উপন্যাস
আকাশ মেঘলা হলেও হাসে
(পর্ব দুই)
দুই হাজার সাত সালে আমাদের পুত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছি। খুব দ্রুতই জীবনের গাড়ি চালিয়ে এক এক করে দুটি প্রতিষ্ঠান পার করে দুই হাজার দশ সালের শেষের দিকে তিন নম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এখানেই আছি প্রায় পনের বছরের কাছাকাছি।
বিদেশ থেকে এসেছি মাত্র, আব্বার বাসায় থাকি। অনেকেই মনে করে আমার কোন খরচ নেই, বাসা ভাড়া নেই, বাজার খরচ নেই ইত্যাদি। সুতরাং আমার কাছে অনেক টাকা। আমার আশেপাশের লোকজনের ধারনা। এ মতবাদ আরো পাকাপোক্ত হয়েছিল লিসার চাকরীতে যোগদানের পর। সবার মনে হতে লাগলো তার বেতন তো প্রতিমাসে ধরা থাকে, নয়ত ব্যাংকে জমা রাখি। পরিচিত মহলে আমাকে নিয়ে একটা মিথ চালু হয়ে গেলো।
ছুটির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, ক্লাস নিই। আত্মীয় মহলে ধারণার জন্ম নিলো আমার স্ত্রীর নাকি অনেক চাহিদা। আমাদের দেশের মানুষ নিজের ঘরের সমস্যার সমাধান না করে অন্যের ঘরে উঁকি দিতে পছন্দ করি। একটা সময় গ্রামে গ্রামে দুপুরের বেলা পানের বাটা নিয়ে বসে যেতো সবাই। কে কি করছে, কে কীভাবে চলবে, এই নিয়ে নানা গবেষণা।
মাত্র দেশে এসেছি। হাতে টাকা নেই, বেতন যা পাই চলা মুশকিল। একটু ভালোভাবে থাকার জন্য শুক্রবার দিন আমি সকাল আটটা থেকে টানা বিকেল চারটা অব্দি ক্লাস নিয়ে, দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরেছি। মাঝখানে একটা ঘন্টা ছিল নামাজ আর দুপুরের খাবারের জন্য বরাদ্দ। আব্বার একটা এলিয়ন গাড়ি ছিলো। সিল্ভার কালারের। সেটা ছুটির দিনে আমার দখলে থাকতো। ক্লান্ত শরীরে সেটা চালিয়ে, কোন রকম বাসায় এসেই ঘুম। ঘুম যখন ভাংতো কখনো কখনো রাত দশটা হয়ে যেতো। রাতের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। আবার কখনো কখনো লিসা আর অরায়নকে সেগুনবাগিচা নামিয়ে দিতাম। ববি তখনো বিয়ে করেনি। ওরা সেগুন বাগিচার একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো। বলে রাখা ভালো এ বাসাতেই আমাদের বাসর হয়েছিলো। ববি এখন হাই কোর্টের আইনজীবী। আমার শ্যালক। বিশ্ববিদ্যালয় বদলেছি তিনটা, পরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিতু হয়েছিলাম। এরপর জাহাঙ্গীরনগরেও ক্লাস নিয়েছি।
আমাদের যুবরাজ, আমাদের ছেলে, অরায়ন এখন একাদশ শ্রেণীতে। তার বয়েস কত আর হবে সে সময়? এক বছর? বা এর কিছু বেশি। সঠিক মনে নেই। জীবনের অনেক কথা মনে রাখতে নেই। কিন্তু কিছু কিছু কথা মনে থেকেই যায়, কিছু কিছু মানুষ হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতি রয়েই যায়। তবে এটা মনে আছে ওর বয়েস যখন এগারো মাস, তখন আমরা দেশে ফিরে আসি। আব্বা তখন অবসর নিয়েছেন সরকারী চাকরী থেকে। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন পড়াচ্ছেন আইন বিভাগের ছাত্রদের। আব্বা এখনও কাজ করছেন আর আমাদের মা যথারীতি হেঁসেলে।
দুই হাজার চব্বিশ সালের আগস্ট থেকে দুই হাজার পঁচিশ সালের জানুয়ারী, এ পাঁচ মাস খুব বেশি সময় নয়। তবুও এ পাঁচ মাসে জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, শিখছি, মানুষ চিনেছি। হয়তো আরো চিনবো। গেল আগস্ট এর মাঝামাঝি আমাকে নারায়ণগঞ্জ বদলি করেছিলো। ঠিক পাঁচ মাস পরে আবার ঢাকায় এসেছি। অনেক কষ্ট হয়েছিলো আমার এ বদলিটা করাতে। অদৃশ্য একটা বাঁধা আমাকে পার হতে হয়েছে।
টানবাজারে যেতে আমার কষ্ট হতো না। বাসা থেকে আব্বার গাড়িতে করে গুলিস্তান যেতাম। বন্ধন অথবা উৎসব নামক বাসে চড়ে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে চলে যেতাম নারায়ণগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে। এরপর পায়ে হেঁটে দশ মিনিট নতুবা রিকশা করেই যেতাম শাখায়। আগস্টের প্রথম প্রথম যখন যেতাম তখন ভাড়া ছিলো পঞ্চান্ন টাকা। টিকাটুলি হয়ে ফ্লাই ওভারে উঠতে পারলেই সাই সাই করে বাস চলতো। তবে চাষাড়া যাবার পর জ্যাম, জ্যাম আর জ্যাম। এ চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট অনেক কিছু মনে আলোড়ন তুলেছে। আন্দোলিত হয়েছে। হিসেব নিকেশ করেছি।
কোমরে বেল্ট পরে নিতাম যাতে ঝাঁকি না লাগে। কখনও ব্যাগে করে নিয়ে যেতাম। সাথে বই নিতাম পড়ার জন্য। কোন কিছুতেই মন বসানো যেতো না। ভয় ছিলো চেন্নাই থেকে অপারেশন করে আনা এ দেহ কবে যে আবার নড়ে চড়ে যায়।
অফিসের পরে টানবাজার থেকে ফেরাটা অনেক কঠিন ছিলো। শাখা থেকে দশ মিনিট হেঁটে রেল গেইটে আসার পরে সে ডাইরেক্ট বাস, চাষাড়া যেতে ত্রিশ মিনিট লেগে যেতো। তারপর সাইনবোর্ড ছেড়ে একটু এগুলেই, জ্যাম। কোন কোন দিন চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে হানিফ ফ্লাই ওভারে। পরে সে পথেও আর আসিনি। যত দেরী হোক, কষ্ট হোক আমরা ট্রেনে করেই ফিরতাম। প্রতিদিন বিশ টাকার বাদাম কিনে উঠতাম ট্রেনে।
অনেকেই আমার মতো টানবাজার শাখায় কাজ করছেন। সবার ধারনা এটা তাদের শাস্তিমূলক বদলি। হ্যাঁ, অন্তত আমার যে শাস্তি হয়েছে এটা আমার ব্যাংকের অনেকের কাছেই পানির মতো স্বচ্ছ। কারণ আমি বদলির বছর খানেক আগে আমাদের ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করেছি। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, কারো পক্ষে গিয়েছে, আবার কারো বিপক্ষে। রাজনীতির মার প্যাঁচ। একটা গ্রুপ আমাকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। একটা ট্রেন আসা-যাওয়া করে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ। সমস্যা হলো, এ ট্রেনের কোন সময় নেই। (চলবে,,,)
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার