Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ ড. লিপন মুস্তাফিজ


প্রকাশিত: ২৩:১৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ০০:২৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উপন্যাস

আকাশ মেঘলা হলেও হাসে

আকাশ মেঘলা হলেও হাসে
ছবি: সবার দেশ

(পর্ব তিন)

তখন ছিলো শীতকাল, খুব দ্রুতই অন্ধকার নেমে আসে চারপাশে। শাখা থেকে বেরিয়েই হাতের বামে হাঁটা শুরু করি। যদিও রিকশা করে যাওয়া যায় বিশ টাকা ভাড়া দিয়ে। দূরত্ব খুব একটা বেশি না, হাঁটা পথ। কিন্তু হাঁটার উপায় নেই। অফিসের সামনেই বড় বড় লরি পার্ক করা থাকে। বাদাম বিক্রেতার ভ্যান, পিঠা বিক্রির চুলা, চা এর দোকান সব রাস্তার ধার দিয়ে বসা। অফিসের সাথেই, রাস্তার মোড়ে গরুর দুধের চা বিক্রি করে। আমি সকালে অফিসে এসেই পিওনকে পাঠাতাম চিনি ছাড়া দুধ চা আনার জন্য। ষাট সেকেন্ডেই চা চলে আসতো। 

ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলো তো এখন আরো স্বাধীন। স্বাধীনতার স্বাদ তারাই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করছে। ফলে জ্যামের আধিক্য, তাই আমরা পদব্রজেই চলাফেরা করি। একটু এগিয়ে গেলেই নদীর ঘাট। নদী থেকে একটা সিঁড়ি রাস্তার দিকে উঠে এসেছে। এটা পেরিয়ে রাস্তায় উঠলে হাতের বাম পাশে একটা খাটের ওপরে বড় একটা কাঠের বাক্স নিয়ে দুইতিন জন লোক বসে থাকে। তাদের সামনেই ছড়িয়ে আছে দুই টাকার নোংরা ছেড়া জীর্ন নোট আর বেশ কিছু খুচরা টাকার রুপোলী রঙের কয়েন। নদী পার হয়ে ওপারের মানুষ এপারে আসে পীপিলিকার মতা লাইন করে। এইখানে পারাপারের টাকা জমা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন এক ম্যাডাম মাহিনা আখতার, উনার কথা মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝে। কোন এক ক্লাসে ডেনসিটি অব পপুলেশন এর কথা আলোচনা করেছিলেন। অবাক হই এতো মানুষ কীভাবে, কীভাবে চাপ সইবে বাংলাদেশ। 

নদীর পাড়ে হাঁটার জন্য সুন্দর পাকা রাস্তা করা আছে। হাতের বামে বড় বড় বিল্ডিং আর ডান পাশে নদী। বিকেলে খারাপ লাগার কথা না এই পরিবেশ। আমার বদলির কথা শুনে আমার সাথে দেখা করতে ঢাকা থেকে টানবাজার ছুটে এসেছিলো মাহবুব উদ্দিন। আমরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম বেশি কিছু সময়। জীবনের মধ্যপ্রান্তে এসে কী পেলাম কী পেলাম না এই নিয়ে আমাদের আলোচনা। নোংরা পানিতে সয়লাব হয়েছে নদী, এর ভিতরে কিছু কিছু কচুরীপানা ভেসে চলে, ছুটে চলে মালবাহী জাহাজ বা বজরা। মাঝে মাঝে বিকট শব্দ করে জানান দেয়। 

নদীর দুই পাড় থেকে আসা যাওয়া করছে অসংখ্য মানুষ। ইঞ্জিন লাগানো ছোট ছোট খেয়া নৌকা। আমরা যে রাস্তা ধরে ষ্টেশনের দিকে যাই, সেখান দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কিছু মটর সাইকেল আসা যাওয়া করে। এই পথ এতটাই সরু যে, পাশাপাশি তিনজন গল্প করতে করতে হাঁটা যায় না। কখনো কখনো আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় মোটর সাইকেল আরোহীরা। এই পথের আশে পাশে বসে থাকে গোল হয়ে কিছু কিছু মানুষ। বুঝতে বাকী থাকে না যে, এরা মাদকসেবী। শুনেছি ছিনতাই করতে এরা পটু।

একটু এগুলেই হাতের ডানপাশে কিছু ঘাট চোখে পড়ে। এই ঘাটগুলোর আবার নাম আছে ভিন্ন ভিন্ন যেমন স্কুল ঘাট, লঞ্চ ঘাট, টানবাজার ঘাট, ফেরী ঘাট ইত্যাদি। এইগুলো পেছনে ফেলে বড় রাস্তায় উঠি। হাতের ডান পাশে পসরা বসে নানা ধরনের ফলমূলের। আর হাতের বামে, এমন কিছু নেই যে পাওয়া যায় না। ডান পাশের ফলমূল, তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কিন্তু আমার তখন তাড়া থাকে কী করে ঢাকায় ফিরবো। 

রাস্তার উপরে অনিয়ন্ত্রিত রিকশা আর রিকশা। এক ব্যক্তি বাঁশি ফুঁ দিয়ে দিয়ে এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা হাঁটতেই থাকি, এগুতে থাকি। চলে আসি বাসস্ট্যান্ডে, এর ভিতর দিয়েই আমরা চলতে থাকি ষ্টেশনের দিকে। রাস্তার ধারের হোটেল থেকে ভেসে আসা রান্নার ঘ্রাণকে পাত্তা না দিয়ে ছুটে চলি ট্রেন ধরতে। গার্মেন্টস এর শহর কিনা। পথে চোখে পড়ে বাহারি কাপড়ের দোকান।

রঙচটা একটা লোকাল ট্রেন কমলাপুর ষ্টেশন ছেড়ে যায় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি যেমন ধীরে ধীরে পথ চলেন, তেমনই এই ট্রেনের ইঞ্জিন। বগি টানতেই তার জিহ্বা বেরিয়ে যায়। এর ভিতরে খুব নোংরা। হুঁইসেল বাজাতে বাজাতে সে প্লাটফর্মে ঢোকে। কোন কোন দিন ষ্টেশনে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েই বন্ধ হয়ে যায়। প্লাটফর্মে মানুষজন হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেন থেকে নামে আবার ওঠেও পড়ে। আমরা প্রায়ই দৌঁড়েই পৌঁছে যাই ষ্টেশনে। অন্ধকার ষ্টেশনের প্লাটফর্মে বোরকা পরা রমনীরা খদ্দেরদের সাথে কথা বলে, কিছু কিছু কথা আমাদের কানে ভেসে আসে। আমরা তখন ট্রেন এর অপেক্ষায় থাকি। 

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটা পথে কয়েকটা ষ্টেশনে বিরতি দেয়। ষ্টেশনে এসেই ইঞ্জিন বদল করেই আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সমস্যা হলো এর নির্ধারিত কোন সময় নেই। দেখা যায় চারটার ট্রেন বিকেল পাঁচটায় ছাড়ছে। ভাড়া মাত্র বিশ টাকা। অধিকাংশ যাত্রী সেই বিশ টাকা দিয়েও টিকেট কাটতে চায় না। ষ্টেশনটা এমন একটা স্থানে অবস্থিত যে, সেখানে নদীর ঘাট ও বাসস্ট্যান্ড। এর আগে আমি কোন শহরে এমনটি দেখিনি। বাস, ট্রেন আর লঞ্চ ঘাট একসাথে, কাছাকাছি। এই ট্রেনে উঠতে পারলে পঞ্চাশ মিনিটের ভেতরে কমলাপুরে আসা যায়। ঢাকায় এসে কোন কোন দিন সিএনজিতে বাসায় ফিরতাম। অধিকাংশ দিন বাসা থেকে গাড়ি আসতো। দেখা যেতো নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে যে সময় নিতো, এর চাইতে বেশি সময় নিতো কমলাপুর থেকে বাসায় যেতে। (চলবে,,,)

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার