প্রবন্ধ
মক্কা ও কা’বা
(১ম র্পব)
(আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত)
বিশ্ববিধাতা বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসীদের বিশেষ কল্যাণে বিশ্ববিমোহী কা'বাগৃহ নির্মাণের প্রমাণ রেখেছেন তার মহামহিমান্বিত কোরআনুল কারিমে সূরা আল- বাকারার ১২৫ ও ১২৬ নং আয়াতে। ১২৫ ও ১২৬ নং আয়াতের অনুকরণে কা'বা নির্মাণের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর নিদের্শাবলী ছিল নিম্নরূপ-
আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন কা'বাগৃহের স্থানে বিশ্বজনের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং মোনাজাতসহ আবেদন নিবেদনের জন্য মসজিদ নির্মাণ করি তখন নির্দেশ দিয়েছিলাম, তোমরা (ইব্রাহিম ও ইসমাঈল) ইব্রাহীমের অবস্থানের স্থানটিকে নামাজ আদায়ের জন্য রূপান্তরিত কর। ইব্রাহিম ও ইসমাঈলকে এ মর্মে শপথ করালাম, তারা যেন আমার ঘরকে সম্মানের সাথে প্রদক্ষিণসহ ইবাদত-বন্দেগীর নিমিত্তে সর্বদা বিশুদ্ধ রাখে। উত্তরে ইব্রাহিম (আ.) বলেন “হে আমার প্রতিপালক, তুমি এ শহর (হারাম এলাকা) কে নিরাপত্তাসহ যারা তোমাকে তোমার পরকালকে বিশ্বাস করে তাদের খাদ্য,বস্ত্ৰ ও স্বস্তি দিও। আল্লাহ বলেন ‘অবিশ্বাস স্থাপনকারিগণও ভোগবিলাসের সুযোগ পাবে- তবে তা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য- এক সময় আমি তাদের স্থায়ীভাবে কঠিন শাস্তির জন্য নিকৃষ্টতম স্থানে ঠাঁই দেব।
কা'বার সম্মান ও আদিকথা: মক্কা ও কা'বা অঙ্গ ও আত্মার মতো। কা’বা নামের আত্মা সৃজন করার পরই বিশ্বব্রহ্মান্ডের হৃদকম্পন শুরু হয়। সৃষ্টিকর্তা কা'বার এ স্থানটি তাঁর নিজের ঘরের জন্য পছন্দ করেছেন। কা'বা এলাকা ‘হারাম’ সাব্যস্ত করা হয়েছে প্রাক্ ইসলাম অর্থাৎ মানব সভ্যতার বহু আগে। আর মদিনা মনোয়ারা ‘হারাম’ ঘোষিত হয়েছে নবী করিম (স.)-এর আমল থেকে। হারাম হওয়ার কারণে যখন কোনো প্রাণী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কা'বা ঘরে প্রবেশ করবে সে সব রকম অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাবে। এই প্রথা আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ থেকে চলে আসছিল। তবে হারাম এলাকার ভেতর কেউ কোনো অপরাধ করলে সে সেখানে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পাবে না। কারণ সে হারামের সম্মানহানী করেছে। তবে কেউ হালাল (বাইরে) এলাকায় অপরাধ করে হারামের ভেতরে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাকে চাপ দিতে হবে যাতে সে হারামের সীমানার বাইরে চলে আসে।
শিকারকে ভীতি প্রদর্শন, বৃক্ষ কর্তন, এমনকি হারাম এলাকায় পড়ে থাকা বস্তু উঠিয়েও নেয়া চলবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ পাক বলেন- 'মাকামে ইব্রাহীম। 'যে কেহ এতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হবে। মানবজাতির জন্য সর্বাধিকভাবে সেই নীতি নিষ্ঠ ঘরে হজ্জ করা একান্ত কর্তব্য বলে আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন; যাদের সামর্থ্য আছে অবশ্য তাদের হজ্জ ব্রত পালন করা উচিত। (সূরা আল ইমরান- আয়াত ৯৭)।
নির্মাণকাল: বর্ণিত আছে, কা'বা শরীফ বা আল্লাহর ঘরটি সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ কর্তৃক। দ্বিতীয়বার নির্মিত হয় হযরত আদম (আ.)-এর দ্বারা। তৃতীয়বার নির্মাণ হয় হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর হাতে।
