Advertisement

মাহফুজা অনন্যা 

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আপডেট: ০০:৩০, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দরজা

দরজা
ছবি: সবার দেশ

গ্রামের কারোরই নজর এড়ায় না মা মেয়ের বয়স, তাদের ধুলোমাখা খেঁটে খাওয়া গতর গাঁয়ের পুরুষদের চোখে আটকে থাকে জুলেখাবিবি৷

হঠাৎ করেই অজানা অসুখে মারা গেল জুলেখার স্বামী। চৌদ্দ,পনের বছরের এক মেয়ে রুবিনাকে নিয়ে ঘরে থাকা দায় হয়ে উঠল জুলেখার। 

অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে জুলেখাবিবি। বয়স আর কত হবে ত্রিশ-বত্রিশ। জুলেখার দেহের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকে স্বর্ণলতা, বুনো ঝোপঝাড়। পথে, ঘাটে যেদিকেই যায় যেকোনো পুরুষ তার শরীরে পেঁচিয়ে থাকা স্বর্ণলতা সরাতে চায়, বুনোঝোপে মুখ লুকাতে চায়। মুহুর্তেই জুলেখা সরিয়ে নেয় তার শরীর। কিন্তু কতদিন? কতদিন এভাবে সে সরে সরে চলবে? তারও তো রক্তের শরীর! আর শরীর থাকলেই তার ক্ষুধা থাকে। 

জুলেখার স্বামী পানের হাটে কাজ করতো। যা আয় হতো তা দিয়ে তিনজনের সংসার খুব ভালোভাবে চলে যেতো। আজ লোকটা বেঁচে নেই, মেয়েকে একা ঘরে রেখে দিনেরবেলাতেও কারো বাড়ি কাজে যেতে পারেনা। জুলেখার রুপচেহারা দেখে গৃহকর্তীরা সহজে কাজও দিতে চায়না। গ্রামের বউঝিরা তাদের স্বামীদের নিয়ে শংকিত থাকে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের কাছে তারা মা মেয়ে নতুন উপদ্রব! কে দেবে কাজের মেয়েকে পাহারা? দুধে আলতা গায়ের রং জুলেখার। গাল দুটো পাকা টমেটোর মতো।  জুলেখার মেয়েটাও দেখতে শুনতে ভালো। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। এখন আর স্কুলে দেয় না। জুলেখার মেয়ের পড়ার মাথা তেমন ভালো না, বলেছে স্কুলের মাষ্টাররা। মেয়ের যখন পড়ার মাথা ভালো না, তখন এত স্কুলে গিয়ে কী হবে ভাবে জুলেখা। তাই মেয়েকে ঘরেই রেখেছে। কিন্তু ঘরে রেখেও স্বস্তি নেই তার! মেয়ে সেয়ানা হয়েছে। দিনকাল ভালো না। চারপাশে পুরুষ মানুষ আশ্বিন মাসের কুকুরের মতো কুই কুই করে। 

সন্ধ্যা লাগার সাথে সাথে পুরুষ লোকের আনাগোনা বাড়তে থাকে জুলেখার বাড়ির আশেপাশে৷ জুলেখার স্বামীর মৃত্যুতে শোকের পরিবর্তে সুযোগ খোঁজে পরিচিত, অপরিচিত পুরুষেরা। খোলা উঠোনে এসে কেউ কেউ বলে-সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় আসা হয় না, তাই সন্ধ্যায় আইচি, তুমি কেমন আচো রুবিনার মা? দু'একজন থলের ভিতর কিছু সবজি বা কদুর তেল জোর করে হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যায়। জুলেখা বিবি নিতে চায় না, তাও দিয়ে যায়! দু’একদিন পর তারা আবার আসে, গল্প জমাতে চায়, ইশারা ইঙ্গিত করে, জুলেখা বিবি বুঝতে পারে! কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না! 

