উপন্যাস
আকাশ মেঘলা হলেও হাসে
(পর্ব এক)
২০২১ সালের কথা, একটা সরকারী ব্যাংকে কাজ করি। তখন আমার পদায়ন প্রধান কার্যালয়ের মানব সম্পদ বিভাগে। দিন রাত এক করে কাজ করি। সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ৮টা ৩০ মিনিটে বাসা থেকে বের হই মতিঝিলের উদ্দেশ্যে। নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাই। মাঝে মাঝে বড় স্যারদের ফোন আসে। বেশির ভাগ তদবির। এটা করে দিতে হবে ওটা করে দিতে হবে ইত্যাদি।
এই তদবির এর সাথে আমি ছোট বেলা থেকেই অভ্যস্ত। জানি কী করে হ্যান্ডেল করতে হয়। কিছু কিছু পরিচালনা পর্ষদের সদস্য স্যাররা ফোন দিতেন। অমুকের এটা করে দিতে হবে, তমুকের বদলিটার কী হলো ইত্যাদি। ফোন কানে নিয়েই অফিসে ঢুকি, আবার বাসায় যখন ফিরে আসি তখনো আমার কানের সাথে লেগে থাকে ফোন। ছেলেমেয়েরা আমার এই আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করে। মাঝে মাঝে এমন দিন যায় যে দুপুরের খাবার সময় ঠিক থাকে না। কোন রকমে নামাজটা পড়ি। বের হতে হতে রাত ৮টা বাজে। মাঝে মধ্যে এর চেয়েও বেশি রাত হয়। ব্যাপারটা এমন যে এই ব্যাংকের সব দায় আমার ঘাড়ে এসেছে। রাতের মতিঝিল যারা দেখেনি তাদের কাছে দিনের মতিঝিল অচেনা মনে হবে।
শনিবার নেই, শুক্রবার নেই এমনকি ২১ ফ্রেব্রুয়ারীতেও সরকারী অনুমতি নিয়ে, অফিসে গিয়ে, কাজ করেছি। এমন ঘটনাও ঘটেছে। বই মেলায় বই বেরিয়েছে, এক মাস যেতে পারিনি ঠিক মত। গেলেও নিজের মত করে এক দুই ঘন্টা থেকে চলে এসেছি। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। ব্যাংকের সব দায় যেন আমাকেই মেটাতে হবে।
রাতের মতিঝিল দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার দলের সদস্যদেরও হয়েছে। আমাদের এক অনুভূতি হয়েছে। আমাদের সবার অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে ডেকেছি, সাহস চেয়েছি। আমাদের অফিস থেকে পায়ে হেঁটে ভয়ে ভয়ে গিয়েছি একটা ভবনে। রাতের মতিঝিল ঝুঁকিযুক্ত মতিঝিল। রাতের আঁধারে ধীরে ধীরে চলে যাই পার্কিং এ। আশ্বস্ত হই সারাদিন ফেলে রাখা গাড়ি অক্ষত দেখে। রাত বেশি না তবুও কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। সারাদিন ধরে গাড়ি রেখে আসাটা ছিল ঝুঁকিপুর্ণ। কিন্তু কী করার আছে। ড্রাইভার রাখার মতো টাকা নেই বা সামর্থ্য নেই। নিজের গাড়ি নিজেই চালাই। এভাবে বেশ কয়েক মাস গাড়ি রাখার পরে আমার এক সহকর্মী সুমন এর সাহায্যে আমাদের অফিসের সামনে একটা পার্কিং পেয়েছিলাম। সারাদিন এর জন্য ভাড়া দিতাম আড়াই হাজার টাকা, আর রাতে নিয়ে রাখতাম বাসার গ্যারেজে, দিতাম মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা। অফিসের সামনে রোদ বৃষ্টিতে ভিজতো, পড়ে থাকতো সারাদিন। জানালা দিকে মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখেছি আমার ২য় স্ত্রী ক্যামন আছে। খুব যত্ন করি আমার নিজের গাড়িটাকে। অনেকটা স্ত্রীকে যত্ন নেবার মতোই। পরে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হলে গাড়ি রাখার স্থানটা আর রইলো না। এরপর মতিঝিল থেকে বাসায় আসার জন্য সিএনজি ধরতাম।
মতিঝিলের চারিদিকে ব্যাংক আর ব্যাংক আমার তখন মনে হয় এই পাড়ার নাম কেন মতিঝিল থেকে বদলে “ব্যাংক” হয় না। সেন্ট্রাল লন্ডনের একটা স্থান আছে যার নাম ব্যাংক। একদিন এই স্থানের ম্যাকডোনাল্ডস এর চাকরী না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরেছি “মাইল এন্ড” এর বাসায়। তখন আমি বিয়ে করিনি। একা একা থেকেছি শীত প্রধান দেশে।
মাইল এন্ড পার্কের এর পাশেই একটা লেক আছে, কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয় ঘেঁসে। লিসা মুস্তাফিজ আর আমি কাজ থেকে ফিরে মাঝে মাঝে বসতাম লেকের ধারে। হ্যাঁ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কাজ করতে হয়েছে। দেশীয় ভাষায় যাকে বলে “অড জব” । আমাদের নানা কথা হত। আশার কথা, হতাশার কথা। ভরসার কথা। তবে বেশির ভাগ কথা ছিলো কবে দেশে ফিরবো? ফিরে কী করবো?
আকাশের দিকে তাকানো যেতো না, একটুও ধূলো নেই, চারিদিকে চকচক করছে। রোদ আছে আবার তাপ নেই এমন পরিবেশে আমাদের কফি খাবার মত টাকাও ছিলো না। ঘর ভাড়া, বিশ্ববিদালয়ের টিউশন ফী দিয়ে বাকী টাকা আমরা জমিয়েছি, ইউরোপ দেখব। প্রতিবছর দেশে এসেছি, কাকে কি কিনে দেব সে গুলো নিয়ে কথা বলেছি। তাই জমাতে পারিনি কোন পাউন্ড বা টাকা।
দেশে ফিরে আদৌ টিকে থাকতে পারবো কিনা। কারণ প্রায় পাঁচ বছর বিলেতে থাকার পরে একমাত্র বোকারাই দেশে ফিরে আসে। দেশে কোন জব বা ব্যবসা ছিলোনা যে গিয়েই বসে পড়বো। ছিল না কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত। শুধু আব্বা মা ছিলেন আমাদের, তাদের ভরসায় ফিরে আসি। আমি আর লিসা মুস্তাফিজ স্বপ্ন দেখেছি দেশে ফিরবো, আমাদের অনেক সুখ আসবে শান্তি আসবে জীবনে। আমরা ফিরেছি দেশে। কোন পিছুটান ছিলো না আমাদের। ফেরার আগে অনেক বন্ধু আমাকে বলেছিলো বড়জোর দুই মাস পর আমি ফিরে যাবো।
সত্যি হয়েছে আমার এক ছোট ভাই মুকুল এর ক্ষেত্রে। আমরা একই সময় ফিরেছিলাম, আমি এখনো টিকে আছি, কিন্তু তাঁকে ফিরে যেতে হয় বিলেতে। এখন সে বিলেতে ভালো আছে। সুখেই আছে। অন্তত ফেসবুক তাই বলে। যদিও মানুষের ভিতরে ঢুকলেই দেখি তার যে ক্ষত, কষ্ট, ঝামেলা, অশান্তি তার তুলনায় ভালো আছি। তখন নচিকেতার গানটা মনে বেজে ওঠে ‘এই বেশ ভালো আছি’।
লেখক: কথাসাহিত্যক ও ব্যাংকার