Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:৩০, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

প্রবন্ধ

মানুষের ছবি

মানুষের ছবি
ছবি: সবার দেশ

(শেষ পর্ব)

মানব সভ্যতা শৈশব কাটিয়ে যতোই তারুণ্যের দিকে যাচ্ছে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের আদেশ-নির্দেশ ও শাসন-নিয়ন্ত্রণ সম্বলিত কোরআনুল কারিমের উদ্দেশ্য ও গূঢ়তত্ত¡ ততোই বের হয়ে আসছে। বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন হুমড়ি খেয়ে দেখছে- বিশ্ববিধাতার বিশ্ববিমোহিনী অলৌকিক অলংকার শোভিত বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাহিত্যকর্ম, নির্ভুল জ্যামিতিক ও গাণিতিক হিসেব-নিকেশের নিখুঁত নিগূঢ়ে নিবন্ধিত মহামহিমান্বিত কোরআনুল কারিমের পরতে পরতে পড়ে রয়েছে মানবজাতির হইলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির পথ। 

ধর্মজীবী পেশা ছেড়ে গবেষণার নেশায় ডুব দিন। ইসলামের মহাসিন্ধু থেকে এক বিন্দু শান্তি ও স্বস্তি র জীয়নকাঠি এনে আপনাদের হৃতগৌরবকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করুন। মিশরের আবদুর রশিদ খলিফার মতো কোরআন নিয়ে গবেষণা করতে গেলে অনেক অলৌকিক গাণিতিক ও জ্যামিতিক তথ্যাবলি বের হয়ে পড়তে পারে। ইসলামের এতো সুন্দর, সুস্বাদু, সুখাদ্য, সুপাত্রের অভাবে শুষ্ক হতে শুরু করেছে। 

বোমাবাজি ছেড়ে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি থেকে গবেষণার দ্বারা বিশ্ববাসির কাছে ইসলামের কল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরার সময় হয়েছে। তুলে ধরা হলে, এখন যেখানে পরিবার-পরিজন ছেড়ে কাঁথা কম্বল ঘটি-বাটি বগলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিন-রাত হেদায়েত করেও অনেককে ধর্মের পথে নামানো যাচ্ছে না, তখন সেখানে দেখা যাবে হেদায়েত করেও ধর্মের পথ থেকে সরানো যাচ্ছে না। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টাস্বয়ং যেখানে সৃষ্টিকে প্রধান্য দিয়েছেন সেখানে আমাদেরও উচিত স্রষ্টার ইচ্ছাকে প্রধান্য দেয়া। নয়তো পরিবেশানার অভাবে মানব কল্যাণের এতোবড় জ্ঞানভান্ডার পেয়েও ধর্মের বিশ্বমেলায় আমরা ভীষণ মার খেয়ে যাবো। স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক জানতে গিয়ে আমরা আরো জানতে পেরেছি মানুষের জন্য ধর্ম- ধর্মের জন্য মানুষ নয়। শুধু তাই নয়, হাদিসে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন তিন প্রকারের আদালত বসবে। প্রথমটি বসবে খুবই জটিল এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে- দ্বিতীয় আদালত বসবে বান্দার হক বা হক্‌কুল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। পরিশেষে তৃতীয় আদালতটি হবে আল্লাহর হক সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। প্রথম আদালতের অপরাধ আল্লাহ কোনোক্রমেই ক্ষমা করবেন না। দ্বিতীয় আদালতে অপরাধের ক্ষমা ঘটনা সাপেক্ষে করতে পারেন। আর তৃতীয় আদালতে বান্দার অপরাধ ক্ষমা করা না করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল।

- আসলেও তাই, স্রষ্টাও যেন তার সৃষ্টির সেরা মানুষকে নিয়েই বেশি ভাবেন। তাই মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়লেই আল্লাহ নবী-রাসূলদের প্রেরণ করতেন। সৎ পথে সহজ সরল জীবনেই প্রকৃত সুখ-স্বস্তি। সীমার বাইরে পানাহার যেমন বিপজ্জনক তেমন বিপজ্জনক সবকিছুতেই। তবে ঐ যে বললেন ‘স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টির ঋণ শোধ অনেক সহজ’ এ কথাটি ‘সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টার ঋণ শোধ অনেক কঠিন' এ ভাবে বলা চলে না?
- হ্যাঁ চলে। তবে ভাষাটা একটু রুক্ষ হয়ে যায়। যেমন, ‘গ্লাসটি অর্ধেক শূন্য’ এবং ‘গ্লাসটি অর্ধেক পূর্ণ' বাক্য দুটি শুনতে বিপরীত বোধক মনে হলেও অর্থ কিন্তু এক ও অভিন্ন। বাক্য দুটি যার যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করে থাকে। ‘আল্লাহর হক আদায় করার পদ্ধতি কঠিন' এ কথা বলার ইচ্ছা আমার নেই, আমি শুধু বলেছি বান্দার হক আদায় করা সহজ। এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছি, তোমার বাবা কলকাতার দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ মাওলানা হলেও তাঁর ভেতর কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তার থেকে তুমি একটু স্বতন্ত্র। তোমাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কি? তুমি বহু বছর থেকে আরবের ধর্মীয় পরিবেশে আছো। মানুষ পরিবেশের দাস। তাই, আমার মতো আত্মভোলা বাউলার ব্রেইন আউলা করে ভুল ভেজালে ভুলিয়ে বেলতলা নিয়ে তালগোল পাকাতে চাচ্ছো।

- ‘বাউলার ব্রেইন আউলা করা' এর অর্থ?
এক সময় আমি ‘বাউল' ছদ্ম পরিচয়ে পত্র-পত্রিকায় ছড়া-কবিতা পাঠাতাম। ‘জেড. এ বাউল' ছদ্ম পরিচয়টা মন্দ ছিল না। কারণ ‘বাউল’ শব্দটার সাথে কেমন যেনো একটা ‘উদাসীন উদাসীন’ ভাবের যোগসূত্র রয়েছে। এখন নামের সাথে ‘এডভোকেট’ পদবিটা যুক্ত করে বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। কারণ, উদাসীনের সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবের যোগসূত্র রয়েছে ‘এডভোকেট’ পদবির মাঝে। আগে বাউলার আউলা-ঝাউলা ছড়া-কবিতা ও দু'চার জন পড়তে শুরু করেছিল- এখন রসকষহীন ‘এডভোকেট' এর জ্ঞানগম্মিময় লেখা-জোখা কেউ ছুঁয়েও দেখে না। নানা রকম ছলা-কলা দিয়ে বাউলাদের যতো সহজে নর্দমায় নেওয়া যায় এডভোকেটদের ততো সহজে নর্দমায় নেওয়া যায় না।

নাউজুবিল্লাহ, আপনি আমাকে কি ভাবছেন! আপনার উপদেশ আমার জীবনে পাথেয় হয়ে রয়েছে। আপনার প্রতি রয়েছে আমার অগাধ বিশ্বাস। যে বিশ্বাস আমাকে দেড় হাজার কিলোমিটার ঘুরিয়ে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। এই বাউলা মাথা নিয়ে ভুল করে যাতে বেলতলা না যান এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে যাচ্ছি। তবে আপনার একটা বিষয় মেনে নিতে পারছি না। - কোন বিষয়টা?
- ঐ যে বললেন, 'আল্লাহর ঋণ শোধ করার পদ্ধতি বড় কঠিন', সে বিষয়টা।
আমি কিন্তু একবারও বলিনি ‘আল্লাহর ঋণ শোধ করার পদ্ধতি বড় কঠিন'। আমি বলেছি ‘আমার কাছে সৃষ্টির ঋণ শোধ করার পদ্ধতি অনেক
সহজ'। কারণ, আমি আরবি ভাষা জানি না। একজন উকিল হিসেবে যতটুকু ইংরেজি জানা আবশ্যক আমি ততটুকু ইংরেজিও জানি না। ভাষা সমস্যার কারণে বিদেশ-বিভ‚ঁইয়ে মজার মজার ঘটনাও কম ঘটে না। একবার লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরের বহির্গমন পথ দিয়ে বের হতে গেলে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। আমার কাছে ইংরেজিতে জানতে চায়-
'ডু ইউ নো ইংলিশ ওয়েল?’  
আমি উত্তর দিয়েছিলাম-
- 'আই নো বেঙ্গলী ওয়েল।'
আমার এ রকম উত্তর শুনে ইমিগ্রেশন পুলিশ বিব্রত হয়ে পাসপোর্টে ‘পেশা’র কলামে ‘এডভোকেট' পদবির দিকে ইশারা করে মুচকি হাসি হেসে পুনরায় বলেছিলেন-
‘নো, নো বেঙ্গলী, ইউ ট্রাই টু আসার ইন ইংলিশ।’

আমার আরবি ভাষা না জানার কারণে প্রধান প্রধান সমস্যা-
প্রথমত: বর্ণ ও শব্দের উচ্চারণ আতংক। শৈশবে মক্তবে গিয়ে অর্থ না বুঝে এক ওস্তাদজী ক্বারীর কাছে কিছু সূরা-কালাম মুখস্থ করেছিলাম। আমার কাছে অনেক আরবি শব্দ উচ্চারণ করা শুধু দুরূহই নয়, দুষ্কর ও দুঃসাধ্য ছিল। কোনো কোনো শব্দ উচ্চারণে সামান্য বিচ্যুতির ফলে সমোচ্চারিত ভিন্ন শব্দের দ্বারা বিপরীত অর্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কখনো কখনো বিপরীত অর্থ হয়ে অনর্থ কান্ডের দ্বারা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন, কোরআনুল মজিদের শেষ তিনটি সূরা যথাক্রমে সূরায়ে আল-নাস, সূরায়ে আল ফালাক ও সূরায়ে ইখলাস শুরু হয়েছে 'কুল' শব্দ দিয়ে। ‘কুল’ শব্দের অর্থ 'বলো' বা 'স্বীকার করো'। আরবিতে 'কুল' শব্দের সমোচ্চারিত 'কুল' শব্দের অর্থ 'খাও' বা ভক্ষণ করো। দুটি শব্দ শুনতে প্রায় একই রকম মনে হলেও উচ্চারণে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। আরবি ধ্বনিতত্ত¡ ও ব্যাকরণ সম্পর্কে যাদের ধারণা না আছে তাদের কাছে 'কুল' আর 'কুল' এ দু'শব্দের উচ্চারণগত পার্থক্য দৃষ্ট হয় না। এ ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস, চির পরিচিত আজানসহ নামাযে ব্যবহৃত বহুল পরিচিত সূরা এবং দোয়া-কালাম সমূহ মাতৃভাষায় ব্যবহার করার আবশ্যকতা না থাকলেও এ সবের অর্থসহ সঠিক উচ্চারণের সাথে পরিচয় থাকা ভালো। কারণ, গত হাজার বছরে কোনো কোনো আরবি শব্দ বা বাক্য বহুবার ব্যবহারের ফলে বর্তমানে মাতৃভাষার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, কোনটা আরবি শব্দ আর কোনটা বাংলা শব্দ পৃথক করাই দায় হয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষা থেকে এ রকমের আরবি শব্দ বা বাক্য বাদ দিতে গেলে মহাপ্রলয় কাÐ ঘটে যাবে। আরবিতে এমন সব শব্দ আছে- যে সব শব্দ বা বাক্য পরিবর্তনে ধর্মীয় বাধা-নিষেধ রয়েছে সে সব শব্দ ও বাক্য অবিকৃত রেখে, মাতৃভাষায় ধর্ম-চর্চা করতে আর কোনো বাধা থাকে না।

দ্বিতীয়ত: আমার রয়েছে উচ্চারণ আড়ষ্টতা। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সব সময় আমার পড়ার টেবিলে কিছু পড়ুয়া বসা থাকতো। পড়ুয়াদের পড়ায় সমস্যা হতে পারে, সে কারণে আশৈশব নীরবে লেখাপড়া করতে গিয়ে আড়ষ্টতা এক সময় স্থায়ী হয়ে যায়। তাই আরবি পড়তে গিয়ে আমার কাছে বারবার মনে পড়তো আমার উচ্চারণে ত্রুটি-বিচ্যুতি হচ্ছে। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ড. কাজী দীন মোহাম্মদ সাহেব আমার মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের প্রধান ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের দু'লাইন কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে আমার উচ্চারণ আড়ষ্টতার বিষয়টি সর্বপ্রথম ধরা পড়ে। আমার ‘নীরব’ লেখাপড়াই কিনা এ জন্য দায়ী। এ কারণে শুধু উচ্চারণেই ভুল হতো না- লিখতে গিয়ে বানানেও প্রচুর পরিমাণে ভুল করে থাকি। রাস্তায় চলতে গিয়ে ‘ধূপখলা' বলে রিক্সায় উঠলে রিক্সাওয়ালা আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝেই ‘রথখলা' নামিয়ে দিত।
এসব ত্রæটি-বিচ্যুতির কারণে সর্বদা আতংকিত থাকতাম। আরবিতে দোয়া-কালাম পাঠ করতে গিয়ে, ‘সৎকার্য’ করতে কখন না জানি ‘বদকার্য’ করে বসি। এক সময় মনে করতাম- স্বর্গ পেতে হলে ভালো আরবি জানতে হবে। ভাল আরবি না জানার ফলে পরকালে স্বর্গ প্রাপ্তি আর ইহকালে আল্লাহ প্রাপ্তি দুটোই আমার কাছে সমান অনমনীয় ও কঠিন মনে হতো। সব সময় মনে করতাম, আরবি জানা ভালো মৌলবী-মাওলানা ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষের স্বর্গ প্রাপ্তি রেডক্রসের লক্ষ টাকা মানের লটারি প্রাপ্তির চেয়েও জীবনে কঠিন। কঠিন মনে হওয়ার আরো কারণ ছিল, তা হলো হাই স্কুল আমি যে গ্রামে কাটিয়েছি সে গ্রামে একটি বড় মাদ্রাসা ছিল। টাকা কড়ি উঠানোর জন্য প্রতি বছর ওয়াজ-নছিয়তের আসর বসতো।

বিশিষ্ট বক্তাগণ তাঁদের বাকচাতুর্যের দ্বারা মর্মান্তিক ভাষায় নরকের বর্ণনা করতেন, যে নারীলোকের কণ্ঠস্বর যতো দূরে যাবে মরার পর গজবের ফিরিস্তাগণ সে নারীলোকের জিব্বা টেনে বের করে ততো দূরে নিয়ে আগুনের শলাকা দিয়ে পুতে রাখবে। ধর্ম-কর্মের সময় সামান্য ত্রæটি-বিচ্যুতি হলেও ক্ষমা নেই মৃত্যুর আগে ভয়ংকর দর্শন আজরাইলকে দেখে দেহের আত্মা পালানোর জন্য দেহের আনাচে-কানাচে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না- বড় কঠিন ও নির্মম পদ্ধতিতে এমনভাবে আত্মাকে দেহ থেকে বের করে আনা হবে যেমন করে মহিলারা বাইন মাছের ছাল থেকে বাইন মাছ বের করে আনে। এসব বয়ান শুনে সদর-অন্দরে কান্নার রোল পড়ে যেত। একইভাবে আবার বেহেস্তের বর্ণনা আরম্ভ করতেন। ওসব শুনে রাতে ঘুমানোর আগে পরে স্বর্গ- নরক নিয়ে ভাবতাম। ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠতাম। শবেবরাত ও শবেকদরের রাতে বিশেষ নামায আদায়ের কঠিন পদ্ধতির কথা শুনে ভয়ে হীম হয়ে যেতাম।
নানাভাবে যোগ-বিয়োগ করে দেখেছি- মরণের পরে পুণ্যবানদের জন্য চির সুখের আবাসস্থল স্বর্গ প্রাপ্তি বড়ই কঠিন কাজ। সব রকম পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা হবে পুলসেরাতের পুল পার হওয়ার পরীক্ষা। হীরার মতো ধার এবং চুলের মতো সরু পুলসেরাতের পুলের এক পাড়ে থাকবে হাসরের মাঠ আর অপর পাড়ে থাকবে স্বর্গ। ভয়ংকর পুলের তলায় থাকবে তলাহীন আগুনের নরক। অথই নরক থেকে আগুনের লকলকে জিহবা পুলসেরাতের পুলের কাছাকাছি চলে আসবে। পুণ্যবানেরা এ ভয়ংকর পুল পার হয়ে গেলেও পাপিষ্ঠরা টপাটপ্ নরকে পড়ে যাবে। আল্লাহর সকল আদেশ নির্দেশ নির্ভুল- নিপুণতার সাথে, সুচিহ্নিত-সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে, কঠিন-কঠোর নিয়ম-কানুন ও রীতি-নীতির মাধ্যমে ডাকার মতো করে ডাকতে পারলেই আল্লাহ শুনবেন নয়তো শুনবে না। তাই, আমার কাছে ইহকালে পুণ্যবান হওয়াটা পরকালের পুলছেরাত পার হওয়ার চেয়েও কঠিন ছিল। ঠিক যেনো, এক ব্যাগ বারুদের ভেতরে রাখা তাজা একটি বোমা হাতে করে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়া, যা সামান্য নড়াচড়াতেই বিষ্ফোরিত হয়ে যেতে পারে। বোমাটি না ফুটিয়ে গন্তব্যে পৌছতে পারলেই যেন স্বর্গ। আমি শুধু আমার পচা কাঠের তরণী ও শিমুল কাঠের হাল-মাস্তুল, এই নিয়ে স্রষ্টার গাঢ়-নিবিড়, অনমনীয়, কঠিন-কঠোর ও ঝড়-ঝঞ্ঝাটময় বিধিশাস্ত্রের উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল অথই সাগরের ক‚ল- ল-কিনারা প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেতিবাচক মনে করে পরম করুণাময়ের করুণাধারার আশায় তাঁর অসহায় সৃষ্টির প্রতি সামান্য ইতিবাচক দৃষ্টিপাতের চেষ্টা করে থাকি।

আপনার ধারণা সঠিক নয়। ঐটা ছিল মাদ্রাসার টাকা আদায় করার একটা কৌশল মাত্র। দর্শক-শ্রোতার হৃদয়-মন আতংকিত না করতে পারলে টাকা বের হয় না। স্বর্গ-নরকের বয়ান শুনে মহিলাগণ কানের সোনা খুলে হজুরের হাতে দিয়ে ফেলে। কালেকশনের টাকা থেকে মাওলানাগণ একটা পার্সেন্টেজ পায়।
- তা হলে এটাও তো এক প্রকারের ছিনতাই। আতংক সৃষ্টি করে সোনা- গয়না ও টাকা-পয়সা একজন আদায় করে ‘স্বর্গ-নরক’কে হাতিয়ার করে, আর রাস্তার ছিনতাইকারীরা আদায় করে ‘ধাতব অস্ত্রকে’ হাতিয়ার করে। উভয় কাজে হাতিয়ার ভিন্ন হলেও আদায়ের পদ্ধতি অভিন্ন। এ কাজের জন্য আদায়কারী মাওলানা সাহেবের যদি অপরাধ না হয় তবে রাস্তার ছিনতাইকারীর অপরাধ হবে কেন?
-
- একটা করা হয় সৎ কাজের জন্য, আর অন্যটা করা হয় অসৎ কাজের জন্য। আল্লাহর পথে আনার জন্য যে কোনো রকমের কথা বলা অন্যায় নয়। “আল্লাহর পথে আনার জন্য যে কোনো রকমের কথা বলা অন্যায় নয়’ শুনে মনে হলো, তোমার তরীও তরতর করে তটিনীর এমন এক তীরে তসরিফ রাখতে যাচ্ছে যে তীরে থাকবে না তাওহিদের তাহাজ্জত, তপ-তপস্যা এবং তপস্বী-তপোবন, সে তীরে থাকবে কেবলই তমিস্র-তমস, তক্ক-তর্জন, তূর্য- তুবড়ি এবং তাকত-তলোয়ার। শৈশবে যাদের মুখে স্বর্গপ্রাপ্তির কঠিন-কঠোর বন্ধুর পথের বিবরণ ও নরকের ভয়ংকর-বীভৎস বর্ণনা শুনে ভয়ে কলজে হীম হয়ে পড়েছিল বার্ধক্যে তাদেরই পেশির তাকত ও হাতে তূর্য-তলোয়ার দেখে হীম হওয়া কলজে আতংকে ছিঁড়ে যেতে চাইছে।
- আরে ভাই ওরা হলো ভাড়াটিয়া মাওলানা। ওদের ভাÐারে সব ধরনের ওয়াজ রয়েছে। একজন তার বউকে বশ করার জন্য তাদের দাওয়াত করলে তারা সূরা-কালাম দিয়ে বউকে এমনভাবে বশ করে দিয়ে যাবে- যার ফলে অবাধ্য বউ স্বামীর বাধ্য হয়ে পায়ে মাথা না রেখে ঘুমুতেই যাবে না। ‘স্বামীর উপর স্ত্রীর কর্তৃত্ব' এ বিষয়ের আলোকে বক্তৃতা করে রাত পার করে স্বামীকে স্ত্রীর বিড়াল বানিয়ে দিতে পারে।

কথাটি সত্য। আর এ কারণেই যতোই তাদের ফরমায়েসি বক্তৃতা বাড়ছে ততোই তাদের মূল্যায়নের পরমায়ু কমছে। দিশাহারা হয়ে এখন তাদের অনেকেই হাতে তুলে নিয়েছে তলোয়ার। সারা বিশ্বে এখন কারা বেশি বোমা ও তলোয়ার বহন করে প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা দিতে পারবে?
- আপনি তো শায়েখ আবদুর রহমানকেই দেখাবেন?
জী হ্যাঁ, তাকেই দেখাব। খাল কেটে প্রথম কুমিরটা সে-ই এনেছে। ওয়াহাবি মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৌলবাদী স¤প্রদায়ের মধ্য থেকে চরমপন্থী একটা গ্রæপ দেশের প্রচলিত সংবিধান, শাসন ব্যবস্থা, আইন-কানুন ও রীতি- নীতিকে কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী ও তাকদি আখ্যায়িত করে। তাকদি আইনের রক্ষক, ধারক, পোষক, বাহক ও অনুসারীদের সমূলে উৎপাটনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তারা নির্দ্বিধায় শায়েখদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। মাজার দরবার ও খানকা শরীফ নির্মূলসহ গফুর চিশতি পীরের মাজারের পাঁচজন খাদেম হত্যা, ঝালকাঠিতে বিচারক হত্যা, গাজিপুরে আইনজীবী হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার হত্যা, ড. হুমায়ূন আজাদের উপর হামলাসহ সারা দেশে এক সাথে নজীরবিহীন সিরিজ বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জেএমবি প্রধান শায়েখ রহমানের সরল স্বীকারোক্তি আমাদের অস্তিত্বে নাড়া দিয়েছে। (দিল্লি, আগ্রা ও আজমির গ্রন্থ থেকে)। শায়েখ আবদুর রহমান মদিনায় লেখাপড়া করেছেন, কিছুকাল অধ্যাপনাও করেছেন মদিনার কোনো এক মাদ্রাসায়। তা হলে কি আমরা ধরে নিতে পারি না যে, এর শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। আমি আপনাকে বেলতলা নিতে না পারলেও আপনি এই নেড়াকে ঠিকই তালতলা নিয়ে হাজির করেছেন।
- কি রকম?
শিরক-বিদাত দূর করার আন্দোলনকে সমর্থন করায় আপনি দেখছি আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে না ঝুলিয়ে ছাড়বেন না।
- শৈশবে ধর্মকে কাল্পনিক বোমা ভেবে আতংকিত থাকতাম, আর এখন ধর্মের কিছু কাÐারি-কর্ণধারদের তাজা বোমা বহন করতে দেখে আতংকিত থাকি- যাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এতো আলিশান আয়োজন তাদের দূরপনেয় শক্তির রিমোট কন্ট্রোলে আর কতকাল আতংকিত থাকতে হবে তা কেউ বলতে পারে না। ধর্মের দিক দিয়ে তোমরা রুই-কাতল আর আমরা চুনোপুঁটি। তোমাদের বাস সাগরে আর আমরা থাকি খাল-বিলে। খাল-বিলে বাস করা চুনোপুঁটিদের নিয়ে কি খেলা খেলতে চাও- তা তোমরাই জানো।
চুনোপুঁটি হয়ে এতোদূর আসলেন কি করে? শুনেছি বাড়িতে মসজিদ দিয়েছেন, জুম্মার দিন মসজিদে বয়ানও করেন। আপনার বয়ান শোনার জন্য শতশত লোক হয়।

তোমার কথা সঠিক। তা করতে গিয়েই ধর্মের সহজ পথের সন্ধান পেয়েছি। জানতে পেরেছি- ইসলাম মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো ধর্ম নয়। নিজের এবং অপরের কল্যাণের জন্য, সুখময় পরিবারের জন্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ-সবল জীবন যাপনের জন্য, সুশৃঙ্খল ও উন্নয়নশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, নৈতিক ও আদর্শ চরিত্র গঠনের জন্য, দেশ ও জাতির নিরাপত্তার জন্য সর্বোপরি যার কারণে আমরা মাখলুকাতের মুকুট পরতে পেরেছি তার শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করার জন্য যা যা করা ও বলা দরকার তা তা করা ও বলার সমষ্টিই শান্তির পথ বা ইসলাম।
- তা এতো বিলম্বে জানলেন কেন?
- ই যেমন হজ্জব্রত পালন করার সময় বলা হয়ে থাকে
‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি হাজির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং বিশ্বব্রহ্মাÐও তোমারই। তোমার কোনো শরীক নেই।'
যার দ্বারা মাখলুকাতের মুকুটসহ বেঁচে থেকে সুখ ভোগের জন্য এতোকিছু পেলাম তার শ্রেষ্ঠত্বসহ এতোটুকু আনুগত্য স্বীকার না করলে চরম নাফরমানী ছাড়া আর কি হতে পারে। কা'বা শরীফ তাওয়াফের সময় ‘হে আমার প্রতিপালক! দুনিয়াতে ও আখেরাতে আমাদের কল্যাণ দাও, আমাকে হালাল রুজির সুযোগ করে দাও, হে প্রভু তুমি আমাদের শান্তিময় জীবন দান করো।'

উপরের কথাগুলো তো আমাদের শুধু পরকালের কল্যাণের জন্য নয় ইহকালের কল্যাণের জন্যেও এসব করার আগে ইহরাম বাঁধার নিয়মটি আমাদের হাতে-কলমে মৃত্যু পথ যাত্রীর শেষ বসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেসব লোক হজ্জ্বব্রত পালন করতে যায় তাদের অধিকাংশই ধনাঢ্য। সাধারণত ধনাঢ্য লোকদের মধ্য থেকেই বের হয় অত্যাচারী ও জুলুমবাজ। আর গরিব মানুষের হক মেরে তাদেরই কেউ কেউ ধনবান হয়। ইহরামের পরিচ্ছদ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- পৃথিবীতে কেউ অমর নয়, তোমার পূর্ববর্তীদের সবাই চলে গেছে, তুমিও যাবে, একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীদেরও চলে যেতে হবে, আর যেতে হবে ইহরামের মতো সেলাইহীন নতুন শ্বেতবস্ত্র পরিধান করেই। কা'বা শরীফের মাঠে এবং আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে বিশ্বের সাদা-কালো ও লম্বা-বেঁটে মানুষগুলো একত্রিত হওয়ার কারণ, বিশ্বের সবার সাথে সহমর্মিতা, সহানুভ‚তি ও ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হওয়ারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একই ভাবে আমাদের অবশ্য পালনীয় নামায, রোজা, হজ্জ ও যাকাত সম্পাদনের রীতি-নীতি ও পালন পদ্ধতি শুধু পরকাল নয়, কোনো না কোনো ভাবে ইহকালের জীবন ব্যবস্থায়ও উপকার করে থাকে। আমাদের ধর্মে এক ফোঁটাও বিষ নেই, আছে অফুরন্ত মধুর ভাÐার। একবার মধুর সন্ধান পেলে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পান করতে শুরু করবে। দোজখের ভয় আর স্বর্গের প্রলোভনের দ্বারা নির্বোধ মানুষকে বোধ জাগ্রত করার অপচেষ্টা না করে ইসলাম জীবনের ধর্ম, জীবনের প্রতিটি ভালো বিষয়ের সাথে ইসলাম সংশ্লিষ্ট' এ বিষয়গুলো প্রচার করা আবশ্যক। ইসলামের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ইহকালে সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিময় জীবন আশা করা যায় না।

আমার নিজ গ্রামের শতবর্ষের পুরানো মসজিদটি মেঘনাগর্ভে তলিয়ে গেলে ঘটনাক্রমে নতুন মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব চলে আসে আমার উপর। আমি (আমার কাছে এ কাজটি নতুন) দায়িত্ব পেয়ে ২৫.০১.২০০৮ ইং তারিখে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ০৬.০৬.২০০৮ ইং তারিখের মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নজরকাড়া একটি মসজিদের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করে ফেলি। একাজ করতে গিয়ে নতুন নতুন দু'টি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে তা হলো এদেশের মানুষ ধর্মকে প্রিয়জনের চেয়েও বেশি ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে। মানুষের জীবণ ধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। মানুষের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারলে, জীবণ ধারণের একানান্ত উপাদানও ধর্মীয় দানের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। যেখানে আমার মতো একজন আনকোরা মানুষ নিজের পকেটের এক টাকাও খরচ না করে মাত্র চার মাস এগার দিনের মধ্যে মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রায় দশ লক্ষ টাকা উত্তোলন করতে পেরেছি, সেখানে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অনলবর্ষী বক্তাগণ স্বর্গ-নরকের কথা বলে কি পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়টিকে অভিজ্ঞতা না বলে নতুন জ্ঞানলাভ করা বলা যেতে পারে। তা হলো, শুধু এবাদতখানা নয় পরামর্শালয়ও, আর ইসলাম শুধু পরকালের কল্যাণের জন্যে নয়- ইহকালের কল্যাণের জন্যেও। ইহকালে অমঙ্গলের ভেতর থেকে পরকালের মঙ্গল চর্চা যথাযথভাবে সম্পাদন করা যায় না। 

মধ্যযুগের বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সুফি ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেছেন, 'কোনো লোকের যদি আহারের জন্য খাদ্য, পরনের জন্য কাপড় ও বসবাসের জন্য গৃহ না থাকে অথবা ঐ সমস্তের জন্য তার পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে, তবে তার পক্ষে আল্লাহর ইবাদত করতে যাওয়া মাতলামি ছাড়া কিছুই নয়।' নবী করীম (স.)- এর নিজ হাতে তৈরি মসজিদ-এ-নববীতে শুধু পারলৌকিক কল্যাণের জন্য এবাদত চর্চা হতো না- সমাজকল্যাণমূলক সকল কর্মকাÐই পরিচালিত হতো এখান থেকে।

আমাদের কথাবার্তার মাঝে ফজরের নামায আদায়ের সময় হয়ে যায়। আমার বহুদিনের স্বপ্নের নববী মসজিদে জীবনের প্রথম ফজর নামায আদায়ের মজাই আলাদা। ওজু করাই ছিল। নামায আদায় শেষে-
এবার বলো, আমার সাথে ছবি উঠাতে এতো আগ্রহের কারণ কি?

আমি জানি আপনি আরবের ওপর কিছু লিখবেন। আপনার লেখাটি হাজীদের অনেক উপকারে আসবে। সেই গ্রন্থে আমার ছবিটাও ঠাঁই পাবে। জীবনে আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজকের সময়টা।
তোমার আমার ছবি যে মসজিদে নববীর পাশে তোলা হয়েছিল তা কি করে বুঝবে?
নজরুল ডান দিকে হাত ইশারা করে
-ঐ দিকে তাকান, নবীজী (স.)-এর মাজারের ওপর যে সবুজ রঙের একটি গম্বুজ রয়েছে তা বিশ্বের আর কোথাও নেই। এই সবুজ গম্বুজ বলে দিবে আমরা দুজন নববী মসজিদে একত্রিত হয়েছিলাম। আর ছবি তোলা হবে মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে। সুন্দর ছবির দরকার নেই। আমরা আমাদের ছবি চিনতে পারলেই হলো।
তুমি এতক্ষণ যাদের পক্ষে ওকালতি করেছÑ তাদের অনেকে বইয়ের ভেতর মানুষের ছবি দেখলে পড়া তো দূরের কথা ছুঁয়েও দেখবে না। একবার সুফিতত্ত¡ বিষয়ে লেখা একটি বই প্রচারের জন্য স্থানীয় কয়েকটি মসজিদে বিনা মূল্যে বিলি করেছিলাম। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখক পরিচয়ের উপরে পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি ছিল। তা দেখে একজন বইটি মসজিদের বাইর থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে।

-এর কারণ দুটি, অতি ভক্তি কিংবা অতি নির্বুদ্ধিতার কারণে অনেকে এ রকম করে থাকে। কা'বা এবং নববী মসজিদের ইমামগণ নামায আদায় করা কালে কয়েক ডজন টিভি ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করা থাকে। টিভি চ্যানেলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদের ছবি দেখে। পরদিন পত্রপত্রিকাসহ হাজার হাজার ভিডিও সিডিতে ও পত্র-পত্রিকায় তাদের ছবি প্রকাশিত হয়। প্রতিটা টাকার ওপর রয়েছে এ দেশের বাদশাহের ছবি। প্রতি বছর হজ্জের সময় হজ্জের ধারাবিবরণী টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়। তখন তো ধর্ম নষ্ট হয় না।
আর প্রকাশিত বইয়ে লেখকের ছবি ছাপা হলেই ধর্ম চলে যাবে, কথাটি মোটেও ঠিক নয়।

ঠিক বেঠিক বুঝি না, যে লোক তিন দিনের ছুটি নিয়ে একটি ছবির মাধ্যমে নিজকে ধরে রাখার জন্য সুদূর রিয়াদ থেকে এখানে ছুটে এসেছে তার ছবি এ গ্রন্থে থাকবে। মানুষের ছবি প্রকাশের ফলে এ গ্রন্থ কেউ না পড়ুক কিংবা না ধরুক এবং গ্রন্থের মান যাই হোক, ছবি আমি ছাপিয়ে দিলাম। কারণ আমার কাছে-
“গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই
নহে কিছু মহিয়ান।” (সমাপ্তি)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক