Advertisement

সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:১৭, ১ জানুয়ারি ২০২৫

বিদায় ২০২৪ সাল 

যে বছর জুলাই ছিল ‘৩৬ দিনের’

আন্দোলনে রক্তপাত শুরু হওয়ার ২০ দিনের মধ্যেই লাশ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় দেড় দশকের দখলদার আওয়ামী লীগ সরকারের। ভারতে বিতাড়িত হন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা।

যে বছর জুলাই ছিল ‘৩৬ দিনের’
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বছরের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা গড়িয়েছে সরকার উৎখাতের মধ্য দিয়ে।

৩৬ দিনের সে আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন প্রায় একটানা ১৬ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালিয়ে আসা শেখ হাসিনা।

শুরুতে এ আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, কোটার বিষয়টি সমাধান হবে আদালতে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?

সে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে পঙ্গপালের মত রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। তাদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করতে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও ছুটে এস তাদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়।

আন্দোলন দমাতে আলোচনার কোন পথে না গিয়ে সরাসরি গুলি, ডিবি অফিসে ধরে এনে নির্যাতনের মতো পথগুলো বেছে নেয় তৎকালীন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। একদিকে রক্ত ঝরতে থাকে রাজপথে, মৃত্যু আর আহতের ভিড় বাড়তে থাকে হাসপাতালগুলোতে। সে সঙ্গে বড় হতে থাকে আন্দোলনের জমায়েতও।

সরকারের তরফ থেকে জবাব ছিল- ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, গুন্ডালীগ, হেলমেটলীগ, গুলি, টিয়ারশেল আর লাঠি। এককথায় কেবলই বলপ্রয়োগ। প্রথমে ফেইসবুক, পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিলো সরকার। এতে গুন্ডা সরকারের সব ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়।

আন্দোলনে রক্তপাত শুরু হওয়ার ২০ দিনের মধ্যেই লাশ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। পালাতে বাধ্য হন দানব শেখ হাসিনা আর তার কুখ্যাত সহযোগীরা।

ভারতে বিতাড়িত শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ আগষ্ট দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু গণভবনের পাশাপাশি সারাদেশের থানা, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ফ্যাসিজমের আইকন মেখ মুজিব ও হাসিনার শত শত মূর্তি, ছবি, ব্যানার ছাত্র-জনতা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়, ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশ তিনদিন ছিলো সরকারবিহীন। প্রায় একমাস পুলিশবিহীন। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের পলাতক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় তাদের সরকারের পতন হলে প্রথম রাতেই তাদের পাঁচ লক্ষ নেতাকর্মীকে মেরে ফেলা হবে বলে জানিয়েছিলেন। অথচ ৩ দিন সরকার বিহীন, ৩০ দিন পুলিশ বিহীনি একটি রাষ্ট্রে ৫ জন লোকও বিনা বিচারে মারা যায়নি।

৮ আগষ্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথ নেয়ার পরবর্তী মাসখানেক ছিল নানা বিশৃঙ্খলায় ভরা। পতিত সরকারের অনুসারীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চারিদিকে অরাজকাতাকে উস্কে দেয়। রাতভর ডাকাত আতঙ্ক, পাড়ায়-মহল্লায় বাসিন্দাদের পাহারা, নানা পক্ষের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলন-বিক্ষোভের প্রচন্ড চাপে পড়ে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। যদিও সরকার ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দুষ্কৃতকারীদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের খসড়া তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলনে ২ হাজার ছাত্র-জনতা নিহত এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। অন্দত্ব বরণ করেছেন প্রায় দেড় হাজার।

কোটা সংস্কার পর্ব

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ছিল। তবে এর হার ও ধরন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।

২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল।

ওই বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল রেখে জারি করা হয় পরিপত্র।

ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।

গত ৫ জুন সে আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।

ওইদিনই রায় প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। এরপর ৯ জুন হাই কোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ জুন পরবর্তী ৬১ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিন দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন হলেও ১৫ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রদের আন্দোলন ছিলো অহিংস। তারা রাস্তা অবরোধ করলেও গাড়ির একটি গ্লাশও ভাঙ্গেনি। গাছের একটি পাতাও ছেড়েনি।

ওবায়েদুল কাদের আর সেসময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সরাসরি নির্দেশে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও।

১ জুলাই: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভ হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

৭ জুলাই: সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করা হয়। ব্যাপক বিক্ষোভ-অবরোধে অচল হয়ে যায় রাজধানী। পরের দিনও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।

৯ জুলাই: সারাদেশে সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সকাল-সন্ধ্যা ব্লকেড অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা বহাল রেখে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আইনজীবীর মাধ্যমে পক্ষভুক্ত হন দুই শিক্ষার্থী।

১০ জুলাই: কোটা পুনর্বহাল করে হাই কোর্টের আদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা, ৭ অগাস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ।

সংবাদ সম্মেলন এবং অতঃপর

১৪ জুলাই: কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ। ওইদিন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে হাসিনার পোষ্য এক সাংবাদিকের জবাবে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ক্ষোভ আরও উসকে দেয়। এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে? তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কোটার সমাধান দেবে আদালত, অশান্তি হলে আইন চলবে নিজের গতিতে।

ওইদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মিছিল বের হয়। ছাত্র-ছাদ্ররীরা হল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

১৫ জুলাই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকরা। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ। দেয়ালে দেয়ালে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়। শুরু হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের কাউন্টডাউন।

১৬ জুলাই: আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের। সড়ক অবরোধ, সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং ছয়জনের প্রাণহানি। তাদের মধ্যে একজন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ প্রাণ হারান পুলিশের গুলিতে। দুই হাত প্রসারিত করে রাখা আবু সাঈদকে গুলি করার ঘটনা ভিডিওটি মানুষের মনে ক্ষোভ সঞ্চার করে।

পরে সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের ঘোষণা আসে। ওই রাতেই ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দিয়ে কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।

১৭ জুলাই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী; উচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি। জোরপূর্বক দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের হল ত্যাগে বাধ্য করে সরকার। 

রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘাতের সূত্রপাত হয়, পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে; নিহত হন এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ওই রাতেই বন্ধ করে দেয়া হয় ফেইসবুক।

১৮ জুলাই: সারা দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা দখল নেয় রাজপথ। তাদের সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। সাথে যোগ দেয় অনেক অবিভাবক। বিভিন্ন পেশাজিবী। মূলত ঐ দিন থেকেই আন্দোলন নতুন ডায়মেনশন পেতে থাকে। 

আন্দোলনে সহিংসতা অব্যাহত। মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে।

পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন হতাহত হন। ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব করে আওয়ামীলীগ।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাত ৯টা থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

১৯ জুলাই: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, পরিস্থিতি থমথমে। মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা। রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি। ঐদিন সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হন।

প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া’, দুই মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি দিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন আন্দোলনকারীদের তিন নেতা। সেখানে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম।

বৈঠকে সরকারের তরফে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপস্থিত ছিলেন।

২০ জুলাই: কারফিউয়ের মধ্যেও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত চলে। বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন।

আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়কারীর বৈঠক হয় ঐদিন। আন্দোলনকারীরা আট দফা দাবি পেশ করেন। এ বৈঠক নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদের খবর চাউড় করে ষড়যন্ত্রকারী সরকার। সহিংসতায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ২৬ জন নিহত হন।

২১ জুলাই: আপিল বিভাগের শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাই কোর্টের রায় বাতিল করা হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ করার আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে সরকার চাইলে বদলানোর সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু পুলিশ ও ছাত্রলীগের গুন্ডাদের গুলিতে শতাধিক আন্দোলনকারী ততদিনে মারা যাওয়ার পর আন্দোলন গড়াতে থাকে এক দফার দিকে।  

রায়ের পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় কারফিউ অব্যাহত থাকে, সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়।

২২ জুলাই: কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময়ের মধ্যে তারা চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেন।

সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা আসে। কারফিউও বাড়ানো হয় এদিন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় চার দিনে অন্তত ১৩১ জনের নিহত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের খবর আসে। যদিও এ হতাহতের সংখ্যা কয়েকগুন বেশি।

২৩ জুলাই: রাতে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা ফেরে। পরদিন রাতে সারা দেশে বাসাবাড়িতেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সচল হয়।

২৪ জুলাই: নির্বাহী আদেশে তিনদিন সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে। কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানোয় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অফিস কার্যক্রম চলে।

২৬ জুলাই: আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যান শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল স্টেশন, বিটিভি ভবনে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তার কান্না মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। শেখ হাসিনা নিহত ছাত্রদের পরিবারকে সমবেদনা জানাননি এবং আহতদেরও হাসপাতালে দেখতে জাননি। গিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থ মেট্রোরেল ও বিটিভি ভবন দেখতে।

পুলিশের গুলিতে শত শত মানুষের হতাহত হওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ না করে শেখ হাসিনা ওখানে গিয়ে কেঁদেছেন, তার এ ভূমিকাকে ‘নাটক’ আখ্যা দেন অনেকে। কান্নারত শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে বানানো মিম ছড়িয়ে পড়ে, যার ক্যাপশন ছিল ‘নাটক কম কর পিও’।

ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বলেন, তাদের আটক করা হয়নি। নিরাপত্তার জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

২৭ জুলাই: প্রধানমন্ত্রী আহতদের দেখতে যাননি- এমন সমালোচনার মুখে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান শেখ হাসিনা। বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করতে এ ধ্বংসযজ্ঞ।

২৮ জুলাই: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ নিহতদের একটি অংশের পরিবারের সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা। পরে জানা যায়, চাপের মুখে তাদের গণভবনে নিয়ে আসা হয়। আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালেও যান তৎকালীন সরকারপ্রধান।

আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৪৭ মৃত্যুর তথ্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। যদিও তখনকার সংবাদমাধ্যমের হিসাবে সংখ্যাটি দুই শতাধিক। ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট ফেরে। তখনও বেশিরভাগ গণমাধ্যম সরকারকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে হতাহতের সংখ্যা গণমাধ্যমে প্রতাশিত সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশি। 

২৯ জুলাই: জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে ঐকমত্য হয় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়।

৩০ জুলাই: কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালন করা হয়। সে কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ফেইসবুক প্রোফাইল লাল করার এবং চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সমগ্র দেশ ছাত্রদের সে আহবানে সাড়া দিয়ে সবাই নিজ নিজ ফেইসবুক প্রোফাইল লাল করে এবং চোখে কাপড় বেঁধে পোস্ট দেয়।

৩১ জুলাই: আন্দোলনে হত্যার বিচার দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিসি’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত হয়। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঘিরে ধস্তাধস্তি হয়।

সুষ্ঠু তদন্তে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথ্যানুসন্ধান দল পাঠানোর আগ্রহ দেখায় জাতিসংঘও।

১ আগস্ট: ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ক। নিহতদের স্মরণে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ শিরোনামে কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যেও কুমিল্লা, নারায়াণগঞ্জ ও বরিশালে সংঘাত আর রক্তপাত হয়।

কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার।

২ আগস্ট: গণমিছিলে হামলা সংঘর্ষ হয়, পুলিশসহ ২ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়।

৩ আগস্ট: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল জমায়েত থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি আসে। 

সেদিন লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অবিভাবক এবং সাধারণ জনতাও রাস্তায় নেমে আসে। সবাই জমায়েত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। টিএসসি, শাহবাগসহ ঢাকার প্রায় সব জায়গা থেকে টেনে নামানো হয় সরকারী দলের সব ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড। মূলত ওইদিনই ফ্যাসিস্টের পতন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। সরকারী দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের কাউকেই রাজপথে খুজেঁ পাওয়া যায়নি সেদিন।

ঢাকার পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও অন্তত ১১ জেলায় হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অন্তত একজনের প্রাণহানি হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে পদত্যাগ করবেন তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর ‘অরাজনৈতিক নেই’। হামলা হলে আত্মরক্ষায় তার ‘জবাব’ দেয়া হবে।

৪ আগস্ট: অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সারাদেশে ব্যাপক সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৯ নেতাকর্মী ছিলেন।

শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে পরদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেশব্যাপী কারফিউ বলবত থাকে সেদিন। প্রথমে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগষ্ট ঘোষণা করলেও ৪ আগষ্ট রাতে এ সিদ্ধান্ত পাল্টে তা ১ দিন এগিয়ে ৫ আগষ্ট করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সকলকে নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা হচ্ছে। জঙ্গি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

‘৩৬ জুলাই’
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিনও চোটপাট দেখিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নিচের পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ঘুণাক্ষরেও ধারণা পাননি যে তাদের পতন আসন্ন।

৫ অগাস্ট সকালেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা ও গুলি চালায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সেদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকামুখী হন লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা। সকাল ১০টার পর থেকেই উত্তরা ও যাত্রাবাড়ি দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে লক্ষ লক্ষ মানুষ।

দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পতনের কথা শোনা যায়। পদত্যাগ করে সামরিক বিমানে ভারতে পালিয়ে যান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলদার শেখ হাসিনা। দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে বলে জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

ঢাকার পথে পথে সেদিন আনন্দ মিছিল চলে। জনতা গণভবনের দখল নেয়।

বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু থানা থেকে তখনও জনতার বিরুদ্ধে হামলা হয়। বিজয় মিছিলেও কয়েক ডজন আন্দোলনকারীকে গুলি করে মারা হয়। মৃত-অর্ধমৃত কয়েকজনকে ভ্যানে উঠিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়।

এরই মধ্যে চলে পথে পথে মানুষের উচ্ছ্বাস। আনন্দ মিছিল ছিল ঢাকা জুড়ে। সমস্ত দেশ জুড়ে। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। পরে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দ্রুত সম্ভব গঠন করা হবে।

ছাত্ররা বলেছিল, জুলাই মাসেই শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করবে তারা। ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে তারা নতুন হিসাব শুরু করে জুলাই মাসের। সে হিসাবে ৫ অগাস্ট ছিল তাদের হিসাবে ‘৩৬ জুলাই’।

সবার দেশ/এ্রওয়াই