সীমানা: সর্বপ্রথম হযরত জিবরাইল (র.)-এর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) হারামের সীমানাস্তম্ভ স্থাপন করেন। তারপর ইব্রাহিম (আ.) এর সীমানা অপরিবর্তিত রেখে প্রথমে হযরত মুহম্মদ (স.)-এর নির্দেশে তামীম বিন আসাদ আল খুজায়ীর ও পরে হযরত ওমর (র.) চারজন কুরাইশীর মাধ্যমে হারামের সীমানা নির্ধারণ করেন- যা বর্তমানেও অপরিবর্তিত রয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ নিজ হাতে পৃথিবীর মাটিতে আল্লাহর প্রথম ঘর নির্মাণের কারণেই প্রাণহীন বিশ্বব্রহ্মান্ডের বুকে হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল। আল্লাহর ঘর হারাম শরীফকে ছাড়া শুধু আরব নয় সারাবিশ্ব হয়ে পড়বে প্রাণহীন জড়বস্তু। কোনো কোনো লেখক দ্বিতীয়বার নির্মাণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহপাকের নির্দেশে যখন বাবা হযরত আদম (আঃ) দুনিয়ায় আগমন করেন তখন ফেরেশতাকুল এবং হযরত জিবরাইল (আঃ) তাদেরকে পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফের অবস্থান অবগত করান। হযরত আদম ও হাওয়া (আ:) নতুন করে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় বায়তুল্লাহ শরীফকে সেভাবে নির্মাণ করেন যেভাবে ফেরেশতাকুল প্রথমবার বায়তুল মামুরের অনুকরণে নির্মাণ করেছিলেন।
হযরত আদম (আ:) স্বহস্তে দেয়াল গড়ার জন্যে মাটি খনন করেন আর হযরত হওয়া (রা.) স্বহস্তে সেই মাটি সরান। আর এ কাজে নিখুঁতভাবে মানচিত্র এঁকে দেন হযরত জীবরাইল (আ:)। আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, তুমিই প্রথম মানুষ এবং এই ঘরই পৃথিবীতে মানুষের জন্যে প্রথম ঘর- পবিত্র কা'বা শরীফ। আল্লাহ হযরত আদম (আ:) ও হাওয়া (রা.)-কে নির্দেশ দিলেন এ ঘর সাতবার তওয়াফ করে আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া চাইতে। সাত বার তওয়াফ শেষে দোয়া চাওয়ার পর আল্লাহপাক তাদের সব ভুলত্রæটি মাফ করে দেন। মানবজাতির আদিপিতা ও আদিমাতা তাদের সন্তানদের গুনাহখাতা মাফের জন্যে আল্লাহর দরবারে দরখাস্ত পেশ করেন। জবাবে আল্লাহপাক জানান, যারা মুসলমান হয়ে এ ঘরে যিয়ারত ও তওয়াফ করবে এবং তওবা করবে তাদের গুনাহখাতাও ক্ষমা করা হবে।' সেই থেকে কা'বাগৃহে সাতবার প্রদক্ষিণসহ গুনাহখাতা মাফ চাওয়া শুরু হয়েছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক কা'বাঘর নির্মাণের পূর্বাপর কয়েকটি চিত্র পরের পৃষ্ঠায় প্রদর্শন করা হলো।
নামকরণসহ সুলতানী যুগ পর্যন্ত ধারাবাহিক চিত্র: কা'বা শরীফ পবিত্র বায়তুল্লাহ মসজিদের মাঝে অবস্থিত। কা'বার নামকরণ সম্পর্কে আবু নুজাইহ হতে আল-আযরাক্বীর বর্ণনা থেকে জানা যায়-- কা'বার নাম এ জন্য রাখা হয়েছে যে, সেটি পায়ের টাখনু বা গিঁটের হাড়ের ন্যায় অন্য স্থানের চেয়ে উঁচু ছিল। এ জন্য তাকে ‘মুরাব্বাহ' চার কোণা বলা হয়ে থাকে। কারণ কোনো চাদরকে চার কোণা করে ভাঁজ করা হলে তাকে আরবিতে ‘মুআক্কাব’ বলা হয়। ‘মুআক্কাব‘শব্দ থেকে ‘ক্বাব’আ' পরে রূপান্তরিত ‘কা’বা’ নামকরণ হয়েছে। কা'বাকে বাইতুল আতিকও বলা হয়ে থাকে‘। কারণ, আল্লাহপাক কা'বাকে কাফের শাসকের হাত থেকে স্বাধীন করেছেন। নবী (স.) বলেছেন তার ওপর কোনো কাফের শাসক জয়ী হতে পারেনি।' (তিরমিযী হাদীস- ১৩৭০)।ট
এতোক্ষণ বললাম কা'বার সম্মান সম্পর্কে। এবার আসি নির্মাণ ইতিহাসে। দু'চার কথায় কা'বার নির্মাণ ও সম্প্রসারণের ইতিহাস বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কয়েক হাজার বছরের নির্মাণ ও সম্প্রপ্রসারণ কাজ কয়েক কথায় বর্ণনার চেষ্টা আর সিন্ধুকে বিন্দুর মাঝে প্রকাশের চেষ্টা একই রকমের কঠিন কাজ। এতো বড় কাজে ভুল-ত্রæটির ভয়ও কম নয়। তারপরেও পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে শুরু করছি:
সর্ব সম্মতিক্রমে কা'বা নির্মাণের সময়কালকে দু'পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্ব শুরু হয় সৃষ্টির শুরু থেকে এবং শেষ হয় নবী করিম (স.)-এর ২৫ বছর বয়সকাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় খিলাফত কাল থেকে এবং যা চলছে অদ্যাপি।
প্রথম পর্ব (সৃষ্টির শুরু থেকে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)
প্রথম পর্বের নির্মাণকালকে চার স্তরে বিভক্ত করা যায়। প্রথম স্তর: ফেরেশতাগণ কর্তৃক নির্মিত।
দ্বিতীয় স্তর: আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত।
তৃতীয় স্তর: ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক নির্মিত। বর্ণিত আছে ইসমাঈল (আ) মা হাজেরার গর্ভে জন্ম নিলে প্রথম বিবি সারা (রা.) বিরক্ত হন, তিনি ইব্রাহীম (আ.) এর কাছে হাজেরা ও তার সন্তানকে তার দৃষ্টির বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ করেন। ইব্রাহীম (আ.) অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাদের নিয়ে পবিত্র মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন। আজকের দিনে যেখানে মক্কা সেখানে তাদেরকে রেখে দেন। তিনি মাঝে মাঝে তাদের দেখতে আসতেন। এক সময় ইসমাঈল (আ.) জমজম কুয়ার নিকট নিজের পিতাকে দেখে আলিঙ্গন করেন। তখন ইব্রাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.) বলেন-
- আল্লাহ আমাকে একটি আদেশ দিয়েছেন।
- আপনি আপনার প্রতিপালকের আদেশ বাস্তবায়িত করুন।
- তুমি কি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে?
- হ্যাঁ করবো।
আল্লাহ আমাকে একটি ঘর নির্মাণ করতে আদেশ দিয়েছেন।
এ কথা বলার সময় তিনি একটি উঁচু জমির দিকে ইশারা করছিলেন। তারপর তারা দুজনে আল্লাহর ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইসমাইল (আ.) পাথর বয়ে আনতেন আর ইব্রাহীম (আ.) পাথরের উপর পাথর বসিয়ে দেয়াল নির্মাণ করতে শুরু করেন। দেয়াল উঁচু হয়ে গেলে মাকামের উপর ওঠে দেয়াল উঁচু করতে থাকেন। কা'বা নির্মাণের সময় হযরত ইব্রাহীম (আ.) এই পাথরের উপর দাঁড়াতেন। ইব্রাহীম (আ.) এ পাথরের উপর দাঁড়ানো থাকা কালে তৎপুত্র ইসমাঈল (আ.) ইব্রাহীম (আ.)-এর হাতে একটি একটি করে কা'বা নির্মাণের পাথর ধরিয়ে দিতেন। ইব্রাহীম (আ.) কা'বা নির্মাণ কাজ শেষ করতে গিয়ে একটি পাথরের অভাব বোধ করেন। ইসমাঈল (আ.) খালি স্থানটি পূরণ করার জন্য খালি স্থানের মতো আকারের পাথর খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু কোনো পাথরই মিল মতো পাচ্ছিলেন না। তখন ইব্রাহীম (আ.) বলেন-
আমি তোমাকে যে রকমের পাথর আনতে বলেছি তুমি সে রকমের পাথর খুঁজে নিয়ে এসো।
ইসমাইল (আ.) সে রকম সাইজের পাথর খুঁজতে বের হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর পাথরসহ ফিরে এসে দেখেন তার বাবা পাথর স্থাপন করে ফেলেছেন। তখন ইসমাঈল (আ.) জানতে চান-
- আব্বাজান, এ পাথর কে নিয়ে এসেছেন?
- ঐ ব্যক্তি নিয়ে এসেছেন, যে ব্যক্তি তোমার নির্মাণ কাজের মুখাপেক্ষী নন। এটি জিবরাঈল (আ.) নিয়ে এসেছেন। এভাবেই পিতাপুত্র মিলে তৃতীয় বার কা'বা গৃহের নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
আবদুল মোত্তালিবের সময় কা'বা ঘরকে নিয়ে বিরাট ঘটনা ঘটেছিল, ঘটনাটি কুরআনুল কারিমে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ‘আবরাহা আল হাবশী’ নামে তৎকালীন ইয়েমেনে এক শাসক ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি ‘আল-কুল্লায়েস' নামে গির্জা নির্মাণ করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ভক্তগণ যাতে কা'বার পরিবর্তে গির্জার দিকে ফিরে আসে। তা দেখে কেনানী গোত্রের জনৈক ব্যক্তি গির্জায় গিয়ে মল ত্যাগ করে আসে। আবরাহা এ সংবাদ শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হয় ও প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। তার লোক কুরাইশ এলাকায় লুটপাটসহ আবদুল মোত্তালিবের দু'শ উট লুট করে নিয়ে যায়। পরে আবরাহার প্রেরিত হুনাতা আল হিমইয়ারী মক্কায় প্রবেশ করে মক্কার নেতা আব্দুল মোত্তালিবকে আবরাহার নিকট নিয়ে যান। সুদর্শন মোত্তালিব চটের উপর আবরাহের পাশে বসেন। আবরাহা অনুবাদকের মাধ্যমে মোত্তালিবের কাছে জানতে চান-
- আপনি কি চান?
- আমার দু'শ উট ফিরিয়ে দিন।
- আপনি শুধু উটের কথা ভাবছেন, আমি যে ঘর ধ্বংস করতে এসেছি সে ঘরের কথা ভাবছেন না?
-উট আমার, তাই আমি আমার উটের কথা ভাবছি। ঘর যার তিনি তার ঘরের কথা ভাববেন।
এ কথা বলে আব্দুল মোত্তালিব তার উট নিয়ে ফিরে আসেন। আবরাহার আসন্ন হামলা থেকে আল্লাহর ঘরকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে লোকজনসহ পাহাড়ের উপর আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরদিন সকালে আবরাহা তার হাতি বাহিনী নিয়ে কা'বা ঘরের দিকে অগ্রসর হতে গেলেই হাতি বেঁকে বসে। বেঁকে যাওয়া হাতীকে মারপিট করে উঠানোর পর হাতি সব দিকে হাঁটলেও কা'বার দিকে হাঁটতে চায় না। এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে পাখি প্রেরণ করলেন। প্রতিটি পাখি তিনটি করে মসুরের ডালের মতো পাথর বহন করছিল। ঐ পাথর যার গায়ে লাগছিল সেই ধ্বংস হচ্ছিল। আবরাহার শরীরেও পাথর লাগে। আবরাহার আঙ্গুলের গিঁট এক এক করে খসে পড়তে শুরু করে। ফেরার পথে যখন সে ‘সানায়’ পৌঁছে তখন সে পাখির ছানার মতো দুর্বল হয়ে মারা যায়। এ ঘটনার ফলে কা'বা ঘরের সম্মানসহ কুরাইশদের প্রভাব অনেকগুণ বেড়ে যায়।
চতুর্থ স্তর: জাহেলী যুগে কুরাইশগণ কর্তৃক চতুর্থ স্তরের নির্মাণ কাজ হয়েছিল ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন নবী করিম (স.) এর বয়স ছিল ২৫ বছর। তখন কা'বার উচ্চতা ছিল এক পুরুষ পরিমাণ। কা'বার ভেতর এক কুয়ার মধ্যে কা'বার কিছু ধনরত্ন লুকানো থাকতো। দুষ্কৃতিকারিগণ তা জানতে পেরে চুরি করার জন্য পরিকল্পনা করে। কা'বার হেফাজতকারীগণ তা বুঝতে পেরে কা'বার দেয়াল উঁচু করণসহ সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করেন। এ সময় জেদ্দায় জনৈক ব্যবসায়ীর জাহাজ ধ্বংস হয়। কুরাইশরা এর কাঠ ও পাটাতন দিয়ে কা'বার ছাদ তৈরি করতে মনঃস্থির করে। কিন্তু এ ঘর ভাঙ্গার জন্য কেউ হাত দিতে সাহস পায় না। পরে জনৈক অলীদ বিন মুগীরা সর্ব প্রথম ভাঙ্গতে আরম্ভ করলে তার কোনো ক্ষতি না হওয়ার পর সবাই ভাঙ্গার জন্য হাত লাগায়।
কা'বা নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ নামীয় পাথর বসানো নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিবাদমান দলগুলো লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তখন কুরাইশদের মধ্যে প্রবীণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন আবু উমাইয়া বিন মুগীরা বিন আবদুল্লাহ বিন মাখযুম। তার পরামর্শ অনুসারে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আগামীকাল সর্ব প্রথম এই কা'বা ঘরে যে প্রবেশ করবে সে ব্যক্তি যে ফয়সালা দিবে সবাই সে ফয়সালা মেনে নিতে সম্মত হয়। ভাগ্যক্রমে রাসূল (স.) পরদিন সকালে কা'বা ঘরে প্রবেশ করেন। রাসূল (স.)-কে প্রবেশ করতে দেখে সবাই বলতে আরম্ভ করে ‘মুহাম্মদ (স.) ভালো আমানতদার ও সৎ, আমরা এঁর ফয়সালা মেনে নেবো।’
সব কিছু শোনার পর নবী (স.) বলেন-
- আমার কাছে একটি কাপড় নিয়ে এসো।
তাঁর কাছে কাপড় আনার পর তিনি নিজ হাতে কাপড়ের উপর পাথরটি রাখেন। তারপর তাঁর পরামর্শে চার গোত্রের চারজন নেতা কাপড়ের চার কোণে ধরে উত্তোলন করার পর নবী (স.) স্বয়ং পাথরটি যথাস্থানে স্থাপনের পর সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়। এভাবেই রাসূল করীম (স.)-এর হাতে কুরাইশ গোত্রের একটি জটিল ও রক্তক্ষয়ী সমস্যার সুন্দর সমাধান হয়ে গেল।
দ্বিতীয় পর্বঃ (৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত) দ্বিতীয় পর্বের নির্মাণকালকে ৫টি স্তরে ভাগ করা যায়।
প্রথম স্তর: (৬৩৮ সাল থেকে ৬৪৬ সাল পর্যন্ত) খিলাফত কাল। খিলাফত আমলে মসজিদে হারাম খুব ছোট আকারের ছিল। হা’রামের চারপাশে কোনো প্রাচীর ছিল না। তখন চারপাশের বাড়িঘর মসজিদে হা’রামকে ঘিরে রাখতো। নামাযীদের আসা-যাওয়াও কষ্টকর ছিল। হযরত ওমর (রা.) অনেক ঘর ক্রয় করেন, যারা বিক্রি করতে রাজি হয়নি তাদের ঘর ভেঙ্গে সমমূল্যের টাকা বায়তুল মালে জমা রাখেন। যাতে তারা পরে নিয়ে যেতে পারে। ঘরবাড়ি খালি করে চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেন।
হযরত ওসমান (রা.)-এর যুগে লোকসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তাই মসজিদ স¤প্রসারণের উদ্দেশ্যে চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কিছু জমি ক্রয় করেন। কিছু মানুষ জমি বিক্রি করতে অস্বীকার করলে বল প্রয়োগ করেন। এ ভাবে তিনিও মসজিদের স¤প্রসারণ ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
