গল্প
আকাশের চোখ
(৭ম পর্ব)
বৃষ্টি সিভিল অ্যাভিয়েশনের গেইটে এসে বড় মামাকে কল দিলো। বড় মামা অপেক্ষা করতে বললে বৃষ্টি গেইটের একপাশে দাঁড়িয়ে মামার অফিসের ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। দুইপাশে ফুলের বাগান, একটু পরপর ঝাউগাছ আর বড় বড় পাতাওয়ালা গাছগুলোর জন্য ছায়া সুনিবিড় একটা পরিবেশ বিরাজ করছে।
প্রতিদিন যারা এই পথ ধরে অফিসে আসাযাওয়া করে তারা কতই না ভাগ্যবান। বৃষ্টির ও খুব ইচ্ছে ছিলো এমন একটা পরিবেশে বড় কোনো পদে চাকরি করবে, ফিটফাট হয়ে অফিসে আসবে যাবে। পিয়ন ড্রাইভার দারোয়ান আসা-যাওয়ার সময় লম্বা করে সালাম দিবে, আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।
সম্বিৎ ফিরে পেলো বৃষ্টি। কল্পনায় নয়, কে যেনো সত্যিই তাকে সালাম দিলো মনে হয়। চেয়ে দেখে একজন মোটামুটি পরিপাটি ভদ্রলোক তাকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি সালামের উত্তর দিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। লোকটি বললো,
আপনি কি হারুন সাহেবের কাছে এসেছেন?
জ্বি, আমি ওনার ভাগ্নী।
আচ্ছা, স্যার গাড়ি পাঠিয়েছেন, চলুন।
বৃষ্টি অবাক হলো। অইতো অফিসের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। এইটুকু পথ হেঁটেই ত যাওয়া যেতো। যাক গে, বড় বড় লোকের বড় বড় ব্যাপার।
জমিন থেকে আকাশের চাঁদ দেখা গেলেও ইচ্ছে করলেই যেমন যাওয়া যায়না, তেমনি গেইটের বাইরে থেকে এই উচ্চপর্যায়ের অফিস আদালতগুলা দেখা গেলেও ইচ্ছে করলেই প্রবেশ করা যায়না। অফিসের গাড়ি ঢুকবে তারপরেও সিকিউরিটির কাছে পরিচয় দিতে হলো। তারপর সোজাসুজি যাওয়ার কোনো পথ নেই। দুর থেকে বিল্ডিং কাছে মনে হলেও বাগান আর গাছপালা দিয়ে নকশা করার কারণে সোজা পথটা এঁকেবেঁকে গিয়ে অফিসের গেইটে গিয়ে মিশেছে।
গাড়িতে বসে বৃষ্টি মনভরে উপভোগ করলো সরকারি অফিসের বেসরকারি সৌন্দর্য। সরকারি সৌন্দর্য তো বিধাতা অকৃপণভাবে ঢেলে দিয়েছেন পুরো পৃথিবীতে।সেগুলোই মানুষ আবার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার মধ্য দিয়ে আরও নান্দনিক করার অভিপ্রায়ে ব্যস্ত। যত গুড় তত মিষ্টি, যত খরচ করবে ততই নান্দনিক।কে জানে? এই বাগান বিলাশের জন্যও কতো টু পাইস কামিয়েছে এই সরকারি কামলারা?
বৃষ্টি ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে মুল গেইটে এসে থামলে ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দিলো। একমুহূর্তের জন্য বৃষ্টির হৃদয়ে কেউকেটা ভাবের উদয় হলো। বেশ ভাব নিয়েই গাড়ি থেকে নামলো। অমনি বড় মামা প্রায় হইচই করতে করতে এগিয়ে এলেন। বড় মামা এমনিতেই হইচই করনেওয়ালা মানুষ। তবে আজকে ভাগ্নীকে তার নিজের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে বাইরে বের হয়ে কিছু একটা করে মানুষের মতো বাঁচতে চাওয়াটায় একটু বেশিই আহলাদিত হয়ে বৃষ্টিকে অভ্যর্থনা জানালেন।
সাথে করে নিজের কামরার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, আর যার সাথে দেখা হয় তার সাথেই বেশ ঘটা করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বৃষ্টি অভিভূত হয়ে মামার সাথেসাথে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা পুরোই অন্য জগৎ। ঘর আর বাহিরের তফাৎটা আবিষ্কার করতে পারছে বৃষ্টি। কতো প্রানবন্ত সবাই।
কয়েকজন অল্পবয়সী নারীদেরকে দেখে অবাকই হলো সে। মনে হচ্ছে ওরা পড়ালেখা করেছেই এই জীবন উপভোগ করার জন্য। কারও বিয়ে হয়েছে দুই মাস, কারও হবে সামনের বছর, আবার কেউবা বিয়ের কথা এখনো ভাবছেইনা। কি অদ্ভুৎ! ওরাও বৃষ্টির মতোই নারী।শুধু চিন্তা ভাবনায় বিরাট পার্থক্য।
বৃষ্টি বড়মামার রুমে বসতে বসতে বেশ আনন্দের সাথে চারপাশটা দেখে নিলো। বললো,
মামা, তোমার অফিস এতো সুন্দর? ইশ, আমি যদি এমন একটা অফিস রুম পেতাম!
মামা টিপ্পনি কাটলেন, তাহলে কি করতি? চুলা আর হাড়ি পাতিল এনে এখানেও রান্নাবাড়া শুরু করতি?
বৃষ্টি কিঞ্চিৎ দমে গেলো, শুধু মুখের হাসিটা বজায় রেখে বললো,
থাক, এই এতো লাক্সারিয়াস রুম আমার দরকার নাই, একটা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসার মতো ব্যবস্থা হলেই চলবে,
তাহলে আমাদের কেরানীর টেবিলে গিয়ে বসে পড়। অই পোস্টটা খালি আছে।
বৃষ্টি অনুযোগের সুরে মামা বলে ডেকে কটমট করে তাকালো। বড়মামা হাসতে হাসতে চায়ের অর্ডার দিয়ে
বৃষ্টির কাগজগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন। আর বৃষ্টি চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে নিজের একটা পাকাপোক্ত আসনের কল্পিত সীমানায়। (চলবে,,,)
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক