অপরিচিত গোষ্ঠী, যাকে ভারত পাকিস্তান-সমর্থিত লস্কর-ই-তৈয়বার প্রক্সি হিসেবে বিবেচনা করে।
- পাকিস্তান হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে এটিকে ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলে দাবি করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন <<>> মোদিকে তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবো: খাজা আসিফ
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
- জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান ও সৌদি আরব উভয় দেশকে সংযম দেখাতে বলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।
- যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অস্পষ্ট। ট্রাম্প প্রশাসন এখনো ভারতে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি, যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি তাদের অগ্রাধিকার কম থাকার ইঙ্গিত দেয়। ট্রাম্প বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই উত্তেজনা সমাধান করবে।
- মার্কিন হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি নিউইয়র্ক টাইমসের ‘মিলিট্যান্ট/’ শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা করে এটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলেছে
বিশ্লেষণ ও ঝুঁকি:
- নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির কারণে আন্তর্জাতিক চাপের প্রভাব কম। ফলে ভারত একতরফা সামরিক পদক্ষেপে পিছপা নাও হতে পারে।
- বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০১৬ (উরি হামলা) ও ২০১৯ (পুলওয়ামা হামলা)-এর মতো ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বিমান হামলা চালাতে পারে।
- পাকিস্তান পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে, যা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্লেষক ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, উভয় পক্ষই নিজেদের ক্ষমতা অতিরঞ্জিত করছে, যা বিপজ্জনক।
- দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর, যা যেকোনও সংঘাতকে বিশ্বব্যাপী হুমকিতে রূপান্তর করতে পারে। বিশ্লেষক স্রিনাথ রাঘবন বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র সংযমের কারণ হলেও, ভুল হিসাব বা অপরিকল্পিত প্রতিক্রিয়া সংঘাতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সামাজিক প্রভাব:
- ভারতে মুসলিম-বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। কাশ্মিরি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শহরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অনেকে বাড়ি ফিরছেন।
- ভারতীয় গণমাধ্যম ও বিজেপি নেতারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার দাবি তুলেছেন, যা মোদির ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে।
প্রমাণের অভাব:
ভারত হামলার জন্য কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করেনি এবং পাকিস্তানের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রকাশ করেনি। কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের অতীতের সন্ত্রাসবাদ-সমর্থনের ইতিহাস এবং কিছু প্রযুক্তিগত প্রমাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া:
- এক্স-এ পোস্টগুলোতে দেখা যায়, ভারতীয়রা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি তুলছেন, যেমন সীমান্ত বন্ধ ও চুক্তি বাতিল।
- পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এবং ভারতীয় হামলার জবাব দেবে। কেউ কেউ বলছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের পক্ষে নয়।
বিশ্লেষকদের সতর্কতা:
- এক কূটনীতিক প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু অতীতের রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে পরমাণু অস্ত্রধারী প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা কি উচিত?
- ভারতের সামরিক সক্ষমতা আধুনিকীকরণের পরেও পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশ্লেষক রাজেশ রাজাগোপালন বলেন, ভারতের বায়ুসেনার সক্ষমতা দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
সবার দেশ/কেএম