প্রবন্ধ
নযুলে ওহী এবং হেরা

১৭.৯.০৯ তারিখে আমরা মক্কার স্মৃতি বিজড়িত স্থান যিয়ারতে বের হই। গাড়িতে চড়ার সময় সামসু ভাইয়ের কাছে জানতে চাই-
- আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
প্রথমে যাবো জাবালে নূর, হারামের দক্ষিণ দিকে খুব কাছেই জাবালে নূর। আর হারাম থেকে সোজা পূর্ব দিকে আরাফাত ময়দান। তারপর যাব আরাফাত ময়দান, সময় পেলে সবশেষে যাবো সত্তর পাহাড়ে।
- জাবালে নূর কি?
- জাবাল অর্থ পাহাড়, আর নূর অর্থ জ্যোতি। জাবালে নূর অর্থ জ্যোতির্ময় পাহাড়। যে পাহাড়ের গুহায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে রমজান মাসের ২৭ তারিখ শবেকদরের রাতে এক জ্যোতির্ময় পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল।
আমরা জেনেছি মিনা নামক স্থানও প্রসিদ্ধ! আমরা কি মিনায় যাবো না? আরাফায় যাওয়ার সময় মিনা হয়ে যেতে হয়। আরাফায় যাওয়ার পথে মিনাও দেখা হয়ে যাবে। মক্কার সবচেয়ে কাছে হেরা পাহাড়। নবী করীম (স.)-এর নবুয়্যত প্রাপ্তির সাথে স্মৃতি বিজড়িত হেরা পাহাড়ের গুহা। যে গুহায় নবুয়্যত প্রাপ্তিসহ পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল।
নবী করিম (স.) শৈশবে দুধমা হালিমার সন্তানদের সাথে মরুভ‚মিতে যখন মেষ চড়াতেন তখন থেকেই মুহম্মদ (স.) নিভৃতচারী ছিলেন। তিনি জন্মের আগে পিতাকে হারান, ছয় বছর বয়সকালে তাঁর চোখের সামনে হারিয়ে গেলেন মা- একমাত্র অভিভাবক দাদাও চলে গেলেন শৈশবেই। একের পর এক আপনজন বিয়োগের ফলে আরো বেগবান হয় তাঁর চিন্তা-চেতনা। বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য এবং এসবের স্রষ্টাকে নিয়ে মুহম্মদ (স.) সর্বদা চিন্তায় ব্যাকুল থাকতেন। মানুষের নৈতিক অধঃপতন তাঁর মনকে ভীষণভাবে চিন্তাযুক্ত করতো। এসব বিষয় নিয়ে তিনি একাকী ভাবতে ভালোবাসতেন। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে তিনি চিন্তা করার উপযুক্ত সময় ও সুযোগ পেতেন না। বর্ণিত আছে : নবী করীম (স.) রাতে স্বপ্নে যা দেখতেন দিনে তাই ঘটতো। তাতে তিনি আরো বিস্মিত হতেন। বিয়ের পর দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে ঐসব বিষয়ে চিন্তায় মগ্ন থাকার জন্য মক্কার অদূরে হেরা পাহাড়ের গুহায় চলে যেতন। সেখানে কয়েক দিন কয়েক রাত ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। বাড়ির কথা মনে পড়লে কিংবা পানাহার ফুরিয়ে গেলে তখন তিনি বিবি খাদিজা (রা.)-এর কাছে আসতেন।
এসব বিষয়ে আমাদের কথা বলাবলি শেষ হতে না হতেই ক্যাব চলে আসে একটি সুউচ্চ পাহাড়ের গোড়ায়। আমাদের সামনে টানানো রয়েছে বড় আকারের একটি সাইন বোর্ড। সাইন বোর্ডের ডান দিকে মাঝারি উচ্চতার একটি পাহাড়। পাহাড়ের ডান দিকে উপরে ওঠার জন্য আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। সাইন বোর্ডে ইংরেজি আর আরবিতে যা লেখা রয়েছে তার ভাবার্থ-
‘পাহাড়ে আরোহণ করবেন না, আমাদের নবী করীম (স.) কাউকে পাহাড়ে আরোহণ করতে উৎসাহিত করেননি’।
এ পাহাড়ের এক নাম ‘হেরা’, অপর নাম ‘জাবালে নূর’। আসার পথে দূর থেকেই জাবালে নূরের চূড়া দেখতে পেয়েছিলাম। সাধারণ মানুষের পক্ষে এ পাহড়ের চূড়ায় ওঠা সম্ভব নয়। আমার মতো মেদবহুল মানুষের পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। মনে পড়ে, একবার পর্বত দর্শন করতে গিয়ে হিমালয় রেঞ্জের ফিয়া লেকের ডান পাশের পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য আরোহণ করতে শুরু করি। দেড় ঘণ্টার মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারলে সূর্যাস্ত দেখা যাবে। আমাদের গোটা বিশেক আরোহীর মধ্যে মাত্র কয়েকজন শিশু-কিশোর চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছিল- তাও উঠতে পেরে ছিল সূর্যাস্তের অনেক পর। পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করে আমি মাঝ পথেই শেষ করে দিয়েছিলাম তদুপরি হার্টের সমস্যার কারণে এখন আর পাহাড়ে ওঠার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করি না। জাবালে নূরের চূড়ায় কালোমতো একটা কিছু দেখা যাচ্ছিল। ঐ কালো মতো স্থানÑ ওখানেই কিনা সে গুহা, যে গুহায় বসে আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ'শ বছর আগে মুহম্মদ (স.)-এর ওপর আল্লাহর কালাম নাজিল হয়েছিল। মুয়াম্মার বিন রাশিদ এবং মুহাম্মদ বিন আল-জুহুরী হতে এবং পরবর্তী ব্যক্তি হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে।
হযরত আয়শা (রা.) বলেছেন-
মহানবী (স.)-এর নিকট সত্য ‘স্বপ্ন’ (রুইয়া সাদিকা) হিসেবে ‘ওহী’ শুরু হয়েছিল। যখন তিনি কোনো স্বপ্ন দেখতেন তখন তা ঊষার শুভ্রতার ন্যায় প্রতিভাত হতো। তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতেন। তাঁর নিকট ইহা অপেক্ষা কোনো বস্তু অধিকতর প্রিয় ছিল না। তিনি আপন পরিবারে ফিরে আসার আগে হেরা গুহায় কয়েক রাত্রি নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তামগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে তিনি হযরত খাজিদা (রা.)-এর কাছে ফিরে আসতেন এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পুনরায় হেরা গুহায় ফিরে যেতেন। এমনিভাবে ‘তাহান্নস' পালন করার সময় তাঁর নিকট হেরা গুহায় ‘হক’ বা সত্যের উদয় হয়েছিল।
নাজিল হওয়ার প্রথম দিনের ঘটনাটি রোমাঞ্চকর, বিস্ময়কর ও স্মরণীয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, একবার হযরত রাসূল (স.) হেরার গুহায় যখন ধ্যানমগ্ন ছিলেন হঠাৎ জিব্রাইল (আ.) আসেন। আগন্তুক যে জিব্রাইল তা পরে জানতে পেরেছিলেন। জিব্রাইল (আ.) ও রাসূল করীম (স.)-এর সাথে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়।
জিব্রাইল (আ.): (ইক্রা) পড়ুন।
রাসূল (স.): আমি তো পড়তে জানি না।
তার পর জিব্রাইল (আ.) নবী (স.)-কে বুকে চেপে ধরেন। এতে নবী (স.) কষ্ট অনুভব করেন। নবী (স.)-কে ছেড়ে দিয়ে পুনরায়-
জিব্রাইল (আ.): পড়ুন!
রাসূল (স.): আমিতো পড়তে পারি না।
পুনরায় জিব্রাইল নবী (স.)-কে সজোরে বুকে চেপে ধরেন। ছেড়ে দিয়ে
বলেন-
জিব্রাইল (আ.): পড়ুন!
রাসূল (স.): আমি পড়তে জানি না।
একই পদ্ধতিতে সজোরে বুকে চেপে ধরে-
জিব্রাইল (আ.): (ইক্রা বিস্মে রাব্বিকাল লাজি খালাক্) ‘পড়তে শুরু করো তোমার প্রভুর নাম স্মরণ করে।’
জ্যোতির্ময় ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) এ কাজের পর হযরত (স.)-এর মস্তিষ্কে আলোকপাত করার সাথে সাথে ঐশীবাণী তাঁর স্মৃতিফলকে গ্রথিত হতে শুরু করে।
মালিক বিন আনাস হিসাম বিন উরওয়া থেকে, তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে এবং তাঁর পিতা হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হারিস বিন হিসাম বলেছিলেন-
- হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিকট কিভাবে ওহী বা প্রত্যাদেশ আসে বা অবতীর্ণ হয়?
উত্তরে মহানবী (স.) বলেছিলেন-
- কোনো সময় ঘণ্টাধ্বনির ন্যায় তা আমার কাছে আসত। এই পরিস্থিতি আমার কাছে কঠোর বলে অনুভব হতো এবং আমার শরীর থেকে ঘাম নির্গত হতো। এবং তা থেকে যে বাণী বের হতো তা আমি অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখতাম। কখনো ফেরেস্তা তাঁর নিজস্বরূপ ধারণপূর্বক আমার নিকট উপস্থিত হতেন এবং আমার সাথে বাক্যালাপ করতেন। তিনি যা বলতেন আমি তা স্মরণ রাখতাম।
ওহী অবতরণ বিষয়ে মহানবী (স.) আরো বলেছেন-
- হে খাদিজা, আমি আলোকরশ্মি দেখতাম এবং শব্দ শুনতাম এবং তাতে আমার আশংকা হতো যে, আমি যেন ভবিষ্যৎ বক্তায় পরিণত হচ্ছি।
খাদিজা (র) বলতেন-
হে আবদুল্লাহর সন্তান, আল্লাহ আপনার সাথে এরূপ ব্যবহার কখনই করবেন না। কারণ আপনি সত্য কথা বলেন, আমানত বা গচ্ছিত সম্পদ ঠিক ঠিক আদায় করেন এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখেন।
হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলতেন-
- প্রচÐ শীতে তাঁর নিকট ওহী অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমি তার কলেবর ঘর্মাক্ত ও তাঁর কপাল ঘর্মসিক্ত দেখেছি।
পাহাড়ের কাছে আমাদের মতো অনেক দর্শনার্থী দেখলাম। কিন্তু দর্শনার্থীদের কাউকে পাহাড়ের উপরে উঠতে দেখলাম না। কদিন যাবত মক্কার যে বিষয়টা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি তা হলো, নবী করিম (স.)-এর অঙ্গের স্পর্শ লাগা কিংবা তাঁর স্মৃতি বিজড়িত কোনো বস্তু কিংবা স্থানের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রচন্ড দুর্বলতা দেখে। স্রষ্টা ও স্রষ্টার সৃষ্ট জগতের প্রতি মানুষের যে কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে তা পালনের পথ না খুঁজে সবাই সহজ পথে স্বর্গ লাভ করার জন্য ফাঁক-ফোঁকড় খুঁজতে শুরু করে। যে পাথরে চুমো দিলে জীবনের সমস্ত পাপ মোচন হয়ে যায় কেউ কেউ জীবন বাজি রেখে সে পাথরে চুমো দিয়ে পলকের মধ্যে জীবনের সব পাপ মোচন করে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়ে যেতে চায়।
যেখানে রাসূল (স) নামায আদায় করতেন সেখানে নামায আদায় করতে পারলে স্বর্গ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এই ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে সেখানে নামায আদায় করার জন্য জীবন পণ করে আঠার মতো লেগে থাকে। একই ধারণার বশবর্তী হয়ে জাবালে নূরের দূরারোহ চূড়ায় চড়তে গিয়ে মানুষ দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছিল। তা লক্ষ্য করেই হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষ পবিত্র পাথর, মিনা এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তার বিধান করতে পুলিশ প্রহরাসহ জাবালে নূরে এ রকম সাইন বোর্ড টানিয়ে রেখেছে। এ রকম অতি উৎসাহীদের অতি উৎসাহের ফলে রুগ্ন, বৃদ্ধ, মহিলা ও শিশু-কিশোরী ধর্মপ্রাণগণ এসব বস্তু ও স্থাপনার কাছেই যেতে পারে না।
আমার ছোট ফুফাজী হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কা এসেছিলেন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে (সম্ভবত)। তার নিকট থেকে জাবালে নূরের বিষয় শুনতাম। তিনি জানান-
কা’বা মসজিদে ফজরের নামায আদায় করে জাবালে নূর রওয়ানা হই। পায়ে হেঁটে এক ঘণ্টারও কম সময়ে জাবালে নূরের কাছে পৌঁছে যাই। তখন ছিল আমাদের জোয়ান বয়স। আমরা দশজন হাজী পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করি। সকাল ৮ টার আগে ওঠতে শুরু করে বেলা নয়টার পরে পাঁচজন হাজী উপরে উঠতে সক্ষম হই। জোয়ান বয়সের পাঁচজন উপরে উঠে ভাবলাম, আমাদের নবী করিম (স.) এই দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় পনেরো বছর কি করে উঠা-নামা করতে পেরেছেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে যে কাজ সম্ভব নয় সে কাজ আল্লাহর নবী-রাসূলের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। আমাদের আখেরী নবীও সাধারণ মানুষ ছিলেন না। নবুয়্যত প্রাপ্তির বহু আগেই স্রষ্টা তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানটিকে ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের যোগ্যতর সব রকম মানবিক অলংকারে তিল তিল করে গড়তে শুরু করে দিয়েছিলেন।
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক