Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:৫৮, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

প্রবন্ধ

হকদার বটে

হকদার বটে
ছবি: সবার দেশ

মানব সভ্যতার কল্যাণে মক্কায় নির্মিত হয়েছিলো কা'বা। রাসূল (স.)-এর জন্ম মক্কা নগরে হলেও পরিণত বয়স অতিবাহিতসহ পরলোকগমন করেন মদিনায়। পবিত্র এ দুই নগরে ইসলাম ও ইসলামের প্রচারক হযরত মুহম্মদ (স.)-এর স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান ও স্থাপনা রয়েছে। মূলত মক্কাতে ‘আল্লাহর ঘর’ আর মদিনায় ‘রাসূলের (স.) রওজা শরীফ' এ কারণেই এ দুই নগর বিখ্যাত। এ দুটি বিষয়কে ঘিরেই সকল প্রকার ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনার আবর্তন-বিবর্তন।

প্রাচীন কালের ইসলামিক নিদর্শন ও স্থাপনা বলতে মসজিদকেই বুঝায়। যেসব মসজিদ নির্মাণের পেছনে কোনও না কোনও ভাবে নবী করিম (স.) কিংবা তাঁর জীবনের বিশেষ কোনো কর্ম জড়িয়ে রয়েছে সেসব মসজিদ ও স্থাপনা দর্শন এবং স্পর্শ করার জন্য মুসলমান মাত্রই উন্মাতাল। মানুষ যেমন করে অতি প্রিয়জনের স্মৃতি সংরক্ষণ করে তেমন করে মুসলমানগণও সম্মানে রাসূল (সা.)-এর স্মৃতি সংরক্ষণ করে আসছে। 

মুসলমানগণ তাঁদের প্রিয় মানুষ বিশ্বনবী (স.) যেখানে নামায আদায় করতেন, যেখানে ওজু-গোসল ও বিশ্রাম করতেন সেখানেই পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সাথে মসজিদ নির্মাণ করে হাজার বছর ধরে সংরক্ষণ করে আসছে। শুধু আরবে নয়, দিল্লির জামে মসজিদে রয়েছে নবী করিম (স.)-এর পায়ের চটি, চিবুকের দাড়ি ও আজমিরে রয়েছে সমাধির গিলাফ। 

ইউরোপের কনস্টান্টিনোপলের ওসমানীয় গুপ্ত ভান্ডারের মূল্যবান সম্পদ হলো মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জামা, যষ্টি, তরবারি, তীর, ধনু এবং পতাকা। রাশিয়ার যাদুঘরে রয়েছে জায়েদ বিন সাবিতের হাতের লেখা প্রথম কোরআন শরীফ। অর্থাৎ বিশ্বনবীর হাতের ছোঁয়া লাগা এবং শরীরের চুল-দাড়ি যেখানে যা পাওয়া গেছে সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে যা কেয়ামতের আগ পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

ইসলামের অঙ্কুরোদ্‌গম মক্কায় হলেও এটি বিকাশ, বিস্তার ও পূর্ণতা লাভ করেছে মদিনায়। তাই নানা কারণে মক্কার চেয়ে মদিনায় ইসলামিক নিদর্শন ও স্থাপনার পরিমাণ বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর ঘর দেখার জন্য মক্কায় সমবেত হয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এর সমাধিস্থল মদিনা দর্শন না করে কেউ ফিরেন না।

হজ্জ আদায়ের জন্য মদিনায় রাসূল (সা.)-এর সমাধি যিয়ারত বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ুক কিংবা না পড়ুক তাতে কিছু যার আসে না, যিয়ারতকারীগণ তাঁদের প্রাণপুরুষ কখন কোথায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন, কোরেশদের ভয়ে কোন পাহাড়ের কেমন গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন, মদিনায় গিয়ে প্রথম কোনখানে নামায আদায় করেছিলেন, কোন খানে তাঁর প্রিয়জনেরা চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন এবং তাঁর হাতের ছোঁয়া লেগে রয়েছে কোন কোন স্থাপনায়, তা খুঁজে খুঁজে বের করেন। বর্তমান সরকার ইসলামের স্মৃতিবাহী বিশেষ করে মসজিদগুলো সংস্কার ও সংস্করণের দ্বারা আধুনিকায়ণ করে রেখেছেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত মুহম্মদ (স.) একাধারে শিশুদের খেলার সাথী, সন্তানের স্নেহবৎসল পিতা, প্রেমময়ী স্বামী, সফল ব্যবসায়ী, মহান সংস্কারক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, সুদক্ষ সেনাপতি, নিরপেক্ষ বিচারক এবং সর্বোপরি একজন সফলকাম আল্লাহর নবী।

ঐতিহাসিক লিউনার্ড বলেছেন, পৃথিবীর মধ্যে যদি কোনও মানুষ আল্লাহকে দেখে থাকেন, বুঝে থাকেন ও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কোনো উপকার করে থাকেন, তবে সেটা নিশ্চিত যে, তিনি আরবের ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (স.)। এমন একজন মহামানবের স্মৃতিচিহ্ন ও জীবনাদর্শের দিকে শুধু মুসলমানগণ নয়, হাজার হাজার অমুসলিম সমাজসেবক, কবি- দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিস্ময়াবিভ‚ত হয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকেন। 

আমার স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে আমিও প্রিয় নবী (স.)-এর স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও স্থাপনা খুঁজে খুঁজে বের করে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকেছি ও সাধ্যমতো ইতিবৃত্তের সন্ধান করেছি। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, ‘হাজার বছর আগের হজ্জ, আর বর্তমানের হজ্জ’ ধর্মীয় মূল্য অপরিবর্তিত থাকলেও পরিবর্তিত হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। আমরা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, জেনে কিংবা না জেনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জঠরে ঢুকে রয়েছি। এ কারণেই নয় মাসের হজ্জব্রত মাত্র নয় দিনে শেষ করছি। ‘প্রযুক্তি’ যেভাবে সময় ও শক্তিকে খাটো করে দিয়েছে ‘পদ্ধতি’ সেভাবে খাটো করতে না পারলে প্রযুক্তি ও পদ্ধতির মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হবে। বিভেদের ফলে যে ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে আমি সে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি থেকে সমাধানের পথ খুঁজেছি। আমার নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি থেকে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে চেষ্টা করা সঠিক না বেঠিক তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন।

আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি, আমার মতো আরবি না জানা লোকদের, যাদের পদে পদে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, আরবি না জেনে যারা হজ্জ ব্যবসায়ীদের ব্যবস্থাপত্রের দ্বারা হজ্জব্রত পালন করতে যান এবং মক্কা গিয়ে ভাড়া করা আলেম-মালুম দিয়ে কানের কাছে উচ্চারিত সূরা-কালাম পাঠ করে উদ্দেশ্য সাধন করেন, আমার ভুলের মতো তাদের কৃত ভুলসমূহ যদি পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা সীমাহীন করুণার বশবর্তী হয়ে মাফ করে দেন তবেই রক্ষা। নয়তো আমাদের মতো লোকদের সহি-শুদ্ধভাবে হজ্জব্রত পালন করার পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন আর বিদ্যমান নেই।

কারণ, বর্তমানে প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতির ভাড়া করা আলেম রেখে তওয়াফ কালে কানের কাছে উচ্চারিত দু'আ শুনে শুনে সঠিকভাবে উচ্চারণ করাসহ কা’বা প্রদক্ষিণ করার সময় এখন আর নেই। তা করতে গেলে হাজারো তওয়াফকারির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত কয়েক বছরে শয়তানকে পাথর মারতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে অনেক হাজীর মৃত্যু হয়েছে। 

হজ্জব্রত পালন করা যেমন ফরজ, জান বাঁচানো তেমনই ফরজ। হজ্জ্বব্রতের ফরজ সার্বজনীন না হলেও জান বাঁচানো ফরজটা সার্বজনীন। তাই গোমড়া মুখে ওমরা পালন করাই আমার লক্ষ্য ছিলো না- লক্ষ্য ছিলো, হাল আমলে আমার মতো ভাষাবুদ্ধুরা ডিজিটাল (আঙ্গুলির সাহায্যে সম্পাদিত) যুগে ক্রিটিক্যাল (সংকটপূর্ণ) সময়ের ভেতর এনালগ (সেকেলে) পদ্ধতিতে সম্পাদিত হজ্জব্রত ক্রেডিবল (বিশ্বাসযোগ্য) করতে গিয়ে কি প্রকারের ভুল-বিচ্যুতিসহ হয়রানির শিকার হয় তার কিছু বিষয় চিহ্নিত করা।

আমি ১৪.৯.০০৯ খ্রিস্টাব্দ সন্ধ্যায় সৌদী এয়ার লাইনসের বিমানে করে মক্কার প্রধান বিমান বন্দর জেদ্দায় অবতরণ করি এবং মদিনা বিমান বন্দর থেকে ২৫.৯.০০৯ সন্ধ্যায় একই বিমানে করে মদিনা ত্যাগ করি। ওই ১১ রাত ১১ দিনের মধ্যে মক্কা-মদিনার মসজিদ (হারামাইন শরীফাইন) ও এর প্রধান সংযোগ সড়কের দুপাশে দৃষ্টিপাত (বার্ডস আই ভিউ)সহ দুই নগরীর চারপাশের ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও স্থাপনা যতোটুকু দেখা সম্ভব হয়েছিল এ পুস্তিকায় ঠিক ততোটুকুর মূল্যায়ন ও বর্ণনা করেছি।

একজনের দৃষ্টি ও চেতনার সাথে অন্যজনের দৃষ্টি ও চেতনা ভিন্ন হওয়ার কারণে আমার দেখা স্থাপনাদির বর্ণনার সাথে অন্যজনের বর্ণনার গড়মিল হতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দূরত্ব, আকার, আয়তন ও পরিমাপ নির্ণয় করার জন্য আমি মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। এ কারণে আমার নির্ণীত পরিমাপ প্রকৃত পরিমাপের সাথে সম্পূর্ণ মিল নাও হতে পারে। এ জাতীয় ভুল দিক বর্ণনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। মনের অজান্তে বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে স্থান-কালসহ তত্ব ও তথ্যাবলিতেও ভুলভ্রান্তি থেকে যেতে পারে।

মরুভূমিতে বাস করে মহাসমুদ্দুরের গভীরতা নির্ণয়ের চেষ্টা করা যেমন হাস্যকর, তেমনই হাস্যকর আমার দ্বারা মক্কা-মদিনার সার্বিক অবস্থাসহ তদস্থিত ইসলামিক স্থাপনা ও কৃষ্টির বর্ণনা করা। যারা ধর্মের মহাসমুদ্রে বাস করেন তারা প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় লিখতে পারেন না- কিংবা লেখেন না। আর মাতৃভাষায় বিদগ্ধ লেখকগণ মহাসমুদ্দুরকে নিয়ে লেখার অনুকূল পরিবেশ পান না কিংবা লেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন না। 

আমি আরবদেশে যাত্রার আগে যিয়ারত ও তওয়াফের নিয়ম-কানুনসহ ইসলামিক স্থাপনা ও কৃষ্টি সম্পর্কে জানার জন্য বহু বই-পুস্তক অনুসন্ধান করেছি। বহু অনুসন্ধান করেও মনের মতো বই-পুস্তক পাইনি। হজ্জ ও যিয়ারত বিষয়ে যেসব পুস্তিকায় বাজার সয়লাব সেসব পুস্তিকা পাঠ করে দোয়া-দরুদ শিক্ষাকরণ ছাড়া তেমন কোনও লাভ হয় না। দোয়া-দরুদের বই পাঠ করে কিংবা গাইড হিসেবে সাথে রেখে বিদেশ বিভূঁইয়ে নানা প্রকারের বিপন্ন বিচ্যুতির হাত থেকে মুক্তির উপায়ও বের করা যায় না। এসব পুস্তিকা থেকে বরং ভুল করার আতংক বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। যিয়ারতকারীগণ আতংকিত মন নিয়ে স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে ইসলামিক স্থাপনা দেখতে গিয়ে ভেল্কিবাজীর মতো কি দেখলেন না দেখলেন কিছুই ঠাওর করতে পারেন না। 

আমি একজন আনকোরা হিসেবে যেসব সমস্যায় পতিত হয়েছি, আমার মতো আনকোরাগণ যাতে সেসব সমস্যায় পতিত না হোন, সে উদ্দেশ্যে একদম আনাড়ি অবস্থায় ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এক কথায় বলা চলে অনধিকার চর্চায় হাত দিয়েছি। আমাদের দন্ডবিধি আইনে এমন কিছু ধারা রয়েছে যেসব ধারার অধীনে হত্যাকান্ডের মতো কান্ড ঘটে গেলেও কাউকে হত্যার দায়ে দায়ী করা হয় না। তা হলো, সরল মনে কারও কোনও কল্যাণ সাধন করতে গিয়ে অপ্রনিধানবশত অকল্যাণ হয়ে যাওয়া। আমিও সরল মনে আমার মতো আনকোরাদের সার্বিক মঙ্গলের দিক লক্ষ্য রেখেই এ রকম স্পর্শকাতর দুঃসাহসিক কাজে হাত দিয়েছি- অপ্রনিধানবশত ভুল-ত্রুটি হতেই পারে। (ভুল-ত্রæটির বিষয়ে সুহৃদ ও হিতৈষীর সুপরামর্শ পেলে পরবর্তীকালে তা শুধরে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ রইলাম) তাই আমি আমার এ কাজের জন্য ধন্যবাদ না পেলেও ভুলত্রুটির জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষমা পাওয়ার হকদার বটে।

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক