Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:০৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রবন্ধ

জমজম

জমজম
ছবি: সবার দেশ

জমজম কুপ আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত। ৮৬ বছর পর্যন্ত ইব্রাহিম (আ) নিঃসন্তান ছিলেন। ৮৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি হাজেরার গর্ভে ইসমাঈল (আ.)-এর জন্ম হয়। প্রথম স্ত্রী বিবি সারার চোখ থেকে আড়াল করতে ইব্রাহিম (আ.) ইসমাঈল (আ.)-কে রেখে যাওয়ার জন্য মক্কা নিয়ে আসেন। ইব্রাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর মাকে যে সময় মক্কায় রেখে যান সে সময় মক্কায় কোনো শস্য ও পানি ছিল না। ইব্রাহীম (আ.) তাদের জন্য এক ব্যাগ খেজুর ও এক মশক পানি রেখে যান। ইব্রাহীম (আ.) তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বিবি হাজেরা পেছনে পেছনে যান এবং বলেন-
- আপনি আমাদের এই নির্জন ময়দানে রেখে কোথায় যাচ্ছেন?
এ কথা কয়েকবার বলার পর ইব্রাহীম (আ.) তাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। তা দেখে হাজেরা জানতে চান- আল্লাহ কি আমাদের এখানে রেখে যাওয়ার জন্য আপনাকে আদেশ দিয়েছেন?
- হ্যাঁ।
- তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।

এক সময় ইব্রাহীম (আ.) চোখের আড়ালে চলে যান। ইসমাঈলের মা নিজে পানি পান করতেন আর তাকে দুধ পান করাতেন। এক সময় পানি ও দুধ ফুরিয়ে যায়। তাঁর শিশুপুত্র পানির জন্য ছটফট করতে শুরু করে। বাচ্চার ছটফটানি দেখে মা অস্থির হয়ে পানির খোঁজে বের হন। পাশের সাফা পাহাড়ে উঠে সমভ‚মির দিকে তাকান। সাফা পাহাড় থেকে কাপড়ের এক দিক উঠিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের মতো মারওয়া পাহাড়ের দিকে দৌড়ান। এভাবে তিনি সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফা বরাবর সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। তিনি শেষ দফা যখন পাহাড়ে ওঠেন তখন একটা শব্দ শুনতে পান। তা শুনে কান পাতেন। পুনরায় শব্দ শুনতে পেয়ে বলে ওঠেন-
আমি তোমার শব্দ শুনছি, যদি কোনো সাহায্য করতে পারো তো কর। হঠাৎ তিনি দেখেন ইসমাঈলের পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করার ফলে তলা থেকে পানি নির্গম হতে শুরু হয়। মা হাজেরা ভয়ে ভয়ে সেখানে আসেন। দু'হাত দিয়ে পানি আটকিয়ে হাউজের মতো করে মশকে পানি ভরতে শুরু করেন। তারপর তাকে বলা হয়-
পাথরের বুক চিরে সবেগে বের হচ্ছে জমজম এর পানি

-ভয় করবেন না, এখানে আল্লাহর ঘর রয়েছে, যে ঘর এই শিশু ও তার বাবার দ্বারা পুনঃনির্মিত হবে।
কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, মা হাজেরার দৌড়াদৌড়ির শেষ মুহূর্তে হঠাৎ পুত্রের চিৎকার ধ্বনি শুনে দৌড়ে শিশুর কাছে চলে আসেন। তখন দেখতে পান পাথরের বুক চিরে তীব্র বেগে পানি বের হচ্ছে। ফাটলটা ছিল শিশু ইসমাঈল (আ.)-এর দিকে। অতঃপর মা হাজেরা পাথর ও মাটি দিয়ে পানির গতি থামালেন। সেই থেকে হাজীদের জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করা হজ্জের অংশ করা হয়েছে। 

জনমানবহীন মরুতে হঠাৎ করে এ ঝরণাধারা সৃষ্টি হলে দূর-দূরান্ত থেকে পাখ-পাখালি মক্কার আকাশে এসে জমা হয়ে উড়তে থাকে। অনেক অনেক দূর থেকে ধু-ধু পাহাড়িয়া মক্কায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়তে দেখে জরহুম গোত্রের লোকেরা বিস্মিত হলো। তাদের সর্দার বললো, সেখানে তো কোনো মানুষ বা প্রাণীর বসবাস নেই, তবে পাখি আসলো কেন, কি করতে! পাখির চালচলন উঠানামা দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কোনো সুখবর আছে। অতঃপর তিনি লোক পাঠালেন খবর সংগ্রহের জন্যে। লোকজন এসে দেখে আজব ব্যাপার। শিশু পুত্রকে নিয়ে এক মা সেখানে অবস্থান করছে, আর তাদের কাছেই এক অকল্পিত পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হয়ে চলছে। 

লোকজন ফিরে এসে জরহুম গোত্রের সর্দারকে এ ঘটনা জানালো। সে এ ঘটনাকে আল্লাহর কুদরত এবং মা ও ছেলেকে আল্লাহর পেয়ারা বান্দা বলে ধারণা করলো। তারপর সর্দার তার গোত্রের পনেরো হাজার লোকের সবাইকে নিয়ে পৌঁছলো সেই অনাবাদী পাহাড়ী উপত্যকায়। তারপর মা হাজেরার সঙ্গে পানি ব্যবহারের এক চুক্তিতে আবদ্ধ হলো। পানির বিনিময়ে তারা মা হাজেরা ও তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী, আসবাবপত্র সরবরাহ, নিরাপত্তা বিধান ও সেবা-যত্নের নিশ্চয়তা দিল। মা হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈলের জন্যে গড়ে দিল ঘর। আর এভাবেই আল্লাহপাক তাঁর প্রিয়দের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করলেন। 

হযরত জিব্রাঈল (আ:) এসে হাজেরাকে জানালেন- ‘তাঁর ঘরের পাশেই নির্মিত হবে আল্লাহর ঘর যা অতীতে ফেরেশতাকুল ও হযরত আদম (আ:) তৈরি করেছিলেন। তবে এবার নির্মাণ করবেন হাজেরার স্বামী হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং পুত্র ইসমাঈল (আঃ)’। এই অংশটুকু ‘চোখের জলে প্রেমের হজ' গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।

অনেক বছর আবর্তন ও বিবর্তনের ফলে পানি নির্গমসহ জমজম বন্ধ হয়ে এর চিহ্নটুকুও মুছে গিয়েছিল। কয়েক'শ বছর পরে জমজমের অবস্থান হারিয়ে যায়। আবদুল মোত্তালিব হাজীদের পানাহারের দায়িত্ব পান। একবার তিনি শয্যাকক্ষে ঘুমিয়েছিলেন। সে সময় অদৃশ্য শক্তি তাকে জমজম খনন করার জন্য নির্দেশ করেছিলেন। এ সম্পর্কে আবদুল মোত্তালিব বলেছেন-
-আমি কা'বাগৃহের হিজরে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে সম্বোধন করে বললেন-
- হে আব্দুল মোতালিব, “তিবা’ খনন করো।
- আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম-
- ‘তিবা’ কি?
কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি ফিরে যান। পরদিন আমি একই স্থানে ঘুমিয়েছিলাম। পুনরায় তিনি আমার নিকট এসে বললেন-
- হে আব্দুল মোতালিব, ‘বাররাহ’ খনন করো।
আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম-
- বাররাহ কি?
তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন।
পরের রাতে একইভাবে বললেন-
- হে আবদুল মোত্তালিব, ‘মনা’ খনন করো।
- মনা কি?
শেষ বার বলা হয়-
- জমজম খনন করো।
- জমজম কি?
- যার পানি কখনও নিঃশেষ হবে না এবং এর স্বাদ সম্পর্কে কোনোরূপ দোষারোপিত হবে না। এতে আপনার সন্তানেরা সম্মানিত হবে। এই ক‚প খুঁজে পাওয়া যাবে গোবর ও রক্তের মাঝখানে, যেখানে সাদা কাক ঠোঁট দ্বারা ঠোকর মারে।

আবদুল মোত্তালিব সকালে উঠে হারেসকে সাথে নিয়ে কুপ খুঁজতে শুরু করেন। তিন দিন খননের পর কুপের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলে ওঠেন-
- পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি ইসমাঈল (আ.)-এর কুয়া।

জমজম অর্থ অধিক বা প্রচুর। এ স্থান থেকে প্রচুর পানি নির্গত হয় বলেই নাম হয়েছে 'জমজম'।
জমজম কুপটির অবস্থান হাজরে আসওয়াদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। এক সময় কুপটি খোলা ছিল- তখন বালতি দিয়ে পানি তোলা হতো। ২২৪ হিজরিতে জমজমের পানি শুকিয়ে গেলে ৯ ফুট গভীর করে খনন করা হয়। এক সময় এক নিগ্রো এ কুপে পড়ে মরা গেলে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) মৃত ব্যক্তির লাশ তুলে কুপের পানি বের করার নির্দেশ দেন। তার পর লোহার গ্রীল দিয়ে কুপটি আটকে দেয়া হয়। বর্তমানে জমজমের মুখ গভীরে ২০ গজ প্লাস্টার করা। প্লাস্টারের নিচে পাথর কাটা অংশ ৯২ গজ। তিনটি প্রবাহ থেকে পানি আসে। হজ্জ মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় বিশ লক্ষ লিটার পানির দরকার হয়।

প্রথম কা'বা প্রদক্ষিণ করে সাফা মারওয়া পাহাড় বরাবর সাত পাক ঘুরতে গিয়ে ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলাম। ষোল ঘণ্টা রোজা রেখে, সারাদিন জার্নি করে, ইমিগ্রেশনের ধকল পেরিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর তিনটার দিকে অনভ্যস্ত পোশাকে কা'বা তওয়াফ করে সাফা মারওয়ায় সাত পাক দৌড়ানোর পর ঘামের সাথে শরীরের সব পানি বের হয়ে গিয়েছিল। নদী থেকে ডুব দিয়ে উঠলে যেমন দেখায় ঠিক তেমন দেখাচ্ছিল আমাকে। তৃষ্ণায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে গিয়েও যখন কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন জমজমের কয়েক গ্লাস পানি আমার ভেতরে যেন অমৃত সুধা বর্ষণ করলো। বর্তমানে সর্ব সাধারণের জমজম কুপ দেখার সুযোগ নেই। 

কয়েকশ পানির কল থেকে জমজমের পানি বের হয়ে আসে। নিরাপত্তার কারণেই কিনা মূল ফোয়ারাটি ঢেকে ফেলা হয়েছে। জমজমের শীতল পানিতে এতো স্বাদ, এতো সুধা ও এতো আকর্ষণ রয়েছে পান করার আগে কিছুতেই অনুমান করতে পারতাম না।

২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নেপাল গিয়েছিলাম। পানির যে একটা নিজস্ব স্বাদ রয়েছে তা বুঝতে পেরেছিলাম সেখানকার ঝর্ণার পানি পান করে। সেখানে প্রকৃতির সৃষ্ট ঝর্ণার পানির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলাম, কেউ পানির প্রকৃত স্বাদ আবিষ্কার করতে চাইলে নেপাল এসো। আর এখন মক্কায় এসে জমজমের পানি পান করার পর মনে হলো এ পানিতে পানির সকল গুণাবলিসহ স্রষ্টার খাস রহমত ও ধর্মীয় অনুভূতির স্বর্গীয় পরশ রয়েছে। এ পানির অতিরিক্ত গুণাবলির মধ্যে আরো রয়েছে সুষম শীতলতা। তৃষ্ণার মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত যতোটুকু ঠান্ডা পানি আশা করে পান করতে যায়, জমজমের পানিতে ঠিক যেন ততোটুকু ঠান্ডাই লেগে রয়েছে।

উষ্ণতার দেশ আরব দেশ, যে দিকে চোখ যায় ধূসর মরুভ‚মি আর শুষ্ক পাহাড়। যে দেশে সূর্যের দিকে তাকালেই তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যায় সে দেশের বুক চিড়ে এমন শীতল ও সুস্বাদু পানি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত ছাড়া আর কি হতে পারে।

জমজমের পানি শুধু স্বাদের দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ নয়, রোগ-বালাই নিরাময়ের দিক দিয়েও অতুলনীয়। আল্লাহ তায়ালা জমজমের পানির মাধ্যমে এমন রোগীকে আরোগ্য প্রদান করেছেন, যে রোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে অসম্ভব ছিলো। ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত আছে ‘রাসূল (স.) বলেছেন 'ভ‚পৃষ্ঠের মধ্যে সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি। তাতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাদ্য ও অসুস্থ ব্যক্তির জন্য আরোগ্য রয়েছে।' তিনি আরো বলেছেন, ‘যে নিয়তে জমজমের পানি পান করা হয় সে নিয়তই পূরণ হয়। জমজমের পানি একপ্রকার খাদ্য। আবু যার (রা.) পূর্ণ এক মাস শুধু জমজমের পানি পান করে কাটিয়েছেন। এক মাস তাঁর পেটে জমজমের পানি ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করেনি। এর পরেও কলিজায় ক্ষুধার কারণে কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। 

মরক্কোর এক মহিলা অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য বেলজিয়াম যান। চিকিৎসার কঠিন পদ্ধতির কথা শুনে ফিরে আসেন। মুমূর্ষু অবস্থায় পুনরায় বেলজিয়াম গেলে চিকিৎসকগণ চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে বাড়ি চলে যেতে বলেন। ততক্ষণে মহিলার সারা শরীরে রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো। জীবনের সকল আশা ত্যাগ করে মক্কায় কা'বার মাঠে পড়ে থাকেন। শরীরের ঊর্ধ্বাংশে ঘা বের হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মহিলা জমজমের পানি পান করেন এবং শরীরে মাখেন। কা'বা ঘরের দিকে তাকিয়ে-
হে আল্লাহ! তুমি আমার আশাকে ধূলিসাৎ করো না। তুমি আমার ব্যাপারে চিকিৎসকগণকে অবাক করে দাও। তারপর তিনি কোরআন পড়তে আরম্ভ করেন এবং তৃপ্তির সাথে জমজমের পানি পান করতে আরম্ভ করেন। আস্তে আস্তে তিনি বায়তুল্লাহর প্রশান্তি ও আরাম অনুভব করেন। মহান আল্লাহ পবিত্র জমজম পানির গোপন বৈশিষ্ট্য ও রহমতের ভিত্তিতে তাকে আরোগ্য দান করেন এবং রাসূল (স.)-এর বাণী ‘জমজমের পানি শেফা ও খাদ্য’ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক