গল্প
স্বপ্ন ভঙ্গ

কৈশোর উত্তীর্ণ এক যুবক আদর্শ শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে মফস্বল শহর থেকে ঢাকার পাশ্ববর্তী মানিকগঞ্জে একটি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এটা ছিলো হৃদয়ের তারই অধ্যয়নকালীন বিদ্যালয়। তিনি ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে জুনিয়র আই.টি টিচার হিসেবে যোগদান করেন সেখানে। ওটা ছিলো তার বাবারও কর্মস্থল।
এর আগে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে প্রথমে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে আই.টি-তে গ্রাজুয়েশন ও পরে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত কোর্সে আই.টি'তে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য এ্যাডমিশন নেন তিনি।
যোগদানকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের হেড মিস্ট্রেস তাকে সীমাহীন ভালোবাসা ও স্নেহের চোখে দেখতেন। নিজের স্কুলের ছাত্র তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে এটা গর্বের বিষয় ভাবতেন। উনার সময়কালে হৃদয়ের সততা ও আস্হার কারণে স্কুলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন কাজে ম্যাম কত্ক দায়িত্ব দেয়ায় সিনিয়র শিক্ষকদের ঈর্ষার শিকার হন হৃদয় ৷
প্রকৃতির নিয়মে স্টুডেন্টদের প্রিয় হেড মিস্ট্রেস দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন একদিন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপান সিনিয়র শিক্ষক সিরাজ সাহেব। এবার সিরাজ মাস্টারের রোশানলে পড়েন হৃদয়। তখনও হয়ত ম্যামের মরদেহ পঁচেগলে মাটির সংগে মিশে যায়নি। কিন্তু সিরাজ মাস্টারের মগজে পঁচন ধরেছে।
চেয়ারে বসেই প্রথমে হৃদয়কে টিচার্স রুমে অবস্থানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আই.টি টিচার টিচার হিসেবে স্কুলে অবস্থানকালে সার্বক্ষণিক কম্পিউটার ল্যাবে অবস্থান করার আদেশ দেন।
ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আদর্শ শিক্ষক হবার ব্রত নিয়ে কাজ করার আশায় যোগদানের পরদিনই কম্পিউটার ল্যাব এর দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু একি! ৩১টি পিস’র ২৯টি-ই অকেজো। ২ দিন চিন্তা ভাবনা করে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকে নিকট আবেদন করে এগুলো মেরামত/সচল করার জন্য। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন হৃদয়।
এরপর তার স্কুলের এক অনুজ বর্তমানে ছাত্র তার চোখের সামনে হৃদয়ের কলিগের ছোট ভাইকে আহত করতে দ্যাখে। নিজেকে সামলাতে না পেরে ছাত্রকে শাসন করতে গিয়ে শারীরিকভাবে আঘাত করেন হৃদয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার প্রিয় ছাত্র হবার কারণে হৃদয়কে কাজে যোগদানের শুরু থেকে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে নিয়োজিত করতেন। যেমন: শিক্ষাসফর, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আন্ত:স্কুল খেলাধূলা ইত্যাদি। কিন্তু ওনার মৃত্যুর পর হৃদয় ভালোবাসা আর ঈর্ষার পার্থক্য বুঝতে শুরু করেন।
এরপর একদিন হৃদয় সাময়িক বরখাস্তের শিকার হন। এখানে বলতে হয় স্কুলে যোগদানের দিন,তারিখ থেকেই পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তার স্কুলের ছাত্র তার ও অন্য কলিকদের পাশে বসে শিক্ষকতা করবে এটা মেনে নিতে পারেননি। ফলতঃ ইনচার্জ হেড মাস্টার এর দ্বিতীয় ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিনত হয় হৃদয়।
সহজ সরল হৃদয়কে তিনি ব্যবহার করতে থাকেন। স্কুলের পরীক্ষার খাতা দেখায় অনিয়ম, যথাসময়ে রেজাল্টশীট জমা না দেয়া প্রভৃতি অভিযোগ এনে তাকে চূড়ান্তসিদ্ধান্ত জানিয়ে বরখাস্ত আদেশ জারী করা হয়। হৃদয় যথারীতি এ অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর আপীল দায়ের করেন। আপীল অগ্রাহ্য হলে নিয়মানুযায়ী হৃদয় মানিকগন্জ জজ কোর্টে চাকুরীতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন ভাতার দাবীতে সিভিল মামলা দায়ের করেন।
ইতোমধ্যে তিনি শারীরিক ও মানষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রথমে মানিকগঞ্জ মন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে গত ২০/০৮/২০২৪ সালে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।
২১ আগস্ট, ২০২৫ ছিল তার বিবাহ বার্ষিকী। আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেলো কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক হৃদয়ের। প্রশাসনের বড়কর্তার ফাঁদ যখন কারো ওপর ভর করে তখন ছলেবলে কৌশলে তার পেছনে নারী লেলিয়ে দিয়ে তার লালসার শিকারে পরিনত করার অপচেষ্টা করে থাকেন। আমাদের দেশে শত শত এমনকি লক্ষ লক্ষ এরকম হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে, যার সত্যিকারের তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না।
হৃদয়ের দু’বছরের একজন ছেলে আছে। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর সারাঘর বাবাকে খুঁজে ফেরে। বাবার প্রস্থান এখন সে তেমনভাবে বুঝতে না পারলেও ছেলের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারিদিকের পরিবেশ দেখে তার মধ্যে পিতার অনুপস্থিতির অনুভব জাগ্রত হতে থাকবে ধীরে ধীরে । পিতা কি, তা বোঝার আগেই সে পিতাকে হারিয়েছে, এটা বড়ই বেদনাদায়ক।