Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

পেহেলগাম হামলার জের

কাশ্মীরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বাড়িঘর

কাশ্মীরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বাড়িঘর
ছবি: সংগৃহীত

ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল ২০২৫-এ ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনার পর সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করছে প্রশাসন। এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা সতর্কতা জারি করেছেন, সতর্ক করে বলেছেন যে এটি নিরপরাধ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিতে বিপরীত ফল আনতে পারে।

বুলডোজার নীতি ও প্রভাব:

  • পেহেলগাম হামলার পর জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসীদের সন্ধানে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে কুপওয়ারা, শ্রীনগর, পুলওয়ামা, বারামুল্লা, এবং অন্যান্য এলাকায় ডজনখানেক বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণও ব্যবহৃত হয়েছে।
  • ভেঙে দেওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে হামলায় জড়িত সন্দেহভাজনদের স্কেচে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পরিবারের বাড়ি এবং পলাতক উগ্রপন্থিদের পৈতৃক সম্পত্তি। উদাহরণস্বরূপ, কুপওয়ারার কালারুস এলাকার ফারুক আহমেদ টেডওয়ার বাড়ি ধ্বংস করা হয়। পুলিশের দাবি, ফারুক ১৯৯০ সাল থেকে পাকিস্তানে পলাতক। তবে তার পরিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছে, ফারুকের কোনো খোঁজ নেই, আমাদের অপরাধ কী? আমরা এখন কোথায় যাবো?
  • এ ধ্বংসযজ্ঞের ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা কাশ্মীর উপত্যকায় ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

রাজনৈতিক নেতাদের সতর্কতা:

  • মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ (ন্যাশনাল কনফারেন্স): তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন, তবে ভুল পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, পেহেলগাম হামলার পর কাশ্মীরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এ জনসমর্থনকে কাজে লাগাতে হবে এবং নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি এড়াতে হবে। তিনি বলেন, ভুল পদক্ষেপে মানুষ বিচ্ছিন্ন হবে, যা জঙ্গিদেরই সুবিধা দেবে।
  • মেহবুবা মুফতি (পিডিপি): তিনি এক্স-এ লিখেছেন, সরকারকে সন্ত্রাসী ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। তিনি বলেন, নিরপরাধ মানুষের ক্ষোভ জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে।
  • সাজ্জাদ লোন (পিপলস কনফারেন্স): তিনি বলেন, বাড়ি ভাঙার মতো সমষ্টিগত শাস্তি কাশ্মীরিদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ায়। এটি সন্ত্রাসবাদ দমনের পরিবর্তে আরও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করবে।
  • মিরওয়াইজ উমর ফারুক (হুরিয়ৎ কনফারেন্স): তিনি বলেন, এই ধরনের পদক্ষেপ কাশ্মীরি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসের ঘাটতি বাড়ায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশাসনের অবস্থান:

  • জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে, ধ্বংস করা বাড়িগুলো সন্ত্রাসীদের আস্তানা বা তাদের পরিবারের সম্পত্তি, যা জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা বলছে, এ পদক্ষেপ জঙ্গিদের আর্থিক ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ক ভাঙার জন্য জরুরি।
  • তবে, জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বা স্থানীয় সরকারের এ সিদ্ধান্তে কোনও ভূমিকা নেই। নিরাপত্তা বৈঠকগুলোতেও মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দেয়া হয়েছে।

অভিযানের পরিসংখ্যান:

  • পেহেলগাম হামলার পর ৫০০টির বেশি এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়েছে।
  • ১,০০০-এর বেশি ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
  • ১২টির বেশি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব:

  • বাড়ি ভাঙার ঘটনা কাশ্মীরে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রশ্ন তুলছে, তাদের অপরাধ কী এবং তারা এখন কোথায় যাবে?
  • সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়ি ধ্বংসের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। একটি এক্স পোস্টে দাবি করা হয়েছে, কাশ্মীরে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তবে এ পোস্টের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
  • রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক করেছে যে, এ পদক্ষেপ কাশ্মীরি জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস বাড়াবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করবে।

আইনি ও মানবাধিকার প্রশ্ন:

  • মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বাড়ি ধ্বংসকে ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ হিসেবে সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন এবং নিরপরাধ পরিবারের জীবন ধ্বংস করছে।
  • ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বুলডোজার নীতির বিরুদ্ধে মামলা চলছে। আদালত এর আগে বলেছে, সম্পত্তি ধ্বংসের আগে নোটিশ ও শুনানি প্রয়োজন। তবে কাশ্মীরে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

পেহেলগাম হামলার দায় স্বীকার করেছে কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে একটি অপরিচিত গোষ্ঠী। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে পাকিস্তান-সমর্থিত লস্কর-ই-তৈয়বার প্রক্সি হিসেবে বিবেচনা করে। পুলিশ তিনজন সন্দেহভাজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক বলে দাবি করা হয়। তবে হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রকাশ করা হয়নি। কাশ্মীরে এ বাড়ি ধ্বংসের নীতি বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে। তবে কাশ্মীরে এটি প্রথমবার ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

পেহেলগাম হামলার পর জম্মু-কাশ্মীরে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা কাশ্মীরি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা সতর্ক করেছেন যে, নিরপরাধ মানুষের শাস্তি সন্ত্রাসবাদ দমনের পরিবর্তে বিপরীত ফল আনতে পারে। প্রশাসনের এ পদক্ষেপ আইনি ও মানবাধিকার প্রশ্ন তুলেছে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এসেছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে সমষ্টিগত শাস্তি কাশ্মীরের শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আল জাজিরা, দ্য হিন্দু, রয়টার্স

সবার দেশ/কেএম