দ্বিতীয় স্তর: (৬৪৬ সাল থেকে ৬৮৪ সাল পর্যন্ত) আবদুল্লাহ বিন যোবায়েরের সময়কাল থেকে এ স্তর শুরু। খলিফা ওসমান (রা.)-এর খেলাফতের শেষ দিকেই খেলাফতি দ্ব›দ্ব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। এক পক্ষে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া আর অপর পক্ষে আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের। আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের ইয়াজীদের আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করলে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য সেনা প্রেরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে খবর পান যে, মদিনাবাসীগণ ইয়াজীদের গভর্নরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে। মদিনাবাসীদের দমন করে ইয়াজীদ বাহিনী নুমায়েরের নেতৃত্বে মক্কা গমনের আদেশ দেন। সেখানে নুমায়েরের সাথে যুবায়েরের কয়েকদিন যুদ্ধ হয়। পরে ইবনে যুবায়ের নিজ সঙ্গী-সাথী নিয়ে মসজিদ-ই-হারামের আশপাশে আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন কা'বার আশেপাশে অনেক তাঁবু ছিল। তার মধ্যে একটিতে আগুন ধরে গেলে অপরাপর তাঁবুতেও আগুন ধরে যায়। সেদিন প্রবল বাতাস থাকায় দ্রæত গতিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কা'বা ঘর তখন কাঠ-পাথরের এবং চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। আগুন কা'বার গেলাফের উপর পড়লে আগুন লেগে কা'বার কাঠ পুড়ে যায়। তখন সময়টা ৬৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের শনিবার ছিল। এ অবস্থা দেখে উভয় পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ঘাবড়ে যায়। যুবায়ের মক্কার কিছু প্রবীণ লোককে নুমায়েরের কাছে প্রেরণ করে এই মর্মে জানান যে, কা'বা গৃহে আগুন লাগার সাতাইশ দিন পর যুবায়েরের মৃত্যু হয়েছে। এখন আর কি কারণে যুদ্ধ করতে চান? এ খবর শুনে যুদ্ধ না করে ফিরে যায় ইয়াজীদ বাহিনী।
ইয়াজীদ বাহিনী চলে যাওয়ার পর যুবায়ের পুনঃনির্মাণের জন্য কা'বা ঘর ভাঙার পরামর্শ চান। অনেক বিরোধিতার মুখে শর্ত সাপেক্ষে কা'বা ঘর পুনঃসংস্কারের কাজ শুরু করেন। শর্ত হলো- কা'বাকে ঠিক সেই অবস্থায় রাখতে হবে যে অবস্থায় রাসূল (স.) রেখে গিয়েছিলেন। তিনি কা'বাকে হাতিমসহ নির্মাণ করেন এবং পূর্ব-পশ্চিমে দুটি দরজা রাখেন। ইয়াজীদের সৈন্যদের সাথে ৬৯২ খ্রিস্টাব্দে এক অসম যুদ্ধে আরাফাতের ময়দানে অসংখ্য উমাইয়া সৈন্যকে হতাহত করে যুবায়ের প্রাণ হারান। যুবায়েরের মৃত্যুর পরপরই আবদুল মালিক ইসলাম জগতের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেন।
তৃতীয় স্তর : (৬৮৪ সাল থেকে ৭০৯ সাল পর্যন্ত) উমাইয়া শাসনকাল। ইবনে যুবায়েরের মৃত্যুর পর হাজ্জাজ মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি খলিফা মালেক বিন মারওয়ানকে যোবায়েরের নির্মাণ কাহিনী লিখে পাঠান। মালেক বিন মারওয়ান প্রতিউত্তরে লেখেন- যুবায়ের পশ্চিম দিকে যে দরজা তৈরি করেছে সেটি বন্ধ করে দিন এবং কা'বার যে অংশ হাতিমের উপর নির্মাণ করেছে, সে অংশটুকু ভেঙে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।
ওলিদ বিন আব্দুল মালিকের খিলাফত কালে মক্কার গভর্নর খালেদ আল- কাসরীর কাছে ছত্রিশ হাজার দীনার দিয়ে পাঠান। তা দিয়ে কা'বা ঘরের দরজা, বাজু এবং তার ভেতরের খুঁটি সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো হয়। ইসলামের ইতিহাসে ওলিদ বিন মালেকই প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম কা'বা ঘরে সোনা ব্যবহার করেন।
চতুর্থ স্তর: (৭০৯ সাল থেকে ১২৫৬ সাল পর্যন্ত) আব্বাসীয় শাসনকাল। উমাইয়া শাসকগণ প্রায় নব্বই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ফাতিমীয়দের সহযোগিতায় আব্বাসীয়গণ ক্ষমতায় আসে। আব্বাসীয়গণ উমাইয়াদের সমূলে নির্মূল করার পর একদিকে কা'বা মসজিদের মেরামত ও স¤প্রসারণ করতে থাকে, অপর দিকে ফাতেমীয়দের পরিকল্পিতভাবে বিনাশ করতে শুরু করে।
আব্বাসীয় শাসক আবু মনসুর কা'বা ঘরকে পশ্চিম ও শ্যাম দেশের দিক প্রশস্ত করেন। এর পূর্বে মসজিদের যে সীমানা ছিল আবু মনসুর তার অর্ধেক সমপরিমাণ প্রশস্ত করেন।
আবু জাফরের পুত্র আল মাহদী দুবারে মসজিদের তিন দিক স¤প্রসারণ করেন। স¤প্রসারিতকরণ ছাড়াও তিনি দুটি বারান্দা তৈরি করেন। তিনি বিদেশ থেকে মহা মূল্যবান পাথর এনে কা'বা মসজিদে বসান।
আল মাহদীর পরবর্তী খলিফা দারে নাদওয়ার বহু টাকা ব্যয় করে পুরাতন ঘর ভেঙে আবর্জনা পরিষ্কার করে তার আসল ভিত্তির উপর মসজিদ নির্মাণ করেন। তাতে খুঁটি মেহরাব ও বারান্দা তৈরি করা হয়। কাঠ খড়ি দিয়ে ছাদ তৈরি করে সোনার প্রলেপ দিয়ে কারুকার্য করা হয়। বড় মসজিদের দেয়ালের ধারে নাদওয়ার দিকে চারটি দরজা খোলা হয়। মিনার তৈরি করা হয়। উক্ত কাজ তিন বছর সময়ের পর ২৮৪ হিজরীতে শেষ হয়।
৩০৬ হিজরীতে আব্বাসী আমলে মুকতাদির বিল্লাহর সময় (৯০৮ –৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) ‘বাবে ইব্রাহীম' নামে একটি গেট তৈরি করা হয়। ইব্রাহীম নামে জনৈক দর্জি ঐ গেটের কাছে বসতেন বলে গেটের এ রকম নামকরণ করা হয়। আব্বাসী খলিফা মুকতাদির বিল্লাহর সংস্কারের পর মুহম্মদ আল মাহদীর সময়কাল থেকে (৯১৮ সাল থেকে ১৮৪৮) প্রায় সাড়ে আট'শ বছর পর্যন্ত কা'বার তেমন কোনো স¤প্রসারণ না হওয়ায় তার আকার আয়তন একই অবস্থায় ছিল। মসজিদের চারপাশের বাড়িঘরে মসজিদের স্থান সংকীর্ণ হয়ে যায়। এক দিকে মসজিদের স্থান সংকুচিত হতে থাকে, আর অপর দিকে যিয়ারতকারীর সংখ্যা স¤প্রসারিত হতে থাকে। এ কারণে মক্কাবাসীদের চরম অস্বস্তি হচ্ছিল।
সুলতানী যুগ: মূলত ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্র্ধষ মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের দ্বারা বাগদাদ ধ্বংসের সাথে সাথেই আব্বাসীয় শাসনের সমাধি রচিত হয়। আব্বাসীয় খেলাফত পতনের পর মদিনার শাসন মিশরীয় সুলতানদের হাতে চলে যায়। তারা মসজিদের নির্মাণ কাজে বেশ আগ্রহ দেখান। মিশরের সুলতান বারকুকের আমলে ৮০২ হিজরীতে কা'বায় আগুন লেগে ক্ষতি সাধন হলে সুলতান কা'বার পুনঃনির্মাণ করে কাঠের ছাদ তৈরি করেন। এরপর কয়েক বার মেরামতের কাজও করা হয়। বহুদিন অতিক্রম হওয়ার পর আস্তে আস্তে তা দুর্বল হয়ে ভেঙে যেতে শুরু করে। বাদশাহ সালীমের কাছে যখন এ চিত্র পেশ করা হয় তখন তিনি তা ভেঙে নতুন ছাদ তৈরি করতে আদেশ দেন এবং বলেন, কাঠের ছাদ তৈরি না করে গম্বুজের মতো ছাদ তৈরি করতে। এ কাজ শুরু হয় ৯৭৯ হিজরীতে; কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাদশাহর মৃত্যু হয়। তার পর গম্বুজ নির্মাণ শেষ হয় তার পুত্র তৃতীয় মুরাদের সময় ৯৮৪ হিজরীতে। (চলবে)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক