ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়া বাড়ির বয়স্কদের যত্ন নেবেন কীভাবে, জানুন
শীতে অসুস্থ বয়স্কদের যত্ন নেবেন কীভাবে?
ঋতুবদলের সময়টাতে বয়স্ক মানুষদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বাতের ব্যথা বাড়ে। হাঁপানি বা সিওপিডি-র সমস্যা আছে যাদের, তারা খুব কষ্ট পান এ সময়টাতে। এই সময়ে কীভাবে যত্ন নেবেন তাদের?
বেশ কিছুদিন হলো ঠান্ডা পড়েছে। তাপমাত্রার পারদ নামছে ধীরে ধীরে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন প্রবীণেরা। ঋতুবদলের সময়টাতে বয়স্ক মানুষদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বাতের ব্যথা বাড়ে। হাঁপানি বা সিওপিডি-র সমস্যা আছে যাদের, তারা খুব কষ্ট পান এ সময়টাতে।
ঠান্ডায় রক্তচাপেরও হেরফের হয়। হার্টের রোগ থাকলে তাই খুব সাবধানে থাকতে হয়। শীতকালে বয়স্কদের সুস্থ থাকা ভীষণ জরুরি। সে জন্য কী কী নিয়ম মানতে হবে তা জেনে রাখা প্রয়োজন।
ভোরে প্রাতর্ভ্রমণ নয়
খুব সকালে হাঁটতে না বেরনোই ভাল। তা হলে চট করে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয় থাকবে। তবে ৭টার পর থেকে হাঁটতে গেলে ভাল হয়। আবার বিকেল ৩ টার পরে হাঁটতে নিয়ে যান বয়স্কদের। সন্ধ্যা সময়ে আবার বাইরে বেশি না থাকাই ভালো। যখনই বাইরে বেরোবেন বয়স্করা মাস্ক যেন সবসময়ে সঙ্গে থাকে। শীতের সময়ে দূষণের মাত্রা বাড়ে। তাই মাস্ক পরে থাকা খুব জরুরি।
শীতের রোদ খুব জরুরি
সকালে বা বিকেলে যখনই বাইরে বেরোবেন প্রবীণেরা, খেয়াল রাখবেন গায়ে যেন গরম জামাকাপড় থাকে। বিশেষ করে টুপি ও মাফলার খুবই জরুরি। পায়ে মোজা থাকলে ভাল হয়। শীতের মিঠে রোদ গায়ে লাগানো খুবই ভাল। এতে ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে। শীতের দুপুরে রোদে বেশ কিছুক্ষণ থাকতে পারলে গায়ে হাত-পায়ের ব্যথাবেদনাও অনেক কমবে।
শীতের ডায়েট
প্রথমত, মনে রাখতে হবে একবারে বেশি ভারী খাবার না খেয়ে, বারে বারে অল্প অল্প করে খেতে হবে। শীতে নানা রকম সব্জি পাওয়া যায় বাজারে। এ সময়টাতে সবুজ শাকসব্জি বেশি করে খেতে হবে। এক থেকে দুই কাপ ভাত (শরীর বুঝে), এক বাটি ডাল, এক বাটি সব্জি অল্প তেলে রান্না করা, মাছ, মাংস অথবা ডিম রোজের ডায়েটে রাখলে ভল হয়। মাংস খেলে সব্জি দিয়ে স্ট্যু বানিয়ে খাওয়াই ভাল। তেল যতটা সম্ভব কম খাওয়া যায়, ততই ভাল। খাবার পাতে কাঁচা নুন একদমই চলবে না। রান্নায় চিনির মাত্রা কমাতে হবে। খাওয়ার পরে টক দই খেতে পারেন। দুপুরের খাবারের এক ঘণ্টা পরে মুসাম্বি বা লেবু জাতীয় ফল খেলে ভাল হয়। রোজকার খাদ্যতালিকায় ড্রাই ফ্রুটস রাখা যেতে পারে, একটা খেজুর, দু’টি করে আখরোট, কাঠবাদাম, চিনেবাদাম, কিসমিস খাওয়া যেতে পারে।
রক্তচাপ মেপে রাখুন
ঋতু পরিবর্তনে রক্তচাপের মাত্রাও পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মে যেমন রক্তচাপের মাত্রা উপরের দিকে থাকে, শীতে আবার তা কম থাকে। শীতকালে যে হেতু তাপমাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই কম থাকে, ফলে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে পড়ে। তাই সারা বছর তো বটেই, বিশেষ করে শীতকালে বয়স্কদের রক্তচাপ নিয়মিত মাপা উচিত।
নিয়মিত ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম বয়স্ক মানুষদের শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করে। কার জন্য কোন ব্যায়াম উপযুক্ত জেনে নিন। বয়স্কদের যদি একাধিক ওষুধ খেতে হয়, তবে তাদের ওষুধ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সেগুলি সঠিক ভাবে খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। শ্বাসের সমস্যা থাকলে, শীতে তা বাড়তে পারে। তাই হাতের কাছে ইনহেলার অবশ্যই রাখবেন।
ত্বকের যত্ন
শীতকালে বয়ষ্কদের ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। ত্বকের যত্নে জেলি, সরিষারর তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ত্বক বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ নিতে হবে।
গোসল করানো
গোসল করার ফলে চর্মরোগ বা ত্বকের সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। শীতকালে বয়স্কদের সপ্তাহে ২-৩ বার গোসল করানো উচিত। প্রয়োজন হলে গোসলের পানি কুমুস গরম করে নেয়া যেতে পারে। এবং প্রতিদিন ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সবুজ শাকসবজি
শাকসবজির উপকারিতা বহুগুণ। আমাদের দেশে শীতকালে বিভিন্ন রঙের শাকসবজি পাওয়া যায়। যেমন গাজর, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি। এগুলো প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রাখতে হবে। যা শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব পূরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পুষ্টিকর খাদ্য
যেহেতু বসয় ভেদে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই বয়স্কদের জন্য আলাদা একটি সুষম খাবারের তালিকা তৈরি করতে হবে। এবং তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এতে শরীরে শক্তি জোগাবে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যাবে।
ভিটামিন ডি এর অভাব দূর
ভিটামিন ডি এর প্রধাণ উৎস হলো সূর্য। ভিটামিনের অভাব হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে করে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হওয়া বেড়ে যায়। তাই ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণের জন্য সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ১০-২০ মিনিট রোদ শরীরে লাগানো যেতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম
শীতকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো উচিত। যারা বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছে তাদের প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে ঠান্ডা কাশি থেকে রেহায় পাওয়া যায়।
ধূমপান ত্যাগ
অনেক বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছে যারা মদ্যপান, ধূমপান বা অতিরিক্ত চা কফি পান করে থাকেন। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দেয়। তাই এই ধরনের অভ্যাস থেকে বিরত রাখতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন
বয়স্ক ব্যাক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় অনেক বয়স্ক ব্যাক্তিরা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাই পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে হবে। তাদেরকে যথাসম্ভব আনন্দে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আর্দ্রতা বজায় রাখা
শীতকালে নিজেকে আর্দ্র রাখতে হবে। শরীরের আর্দ্রতা হারালে রোগ বাসা বাধতে পারে। এজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। যেহেতু বয়স্ক ব্যাক্তিদের শরীরে এমনিতেই শুষ্ক থাকে তাই পানি খাওয়ার কথা ভুললে চলবে না।
শীতে বয়স্কদের বাড়তি যত্ন
শীতকালে বয়স্কদের শারীরিক জটিলতা বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে সঠিক যত্ন নিতে হবে। চলুন বাড়তি কিছু যত্ন জেনে নেয়া যাক-
# খাবার পানি বা ব্যবহারের পানি যেমন অজু, গোসল ইত্যাদিতে কুমুস গরম পানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
# জ্বর-সর্দি, কাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
# ডাক্তারে পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবেনা।
# নিয়মিত মলত্যাগের অভ্যাস বজায় রাখা জরুরি।
# মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটার পরিবর্তে জুতা বা মোজা ব্যবহার করাতে হবে।
# গুরুত্বর কোনো সমস্যা দেখা দিয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
# সর্দি কাশির সমস্যায় নাক বন্ধ থাকলে উষ্ণ পানি নাক দিয়ে টানার অভ্যাস করতে হবে।
# প্রোটিনযুক্ত খাবার দিতে হবে। এবং চেষ্টা করতে হবে গরম গরম খাবার পরিবেশন করানোর।
# কোনো বয়স্ক ব্যাক্তির হার্টের কোনো অসুখ, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালির প্রদাহ বা অ্যজরা থাকলে তাদেরকে ব্যায়াম করানো যাবে না।
# ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
# রুম হিটার ব্যবহারে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় চামড়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
# ব্যবহৃত চাদর, বালিশের কভার নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এবং ভালো করে রোদে শুকাতে হবে।
# দিনের বেলায় কিংবা রাতে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবেনা। বাইরেরর হাওয়া সংস্পর্শে এলে সর্দি কাশি ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
# শরীরকে চাঙা রাখার জন্য শরীরচর্চার অভ্যাস রাখতে হবে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ না থাকায় ভালো হবে।
# যেসকল বয়স্ক ব্যাক্তি রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস ভুগছেন, তাদেরকে নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত।
# অন্যান্য অসুখ থাকলে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় শীতে কিভাবে বয়স্কদের পরিচর্যা বা বয়স্কদের সেবা যত্ন করতে হবে সে বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। শীতে বয়স্করা নানা অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শ্বাস প্রশ্বাসজনিত সমস্যা বা শ্বাসনালীর প্রদাহের কারণে তারা কষ্ট পেয়ে থাকে। আবার অনেকের শীতে অ্যাজমা বেড়ে যায়। তাই বয়স্ক ব্যাক্তিদের শীতে বিশেষ যত্নে রাখতে হবে। যাদের বাসায় বয়স্ক ব্যাক্তি রয়েছেন। তাদেরকে সুস্থ রাখার জন্য দায়িত্ব সহকারে তাদের সেবা করা জরুরি।
সবার দেশ/এফএ