জুলেখা বিবি নিজেকে সামলাতে পারলেও তার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হয়। দুঃচিন্তায় গা শিউরে ওঠে জুলেখার। স্বামী না থাকা একজন মহিলাকে কে, কীভাবে নিরাপত্তা দেবে ভেবে জুলেখাবিবি আঁৎকে ওঠে। জুলেখা বিবি সিদ্ধান্ত নেয় সে শহরে চলে যাবে। মানুষের বাসায় কাজ করবে। কিন্তু মেয়েকে রাখবে কোথায়? আর সেখানেও যে নিরাপদের তাঁবু টাঙানো আছে তা তো নয়। চিন্তায় ভেঙে পড়ে জুলেখাবিবি।  

হঠাৎ মনে পড়ে কিছুদিন আগে জুলেখাবিবির স্বামী বেঁচে থাকতে মদুঘটক নামের একজন তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। ঘটককে দেখে জুলেখাবিবির স্বামীর সে কী রাগ। ছেলে ভালো শুনেও তেড়ে গিয়েছিল মদুঘটকের উপর। জুলেখা বিবি সকালের অপেক্ষা করে। অপেক্ষার রাত দীর্ঘ হয় সবসময়। নানারকম ভাবনায় জুলেখার ঘুম আসে না। সারারাত ছটফট করে। ভাবতে থাকে আগাম ভবিষ্যত যেখানে তার মেয়ে সুন্দর করে একটা সংসার পেতে সুখে জীবনযাপন করছে। আর জুলেখাবিবি ঢাকায় গিয়ে একটা বাড়িতে কাজ নিয়েছে। ঠিক যেমন চায়, তেমনি পেয়েছে। এসব কাল্পনিক স্বপ্ন দেখতে দেখতে জুলেখাবিবি একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। 

একটু ঘুমায় তো দুঃস্বপ্নে আবার জেগে ওঠে। শেষ রাতটুকু আল্লাহর নাম জপতে জপতে চোখ বন্ধ করে থাকে। বহু কষ্টে দু চোখ ঠেসে ঠেসে জুলেখাবিবির সে রাত সকাল হলো। সারারাত চিন্তায় ভালো ঘুম হয়নি জুলেখাবিবির। সকাল হলে জোর পায়ে হেঁটে চলল চরপাড়ার মদুঘটক এর বাড়ি৷ এত সকাল যে মদুঘটক তখনও কাজে বের হয়নি। মিসওয়াক দিয়ে দাঁত ঘষছে। জুলেখাবিবির টান পায়ে কাছে আসা দেখে মুখভরা এক গাল থুতু অন্যদিকে ছুঁড়ে দিয়ে মদুঘটক জিগ্যেস করল-তুমি এ পাড়ায় কী মনে করে রুবিনার মা? জুলেখাবিবি কাকুতিমিনতি করে বলে- আমার মেয়েটার একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও মদুঘটক৷ আমি আর ওকে নিয়ে ভরসা পাই নে। দিনকাল খুব খারাপ পড়িচে। মদুঘটক বলল-আমার হাতে একন একটা ছেলিই আচে, দিলি এই ছেলির সাতেই দেও, খুব সুকি থাকপি। ভাত কাপড়ির অবাব হবি নানে। ছেলির একটা পান ছিকারেটের দোকান আচে। সংসার মোটামুটি ভালো চলে। ঘরে খাতি পারবি, কিছুই কিনে খাতি হবি না। জুলেখাবিবি বলে-আমি তো জামাই বাবাজিকে কিছুই  দিতি পারবো না। ঘটক, মাথা চুলকে বলে- আচ্চা সে আমি দেখপানে। চিন্তা করা লাগবি না। তুমি একন বাড়ি যাও। 

একথা বলতে বলতে মদুঘটক আনমনে চেয়ে থাকে জুলেখাবিবির মুখপানে। মদুঘটকের চোখের চাহনিতে অন্যরকম চাওয়া টের পায় জুলেখাবিবি। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তার এখন বিপদ। এতকিছু ধরতে গেলে তার চলে না। মদুঘটক এদিক ওদিক তাকিয়ে জুলেখাবিবিকে ইশারা করে। জুলেখাবিবি কান পেতে দেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে মদুঘটক ফিসফিস করে বলে- আমারে শুধু একবার এট্টু খুশি করে দিবা রুবিনার মা। তুমার মিয়ে মানি হইলো আমার মিয়ে বোচ্চো৷ তুমার আর কিছুই ভাবতি হবে না। 

মদুঘটক যখন জুলেখাবিবির কানের কাছে মুখ নিয়ে এগিয়ে গেল, মদুঘটকের পানখাওয়া মুখের দারুণ এক সুবাস জুলেখাবিবিকে কেমন যেন মাতোয়ারা করে দিল৷ কিছুক্ষণ ধরে জুলেখা বিবি আনমনা হয়ে কান পেতেই রইল। জুলেখাবিবির কান পেতে থাকা দেখে মদুঘটক জিভ দিয়ে কানের ভিতর আলতো করে চেটে দেয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই জুলেখাবিবি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মদুঘটকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল৷ মদুঘটক কিছুটা হাসিমুখে ইশারা দিয়ে  জুলেখাবিবিকে বিদায় দিল। 

পরদিন জুলেখাবিবি ছেলে পক্ষকে তার মেয়ে রুবিনাকে দেখায়। ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখে খুব পছন্দ করে। রুবিনার বয়স কম হলেও গায়গতরে ডাঙ্গর দেখে রাজী হয়ে যায় ছেলেপক্ষ। কিন্তু এখন একটা সমস্যা হচ্ছে। মেয়ের বয়স আঠারো বছর হয়নি। জুলেখাবিবি লোকমুখে শোনে আইন আছে যে ছেলে বা মেয়ের বয়স আঠারো বছর পূর্ণ না হলে তাদের বিয়ে হলে থানা থেকে পুলিশ এসে বিয়ে ভেঙে দেয়। আরও জরিমানা এবং বাল্যবিবাহের অপরাধে অভিযুক্তদের জেল হাজতে নিয়ে যায়। 

রুবিনার বয়স পনর ছুঁইছুঁই। জুলেখাবিবি  মদুঘটকের পরামর্শে গ্রামের মেম্বারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বলে- মেয়েটার বয়স সার্টিফিকেটে তিনবছর বাড়িয়ে দিয়ে বিয়ে দিতে সহযোগিতা করেন মেম্বার সাব। গাঁয়ের মেম্বার বলে কথা। এত সোজাসুজি কি আর এত বড় কাজ করে দেবে? মেম্বার সাহেব একবার শুনেছিলেন গ্রামের জোয়ারদার পাড়ায় মুনতাজ মিয়া নামে একজন মারা গিয়েছে। কিন্তু তার বউ যে এত সুন্দরী আজ প্রথম দেখলো। জুলেখাবিবিকে দেখেই মেম্বারের বুকের ভিতর প্রজাপতি নেচে উঠল। মনে ঢেউ জেগে জেগে উঠছে যেন মাসুদ মেম্বারের। হেসে হেসে মাসুদ মেম্বার বলল- আমি যখন আছি তোমাকে কোনোকিছু নিয়ে ভাবতি হবে নানে। কিন্তু একখান কতা। জুলেখাবিবি চমকে ওঠে। কী কথা জুলেখার সাথে? মেম্বার সাহেব কি টাকা পয়সা চায়? তাই কোনোকিছু না বুঝে সে প্রশ্ন করে - কী বলতি চান মেম্বার সাব,  আমি কিন্তু গরীব মানুষ। আমার স্বামী মারা গিয়েচে হঠাৎ করে, আমি কলাম টাকা পয়সা দিতি পারবনানে। মেম্বার সাহেব একগাল হাসি হেসে বলে-কী যে বলো, টাকা পয়সা নিয়ে ভাবতি হবে নানে কলাম না? তুমার যা আছে তাই দিলিই আমি খুশি হয়ে যাবোনে। 

মাসুদ মেম্বারের কথা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না জুলেখাবিবি। তবু ঘাড় নেড়ে বলে আইচ্ছা। আমার মেয়ের বিয়েরদিন আমার ভিটায় একপেট ডালভাত খাবেন মেম্বার সাব। তাতেই আমি খুশি হবোনে। 

জুলেখাবিবি ধারণা করে নেয় এক পেট ভালোমন্দ খাওয়ার বদলে মেয়ের বয়স বাড়ানোর কাজটি করতে মেম্বার রাজী হয়েছে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সেদিন হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যায় জুলেখাবিবি। 

পরের সপ্তাহে শুক্রবার জুলেখাবিবির মেয়ে রুবিনার বিয়ে। বাড়ির বাইরে ছোট ছোট দুটো কলাগাছ কেটে তাতে লালকাপড় পেঁচিয়ে গেইট সাজানো হয়েছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটি বউ লালশাড়ি পরে বরের অভ্যর্থনা জানানের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশে পাড়ার কিছু কচি কাঁচা মুখ বরের অপেক্ষায় শরবত হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ে বাড়িতে দু'একজন আত্মীয়স্বজন যে আসেনি তা নয়। জুলেখাবিবির বাপভাইয়ের দিক থেকে কয়েকজন এসেছে। আর তার আপনজন শরীক বলতে তেমন কেউ নেই। তবে দু’একজন প্রতিবেশি মুরুব্বি লোকজন এসেছে। জুলেখাবিবির মেয়েকে সাজানোর জন্য পাড়ার কয়েকজন মেয়ে এসেছে। আর মদুঘটক ও গ্রামের মাসুদ মেম্বার সারাদিনই জুলেখাবিবির বাড়িতে আছে। এভাবেই ছোট আয়োজনের মধ্য দিয়ে জুলেখাবিবির মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। একদিকে চোখের পানি আর একদিক দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো জুলেখাবিবি। তবুও কিছুটা নিশ্চিত হতে পারল যে এখন সে অন্তত মানুষের বাসায় কাজ করতে পারবে। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তাকে আর ভাবতে হবে না।  

কিন্তু জুলেখাবিবি ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি, সে নিজেই এখন বড় অনিরাপত্তার ভিতর ঢুকে গেল! তবু তো এতদিন মেয়েটা ছিল৷ কাছে কাছে থাকতো। সংসারের টুকিটাকি কাজ করতো। শরীর খারাপ হলে পাশে থাকতো। জুলেখার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে বুঝতে পারে সে আসলে খুব একা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মন খারাপ লাগে জুলেখাবিবির। আসলে মানুষ ভাবে এক, আর হয় এক৷ জুলেখাবিবি ভেবেছিল, মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আরও একা হয়ে যায় জুলেখাবিবি। 

মানুষের বাড়িতে কাজ শেষ করে এসে দরজা লাগিয়ে শুয়ে থাকে জুলেখাবিবি। আজও শুয়ে আছে জুলেখাবিবি। আজ কোনো রান্না নেই জুলেখাবিবির। যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়ি থেকে থেকে একটু ভাত ও তরকারি দিয়েছে। রাতে তা খেলেই হয়ে যাবে। সারাদিন কাজ করে ফিরলে সন্ধ্যার পর গা এলিয়ে আসে জুলেখাবিবির। 

জুলেখাবিবি আজ কিছুটা বেসামাল হয়ে শুয়ে আছে। ঘরের দরজায় খিড়কি দেওয়া আছে। মাগরিবের বেলা শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। একপাশে একটি হারিকেন জ্বলছে৷ আশেপাশে কেউ নেই। কোমর ছাওয়া ভেজা চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে জুলেখাবিবি। গায়ের রঙ থেকে লাল আভা ছড়াচ্ছে, টোকা দিলে রক্ত ছোটে এমন যেন। বুকের উপর কাপড় নেই। বুকে দুটো ডালিম আকাশ দেখছে৷ পা দুটো বাঁশের কেল্লার মতো সটান ছড়ানো। সায়া উঠে আছে হাটুর উপরে! মনে হচ্ছে কলা গাছের মাঝের নতুন ডগমগে শরীর। দরজা বন্ধ পেয়ে বেড়ার ফুটোতে চোখ রেখে দেখছে মদুঘটক। জুলেখাবিবির জ্বলন্ত শরীরের কাছে হারিকেনের আলো হার মেনে যাচ্ছে। দেখে মন মিটছে না মদুঘটকের। তার জিহবা নড়ে চড়ে রসালো হয়ে উঠছে। কিন্তু জুলেখাবিবিকে না ডেকে কিছুক্ষণ পরপর বেড়ার ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে আর একটু ফাঁকা করে নিয়ে দেখছে। দেখছে তো দেখছেই। মদুঘটক আজ আর নিজেকে আগের মতো ফেরাতে পারবে বলে মনে হয় না। হঠাৎ দেখে, জুলেখাবিবি পিঠ ঘুরিয়ে অন্য পাশ হয়ে শুলো। কাপড়ের আঁচলটা পুরোপুরি ছিটকে পড়লো জুলেখাবিবির শরীর থেকে। মদুঘটকের মনে হলো এই বুঝি, জুলেখাবিবির তাজমহল উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। 

মদুঘটকের মনে হচ্ছে, জুলেখাবিবির কোমরের পিছন থেকে ব্লাউজের উপর পর্যন্ত ঢেউখেলানো মাংসগুলো তাকিয়ে আছে যেন মদুঘটকের দিকে। মনে হলো, তারা বিপুল উৎসাহে মদুঘটককে কাছে ডাকছে। মদুঘটক শুনতে পায় সে ডাক। সে আর বেড়ার ফাঁকে দেখে দেখে সন্তুষ্ট থাকতে পারলো না। সে এক পা দু’পা করে এগিয়ে দরজার কাছে চলে গেলো৷ আস্তে করে খিড়কিতে নাড়া দিল। মুখে কিছু বলে না। স্বর আসে না। মদুঘটকের ঠোঁট কাঁপতে থাকে। ভিতর থেকে জুলেখাবিবি একটু নড়ে উঠল। ভাবল, হয়তো ঘুমের ঘোরে কিছুটা ভুল শুনছে জুলেখাবিবি। তাছাড়া এখন তো বেশি রাত না। কাজ করে এসে গা এলিয়ে আরাম করছে৷ এই সন্ধ্যায় আবার কে আসবে?

কিন্তু না। আর একবার কড়া নাড়ার শব্দ শুনে জুলেখাবিবি হকচকিয়ে উঠে বসে পড়ে৷ ছোট করে জানতে চায় - কিডা? 
দরজার ওপার থেকে মদুঘটক বলে- আমি মদুঘটক। জুলেখাবিবি দরজা খোলো। তুমার সাথে কতা আছে। 
ঘটকের কথা শুনে জুলেখাবিবি গা গতরে কাপড় টেনে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল -কী কতা? এক মুহুর্তও দেরি না করে জুলেখাবিবি দরজা খুলে দিল৷ মদুঘটক একগাল হাসি দিয়ে আজকে আবার কানের কাছে মুখ নিতে ইশারা করল জুলেখাবিবিকে। জুলেখাবিবি কেন যেন কী এক অজানা টান অনুভব করল মদুঘটকের ইশারায়। আজকে সে খুব উতলা হয়ে আছে। নিজেকে সে আর ঠিক রাখতে পারছে না। ভিতরের বুনো টানে জুলেখাবিবি দরজার ভিতরে থেকেই মুখ বাড়িয়ে কান পেতে দিল। মদুঘটক কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগল-জুলেখাবিবি আজকে তুমারে অনেক সুন্দর লাকচে। আজকে কি আমারে এট্টু সময় দিবা? 

জুলেখাবিবির আগের একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো৷ আর আজকেও আগেরদিনের মতো মদুঘটকের পানখাওয়া মুখের সুবাসে মন অস্থির হয়ে উঠলো। জুলেখাবিবি কান পেতেই থাকে। কী বলবে মুখে ভাষা নেই। আজকেও মদুঘটক জুলেখাবিবির কানের পাশে জিহবা দিয়ে চাটতে শুরু করে। জুলেখাবিবি কিছু বলে না। জুলেখাবিবি কেমন যেন সুবাসে মোহিত হয়ে যাচ্ছে।  আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে মদুঘটকের ছোঁয়ায়। মদুঘটক বুঝতে পেরে আস্তে আস্তে নিজের পা দু’খানি দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। পিছনে না তাকিয়ে একহাতে জুলেখাবিবিকে ধরে থাকে অন্যহাতে আলগোছে জুলেখাবিবির ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। একের পর এক জুলেখাবিবি ও মদুঘটক স্পর্শের গভীরতর ধাপ অতিক্রম করতে থাকে।

গ্রামের বড় বাড়ি। সে বাড়িতে সারাদিন কাজ করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে জুলেখাবিবি। যে সব বাড়িতে কাজ করে সেসব বাড়ির বউ-ঝিরা জুলেখাবিবিকে চোখে চোখে রাখে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসে জুলেখাবিবি। ঘরে ফিরে রোজ রাতে বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে জুলেখাবিবির। স্বামী বেঁচে থাকলে এত চিন্তা করতে হতো না তার। স্বামী মরা একবছর হয়ে গেছে। এতদিন কষ্ট না হলেও এখন স্বামীর অভাব খুব বুঝতে পারে সে। তাছাড়া কাছে মেয়েটাও থাকে না। জুলেখাবিবি নিজের মন ও শরীরকে ইদানীং কেন যেন আর ঠিক রাখতে পারছে না। জুলেখাবিবি বুঝতে পারে তার শরীর কিছু একটা চায়। মনও কিছু একটা চায়। গরীব মানুষ হলেও জুলেখাবিবির স্বামী তাকে সুখী  করতে পারতো। পাশের বাড়ির বড়লোকের বউরা জুলেখার সুখ দেখে কত ঈর্ষা করে বলতো- ‘ভাতার সোহাগী মাগী'। আর আজ, জুলেখার শরীর আছে, কিন্তু সোহাগের মানুষ নাই! 

রাত নেমে এসেছে। গ্রামে যার যার ঘরে দরজা দিয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে। জুলেখা একপাশে একটি হারিকেন মিনমিন করে জ্বালিয়ে রেখে শুয়ে আছে৷ কতকিছু ভাসছে চোখের পাতায়। রোজিনা মেয়েটাকে হাতড়িয়েও আর বুকের কাছে পায় না। অল্প বয়স, সংসারের কতটুকুই বা  বোঝে! তবুও পুরুষ নামের বিপদ থেকে বাঁচতে আর এক পুরুষের মুখে ঠেলে দেয় পনেরো বছরের মেয়েকে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় জুলেখাবিবির। 

রাত ক্রমশ গভীর হয়ে আসে। রাতের সাথে সাথে বুক ভেঙে কান্না আসে জুলেখাবিবির। বালিশে মুখ গুজে একাকী নীরবে পৃথিবীর হিসেব মিলাতে থাকে। বাতাস ভারী হয়ে আসে চারদিক থেকে। শুনশান নীরবতায় নেমে আসে অন্ধকার। রাতের কোলে একলা একাকী জুলেখাবিবি কেঁদে চলে, কী করে সে মেয়েকে ফেলে শহরে গিয়ে একা থাকবে? অকালে স্বামী মরে গেল, তাও সয়ে নিল৷ কোলের মেয়েকে পরের ঘরে দিয়ে নিজে একা হয়ে গেল। কিন্তু এই এক টুকরো ভিটা! এই ভিটা ছেড়ে ঘর ছেড়ে কী করে যাবে? চারদিকে মানুষ ওৎ পেতে আছে ভিটের- জমিটুকুর জন্য। অনেক অভাবে থাকলেও ভিটের জমিটুকু বেচবে না জুলেখাবিবি।  জমিটুকু হাতছাড়া করলে কি আর কোনোদিন ফিরে পাবে? 

হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ! জুলেখার কান খাড়া হয়ে ওঠে, অন্ধকার রাতে আজ কে এলো? মদুঘটকের পাওনা তো মিটিয়ে দিয়েছে সে। আজ আবার কে এলো? 
আস্তে করে জুলেখাবিবি জিগ্যেস করে -কিডা? মৃদু শব্দ করে ওপাশ থেকে শব্দ শোনা যায় - আমি, মাসুদ মেম্বার। দরজা একটু খোলো জুলেখা বিবি, তুমার সাতে কতা আছে। 

কী কথা জুলেখাবিবির সাথে? জুলেখাবিবি ফিরে যায় সেই কথায়, যেদিন মাসুদ মেম্বারের সাথে তার কথা হয়েছিল। মাসুদ মেম্বারের মুখটা জুলেখাবিবির চোখের উপর ভাসছে। আর মাসুদ মেম্বার হেসে হেসে বলছে - চিন্তা করা লাগবি নানে, তুমার যা আচে তাই দিলিই আমি খুশি হয়ে যাবোনে। 

কী আছে জুলেখাবিবির কাছে? জুলেখাবিবি চমকে ওঠে। জুলেখাবিবি একবার নিজের সমস্ত শরীরের দিকে খুব ভালোভাবে তাকায়। শিরশির করে উঠল পায়ের তালু থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীর। জুলেখাবিবি মনের অজান্তেই নিজের দুই হাত দুইদিক থেকে এনে নিজের ফুলে থাকা ডালিমের মতো বুকটা চেপে ধরে। জুলেখাবিবির শরীরের ভার আর সে বইতে পারছে না। 

একটু পর আবারও ফিসফিস করে মাসুদ মেম্বার, জুলেখাবিবির দরজায় টোকা দেয় আর বলে- জুলেখাবিবি দরজা খোলো, তুমার সাতে কতা আছে। 

জুলেখাবিবির সমস্ত দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়! 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক