Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ ড. লিপন মুস্তাফিজ


প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১০:০৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উপন্যাস

আকাশ মেঘলা হলেও হাসে

আকাশ মেঘলা হলেও হাসে
ছবি: সবার দেশ

(পর্ব চার)

ট্রেনে উঠতে পারাটা অনেক কঠিন। যাত্রীদের অনেকেই প্লাটফর্মে থামার আগেই চলন্ত ট্রেনে কেউ কেউ লাফ দিয়ে ওঠে পড়ে। আবার কেউ কেউ ট্রেন থামার পর জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে হাতের রাখা ব্যাগ বা পত্রিকা দিয়ে নিজের বসার জন্য আসন ধরে রাখে। ট্রেনের বগি খালি হবার জন্য প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরে ধীরে যাত্রী নেমে গেলে যাত্রীরা ওঠে বসার চেষ্টা করে। অনেকে আবার আগে ওঠে সে ব্যাগ বা পেপার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এ নিয়ে যাত্রীদের বগির ভেতরে কথা কাটাকাটি হয় অনেক সময়। 

একবার তো একজন মধ্যাবয়সী লোক লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠতে গিয়ে পড়ে যায়, তাকে আর বাঁচানো যায়নি। মগজ বেরিয়ে রেল লাইনের পাতের ওপরে ছড়িয়ে গেলো। কী বীভৎস। মানুষের জীবন, হয়তো আমাদের কেউ এভাবে হারিয়ে যাবে কোন দিন। মিহির দা, মেরাজুল মোমিন, ইনসাফ জারিফ, সানোয়ার, মাবুদ রানা, ইমরুল, জারিফ আমরা এক সাথে একই ট্রেনে আসার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথেও দেখা হতো।

নিম্ন আয়ের লোকজনের পাশাপাশি অনেক স্থানীয়রা ঢাকায় যাতায়াতের জন্য জন্য এ ট্রেন ব্যবহার করে। কিছু মানুষ ঢাকা থেকে প্রতিদিন এ শহরে আসে, কাজের জন্য। তারা এ ট্রেন বেশি ব্যবহার করে। প্রচুর ধূলোবালিতে মেখে যায় জামা কাপড়। বাসের যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। প্রচুর জ্যামে বসে থাকার চাইতে ট্রেনে একটু দাঁড়াবার স্থান পেলেই মাত্র এক ঘন্টায় ঢাকা যাওয়া যায়। চাষাড়া যেতেই অনেক সময় তিরিশ মিনিট লেগে যায়। এর পরে সাইনবোর্ড হয়ে রায়েরবাগ যেতেই অসহনীয় জ্যামের গ্যাঁড়াকলে। থাক বসে থাক। ঘণ্টার পরে ঘণ্টা। 

ট্রেনে নারী পুরুষ ঠাসাঠাসি করে ওঠে পড়ে। এটা বেশি দেখা যায় বৃহস্পতিবার। অনেক সময় দেখা যায় আসা যাওয়া করতে করতে অনেকের সাথে দেখাও হয়। চেনা জানা হয়ে যায়। চাষাড়া আর টানবাবাজারে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হবার কারণে ট্রেনে ব্যাংকার এর সংখ্যা নেহায়েত কম না। 

ট্রেনের সবুজ রঙের একটা আসনে দুইজন বসা যায়। কোন কোন দিন আমরা তিনজন চাপাচাপি করে এক আসনে তিনজন বসেছি। মাথার উপরের ফ্যান চলে আবার চলে না। যারা আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা একটা পর্যায়ে অনেকটা গায়ের ওপরে ওঠে যায়। সানোয়ার নামে আমাদের এক কলিগ, সে সব কাজ দ্রুত শেষ করে চলে যেতো ষ্টেশনে। আমাদের জন্য টিকেট কেটে রাখতো। আমরা অফিস টাইম শেষ করেই দৌড় দিতাম। পারলে লাফাতে লাফাতে স্টেশনের দিকে যেতাম। কোন কোন দিন ট্রেন চলতে শুরু করলে চোখ বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতেই ঘুমিয়ে যেতাম। আমি একটা ঘোরের ভেতরে থাকতাম, ঘুমিয়ে গেলে পুরাতন কথা মনে পড়তো। অনেকটা সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতোই।

অফিসের ছাড়পত্র হাতে পেয়ে শাখা ব্যবস্থাপককে ফোন দিলাম।  
স্যার, সালাম, কেমন আছেন?
ভালো, ভাই আপনি কেমন আছেন?
ভালো আছি, স্যার। আপনি কি জানেন আপনার শাখায় আমাকে বলদি করা হয়েছে?
কই না-তো জানিনা।
আমাকে আজ রিলিজ করে দিয়েছে আমি এখন জয়েন করতে টানবাজারে আসছি।
শুনেছি তিনি ভালো মানুষ। আমাদের এক সাথে কাজ করা হয়নি। তবে আমাদের এক সাথেই প্রমোশন হয়। যদিও এখন সে আমার থেকে এক ধাপ ওপরে অবস্থান করছে। আমাকে জানালেন কী করে কোন বাসে যেতে হবে। এমনকি বাস ভাড়াটাও জানিয়ে দিলেন। 

মতিঝিল থেকে আমি গেলাম গুলিস্তান। সারি সারি বাস, কোনটায় উঠি, এসি নাকি নন এসি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। অর্থনীতি মাথায় কাজ করলো। ওঠে পড়ি একটা ডাইরেক্ট বাসে। নাম বন্ধন, ফ্লাই ওভারে ওঠে ভালোই লাগছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম আমাকে এভাবে অপদস্ত যারা করছে তারা একটা সময় আমার টেবিলের সামনে এসে বসে থাকতো। অন্যায় আবদার মেটাতে পারিনি বিধায় আমাকে নানাভাবে ট্যাগ দিতো। 

নানা চিন্তা করতে করতে চলে গেলাম চাষাড়া। এর পর রিকশা নিয়ে টানবাজার। একটু কষ্ট হলো চিনে বের করতে।  উনার কাছে যোগাদানপত্র জমা দিলাম। সবার সাথে আমাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। যেহেতু আমি ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে অনেকদিন ধরে ছিলাম, তাই কম বেশি আমি সবাইকে জানি ও চিনি। আবার দুইহাজার এগারো সালে আমি মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করেছি বিধায় অনেকের যোগদান আমার হাতেই হয়েছে। সর্বশেষ মানব সম্পদ বিভাগের দ্বিতীয় ব্যক্তি ও কয়েকটা মাস আমি এ বিভাগের প্রধান থাকার কারণে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে আমার ব্যাংকে আমি খুব পরিচিত মুখ। 

আমাকে দুপুরের খাবার খেতে দেয়া হলো। রান্নাটা অনেক মজার ছিলো। জামাতে নামাজ পড়ে আমি ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। মালেক স্যার আমার সাথে একজন অফিস সহায়ককে দিলেন। আমি বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চারিদিকে বৈষম্য আর সংস্কার নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি হচ্ছে। সবাই নতুন উদ্দীপনায় স্নাত হচ্ছে। 

আমার নব্বই দশকের কথা মনে পড়ে গেলো। এরশাদ যখন ক্ষমতা ছেড়ে ছেড়েছিলো তখন আমরা কলেজের ছাত্র। তখনও স্বাধীনের স্বাদ পেয়েছিলাম। দুই হাজার চব্বিশ সালেও আরও একবার সে স্বাদ পেতে চলেছি। তবে পার্থক্য হচ্ছে আমি এবার ঢাকার বাইরে থেকে সে রস আস্বাদন করবো। 

মালেক স্যার আমাকে একজন পিওন দিলেন তাকে বললেন আমাকে যেন বাসে তুলে দিয়ে আসে। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। (চলবে,,,)

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার