প্রবন্ধ
মহামানবের মহাবাণী, মহাপ্রয়াণ ও মর্মকথা

(শেষ পর্ব)
হজ্জ সমাপনান্তে হযরত (স.) মদিনা প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে তাঁর শিরঃপীড়া দেখা দেয় এবং স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। একদা মধ্যরাতে তিনি ‘জান্নাতুল বাকী’ নামক সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে তাঁর মৃত সাহাবাদের জন্য পারলৌকিক শান্তি কামনা করেন। তারপর একদিন অতিকষ্টে মদিনার মসজিদে উপস্থিত হয়ে শেষবারের মতো সকলকে ইসলামী আদর্শে জীবন- যাপন করার পরামর্শ দেন। তারপর তিনি ক্রমশ দুর্বল হতে লাগলেন। অবশেষে হিজরী ১২ই রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ ৮ জুন) সোমবার অপরাহ্নে একান্ত আগ্রহে ও মৃদুস্বরে নামায পড়তে পড়তে তাঁর পবিত্র আত্মা অনন্তের পথে যাত্রা করল। নবী করিম (স.)-এর ভাষণ রোখরী শরীফসহ হাসান আলী চৌধুরীর ইসলামের ইতিহাসের কল্যাণে অবিকল ছাপা হয়েছে)।
হজ্জের বাহ্যিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত আছি। হজ্জের শাস্ত্রসম্পৃক্ত গোপন রহস্য অনেকেই জানেন না। খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (রা.)-এর মতে: হজ্জের গোপন বা বাতেনি রহস্য হলো আত্মদর্শন। তিনি বলেন: মানুষের মন থেকে সকল প্রকার সন্দেহ, গোমরাহি ও গায়রুল্লার পর্দা দূরীভূত করে অন্তরে আল্লাহর জাতের জলোয়া প্রতিভাত করার জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান মুর্শিদ-মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে হাজির হওয়া। তিনি এ বিষয়ে আরো বলেন: আমাদের সপ্ত ইন্দ্রিয় পথে কু বা মন্দ বিষয়রাশি আমাদের অন্তরকে কলুষিত করে তোলে। আমরা পাপে জড়িয়ে পড়ি ও রসাতলে যাই। কোরবানির দ্বারা-মনের কুপ্রবৃত্তি কোরবান করে আত্মশুদ্ধি করণই হচ্ছে বাতেনি উদ্দেশ্য। হজ্জের বাতেনি ধারণা প্রকৃতির ‘ন্যাচারাল ওয়াটার সার্কেল’-এর সাথে তুলনা করে বোঝানো যেতে পারে। নাটট্রোজেন চক্রের মতো প্রাকৃতির জলচক্র বা ন্যাচারাল ওয়াটার সার্কেল নিরূপ:
পানির প্রধান উৎস সমুদ্র। সমুদ্রের নির্মল পানি নানা উপায়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পানির কিছু অংশ দূষণ প্রক্রিয়ায় নির্মলতা হারিয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অপরাপর পানির সাথে ব্যবহার অনুপযোগী পানির কিছু অংশ দুর্গম ও বন্ধুর পথ পার হয়ে সমুদ্রে প্রবেশের সুযোগ পায়। নানা কারণে কলুষিত হয়ে পড়া পানি যখন মহাসমুদ্রের জলাধারের সংস্পর্শে আসে তখন বিশালের সাথে মিশাল হয়ে এক ও অভিন্ন হয়ে পড়ে। মিশাল ও একাকার হয়ে পড়া পানি থেকে কোনটা পদ্মা-মেঘনার পানি আর কোনটা দজলা-ফোরাতের পানি বের করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। স্থান- কাল-পাত্র ভেদে রূপ, রস ও গন্ধ মিশ্রিত পানির যৌগিক চরিত্র বিলুপ্ত হয়ে মৌলিক ও প্রকৃত চরিত্র ফিরে পায় সমুদ্রের বিশালের সংস্পর্শে এসেই। সমুদ্রের নির্মল পানি নানা উপায়ে আবারও বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে শুরু করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া নির্মল ও বিশুদ্ধ পানি পুরানো পরিবেশে ফিরে এসে পুনরায় পুরানো দূষণ প্রক্রিয়ায় পতিত হয়।
বৃহত্তর পানির সামান্য কিছু অংশ বিশুদ্ধতা বজায় রেখে জীবনের তৃষ্ণা মেটাতে পারলেও অবশিষ্ট পানির বড় একটা অংশ প্রকৃতির ভাঙ্গা-গড়ার কাজে লাগে। এরপরেও পানির সামান্য কিছু অংশ বিষাক্ত হয়ে পড়ে। বিষাক্ত হয়ে পড়া পানি শুধু ব্যবহারের অযোগ্যই নয়, কোনো কোনো সময় ছুঁলেও শরীরে ঘা হয়ে যায়, দগ্দগে ঘা।
সবকিছু বিচার বিবেচনা করে ময়দানে আরাফাকে মনে করা হয় মুসলিম উম্মাহর মিলনের মহাসমুদ্র। এখানে অবস্থানের পর মানুষের মন বা হৃদয় ব্যক্তি, পরিবার ও ভৌগোলিক সীমা পার হয়ে অসীমের সন্ধান পায়। কৃপমÐিত বিশালের সাথে মিশাল হয়ে সীমার বন্ধন ছিড়ে অসীমের সাথে একাকার হয়ে বিস্তার ও গভীরতা প্রাপ্ত হয়। আরাফা ত্যাগের পর সুগভীর ও অসীম হৃদয়টি পুনরায় পুরানো পরিবেশে ফিরে এসে দূষণ প্রক্রিয়ায় পতিত হয়। দূষণ প্রক্রিয়ার তীক্ষ্ণধার ও সরু সাঁকো কেউ পার হতে পারে, কেউ পারে না- আবার কেউ কেউ তলিয়ে যায় আগের চেয়েও গহীন তলদেশে।
বিশ্ববাসীর প্রাণের দাবী: ইতিহাসের ভাষ্যমতে, হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর একাত্ববাদ হযরত ঈশা (আ.) পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এরপর আরবে বসবাসরত ইহুদী, খ্রিস্টান, ফেটিস্ট (প্রকৃতিপূজারী) ও মূর্তিউপাসক এ চার শ্রেণীর লোক বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে খ্রিস্টানগণ ‘ত্রিত্ববাদ’সহ আরববাসীগণ ছিল মূর্তিউপাসক। ত্রিত্ববাদ ও মূর্তি উপাসকদের যৌথ প্রচেষ্টায় কা’বাগৃহে একে একে হযরত ইব্রাহিম, হযরত ইসমাঈল, হযরত ঈশা, ও হযরত মরিয়মসহ ৩৬০টি মূর্তি ঠাঁই পেয়েছিল। প্রতি বছর নির্ধারিত দিনে মূর্তিপূজারীগণ তাদের দেব-দেবীকে অর্থ দিতে এখানে হাজির হয় এবং দেব- দেবীর সন্তুষ্টির জন্য নরবলীও দিয়ে থাকে। যে নির্ধারিত দিনে দেব-দেবীকে অর্ঘসহ নরবলী দিতে আসত ঐ নির্ধারিত দিনে এখানে সবাই মিলে যে মেলার আয়োজন করত-সে মেলার নাম ছিল ‘ওকাজ’ মেলা। অনেক নারীপুরুষ উলঙ্গ হয়ে কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণসহ এহেন কোন কুকাজ ছিল না যা ওকাজ মেলায় হতো না।
রাসূল (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে মদিনায় হিজরতের পর প্রথম মক্কায় আসেন ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে। এরাবিয়ানদের মধ্যে জিলকদ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম থাকায় রাসূল (সা.) মাতৃভ‚মি দর্শনের জন্য বছরের এ সময়টি চিহ্নিত করেছিলেন। মুসলিম কাফেলা মদিনা থেকে রওনা হয়ে মক্কার ৯ মাইল উত্তরে পৌছার পর কোরাইশ সেনাপতি খালিদ হুদাইবিয়া নামক স্থানে মুসলমান কাফেলাকে বাঁধা প্রদান করে। রক্তপাত এড়ানোর জন্য দু-পক্ষই সন্ধি স্থাপন করতে সম্মত হয়, যা ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে প্রসিদ্ধ। সন্ধির শর্তানুসারে রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানগণ হুদাইবিয়া থেকেই মদিনায় ফিরে যান। (রাসূল (সা.) হুদাইবিয়া থেকে ফিরে যাওয়াকে আল্লাহ ১টি ওমরা হিসাবে গণ্য করেছিলেন।) ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাসূর (সা.) মিথ্যার উপর সত্যোর, অন্ধকারের উপর আলোর এবং প্রতিশোধের উপর ক্ষমার নজীর স্থাপন করে মক্কা বিজয় করেন। মক্কা বিজয়ের সময়ই কা’বাগৃহ থেকে ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করে মুসলমানগণ কা’বাগৃহের দখল ও নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করেন। হিজরীর দশম বছর অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৮ই জিলহজ্জ রাসূল (সা.) লক্ষাধিক মুসলমান সাথে নিয়ে হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে ময়দানে আরাফায় উপস্থিত হয়ে মানবকূলের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ প্রচার করেন।
বোখারী শরীফের ভাষ্যমতে, নবী (সা.) ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদাইবিয়ার ঘটনার সময়, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হুদাইবিয়ার ঘটনাকালে অসম্পন্ন ওমরার কাযা ওমরা, ৬৩০ ক্রিস্টাব্দে হোনায়নার যুদ্ধে জয়লাভ করার পর এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজ্জের আগে এই চার সময় চারটি ওমরা করলেও একলক্ষ ত্রিশ হাজার মুসলমান পরিবেষ্টিত হয়ে হজ্জ করেছিলেন মাত্র একবার। বোখারী শরীফের ৯০৬ নং হাদীছের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, একজন মুসলমানের জন্য সারা জীবনে হজ্জ একবারই ফরজ। নবী (সা.) হিজরতের আগে অন্ধকার যুগে অমুসলিমদের সাথে অনেকবার হজ্জ করেছেন বলে জানা যায়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় হলেও নবী (সা.) ঐ বছর হজ্জের সুযোগ গ্রহণ করেননি। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি হযরত আবু বকর (রা.) কে হজ্জে পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাঁর এ বিলম্বের কারণ ছিল হারাম এলাকায় অনুকুল পরিবেশের অভাব। অতপর আল্লাহ্ সূরা তওবার মাধ্যমে বিশেষ ঘোষণার দ্বারা অমুসলিমদের জন্য হারাম এলাকা নিষিদ্ধ করে দিলেন। রাসূল (সা.) জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ঘোষণাসহ প্রতিনিধি হিসেবে হযরত আলী (ক.) কে মক্কায় প্রেরণ করলেন। হযরত আলী (ক.) ঘোষণাটি ঢোল-শোহবত সহকারে প্রচারের পর সর্বপ্রথম হারাম এলাকা কাফের ও মোশরেক মুক্ত হয়ে হজ্জের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস ও বোখারী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত কা’বাগৃহে ৩৬০টি মূর্তিসহ কা’বা এলাকা মূর্তি পূজারীদের দখলে ছিল। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত মূর্তি পূজারীরা যে স্থানকে কেন্দ্র করে ওকাজ মেলা উৎযাপন করত মুসলমানগণ সে স্থানেই ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে হজব্রত পালন করতে শুরু করেন। রাসূল (সা.) হজ্জকে উপলক্ষ করেই বিশ্ববাসীকে অবগত করানোর জন্য ৮ই জিলহজ্জ আরাফার ময়দানে মুসলমানগণকে সমবেত হবার দাওয়াত দিয়ে তাঁর অমিয়বাণী প্রচার করেছিলেন। রাসূল (সা.) তাঁর অমিয়বাণী প্রচারের সময় “যারা এখানে উপস্থিত আছে তারা আমার বাণী অনুপস্থিতদের কাছে পৌছে দিবে এই মর্মে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশও দিয়েছিলেন। আর সে কারণেই হয়তো হজব্রত পালনকালে প্রত্যেক হাজিকে ৮ই জিলহজ্জ থেকে ১২ই জিলহজ্জ পর্যন্ত ৫ দিনের কর্মসূচীর মধ্যে ৯ই জিলহজ্জ ময়দানে আরাফায় উপস্থিত থাকতে হয়।
আরাফার ময়দানে উপস্থিত থেকে দোয়া-দরুদসহ নানা রকমের আনুষ্ঠানিকতার বিবরণ থাকলেও বিদায় হজ্জের ভাষণ প্রচার করা বা না করার বিষয়ে কোনো কথার উল্লেখ নেই। বোখারী শরীফের ৯১০ নং হাদীছের বর্ণনায় ‘আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (সা.) বিদায হজ্জের ১০ই যিলহজ্জ কোরবানির দিন মিনায় কংকর মারিবার জায়গাসমূহের মর্ধবর্তী স্থানে দাঁড়ালেন এবং সমবেত লোকজনকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিলেন। একই হাদীছের বিশেষ দ্রষ্টব্য অংশে আরো বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) -এর ভাষণ মক্কায়, আরাফায় ও মিনায়সহ আরো বিভিন্ন স্থানে প্রচারিত হয়েছিল- আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)ও পরে বিভিন্ন সমাবেশের বক্তব্যের বিষয় বর্ণনা করেছেন। বোখারী শরীফের বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে, রাসূল (সা.)-এর বিদায় হজ্জের বিদায় বাণীর প্রতিটি কথায় মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা পুণ:পুন: ঘোষিত হয়েছে।
মিনায় ভাষণে তিনি মানুষের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত কঠোর ও মজবুত প্রতিপন্ন করার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক খুন-খারাবী ও লুটপাটকারীদের অত্যন্ত জঘন্য ও অবৈধ হিসেবে গণ্য করেছেন। ইসলামের বিধানে প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মাসে প্রতিটি স্থানে প্রতিটি মানুষের জান-মাল ও আব্রæ-ইজ্জত এমনকি তার চামড়াটুকুও সুরক্ষিত হিসেবে পরিগণিত হয়- এর উপর সামান্য আঁচড়ও হারাম এবং নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) কে ঘিরে লোকজন ভিড় করলেই তিনি একই কথা (মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা) পুনঃপুনঃ প্রচার করতেন তা থেকে মনে হতো, পুনঃপুনঃ প্রচারিত কথা প্রচার করার জন্যই সবাইকে সমবেত করা হয়েছিল। হযরত (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষনে যা বলেছেন তা বোখারী শরীফের ৯১১ নং হাদীছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে থাকলেও হজ্জ পরিক্রমার কোন অংশে বিদায় হজ্জের ভাষণের ব্যবহার এ অধম খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বোখারী শরীফের ৯০৭ নং হাদীছের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, হযরত (সা.) যে তিনদিন ভাষণ দিয়েছিলেন বর্তমানে সে তিনদিন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর নিয়েজিত প্রতিনিধি ভাষণ দেয়ার বিষয় উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর নিযুক্ত প্রতিনিধি জিলহজ্জ মাসের ৭ তারিখ জোহর নামাজের পর, ৯ তারিখ আরাফায় মসজিদে নামেরাতে ও ১১ তারিখ মিনায় জোহর নামাজের পর ভাষণ দিয়ে থাকেন। জুমার নামাজের খোতবার আদলে রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণের বিষয়বস্তু ও মর্ম হাজীদের অনেকেই জানেন না।
রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণই যদি বিদায় হজ্জের রাসূল (সা.)-এর আখেরী ভাষণের অনুরূপ হয়ে থাকে তবে তা রাষ্ট্রপধানের ভাষণ নামে প্রচারিত হবে কেন? আর যদি তা না হয়ে থাকে তবে রাসূল (সা.) এর ভাষণের প্রতীকী হিসেবে বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ প্রচার করা কতটুকু যৌক্তিক এ বিষয়ে আমাদের বলার ক্ষমতা নেই। আমরা বলতে চাই, যে মহাবাণী প্রচারের জন্য রাসূল (সা.) প্রত্যন্ত এলাকার মুসলমানদের সমবেত করেছিলেন এবং যে মহাবাণী প্রতিটি মুসলমানের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য স্বয়ং রাসূল (সা.) সবাইকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন সে মহাবাণী শ্রবণ করার জন্য আজও কোটি কোটি মুসলমান উদগ্রীব কারণ, রাসূল (সা.)-এর আদেশ-নির্দেশ-পালন করা-না করার বিষয়ে কোরআনুল কারীমের ভাষ্য হলো ‘যে ব্যক্তি রাসূলের বরখেলাপ করে চলবে, তাঁর সদুপদেশের বিষয় পরিস্কার হওয়ার পরেও মোমেনের পথ ছেড়ে ভিন্নপথে চলবে, ইহকালে তার চলার পথে আমি কোন বাধা সৃষ্টি করব না- পরকালে তাকে জাহান্নামে পাঠাব’ (পারা ৫ রুকু ১৪ বর্ণনা বোখারী শরীফ)।
৮০০ বছর আগে ইংরেজ জাতি বৃটিশ সাম্রাজ্যের মালিক রাজা জনের নিকট থেকে জাগতিক মুক্তির জন্য স্বাধিকার বিষয়ক যে সনদপত্র (ম্যাগনাকাটা) আদায় করেছিলেন সে সনদপত্র গ্রেট ব্রিটেনবাসীর ইহলৌকিক কল্যাণের ‘গ্রেট চার্টার্ড’ হিসাবে মাইলফরক হয়ে রয়েছে। ব্রিটেনবাসী ইংরেজ জাতি সে মাইলফলক মাথায় নিয়ে বিশ্বের দরবারে উন্নত মর্যাদায় আসীন করে নিজেরাও উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছেন। আর আমরা ১৪০০ বছর আগে মালিক -উল-মূলক হাইউন কাইউমের নিকট থেকে দু’জাহানের পূনাঙ্গ জীবনব্যবস্থার এতবড় সনদ (কোরআনুল কারীম) যিনি আদায় করে দিয়েছেন, তিনি জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে আরাফার বিশাল ময়দানে, বিশ্বের তাবৎ উম্মত জড়ো করে অশ্রু সিক্ত নয়নে তাঁর প্রিয় উম্মাহ্র ভবিষ্যৎ চলার পথ সম্পর্কে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) যে সব দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সে সব দিক নির্দেশনা সম্পর্কে ক’জন মুসলমান অবগত আছেন আমার জানা নেইÑতবে এটুকু জানা আছে, আখেরী নবী (সা.)-এর আখেরী নির্দেশনা প্রতিটি মুসলমানের জানা থাকলে এবং সে নির্দেশনার আদর্শে জীবন জগৎ পরিচালিত হলে অনেক আগেই মানুষে মানুষে হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ বিলুপ্ত হয়ে, উত্তপ্ত বিশ্বের উত্তাপ প্রশমনসহ জ্বালাময় ভূতল শীতলও আলোকিত ভূস্বর্গে পরিণত হয়ে যেত।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আমল থেকে হজ্জের প্রবর্তণ হওয়ার কারণে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পারিবারিক অনেক খুঁটি-নাটি বিষয়ও হজ্জের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কালের বিবর্তনে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আমলে প্রবর্তিত হজ্জ বিকৃত হয়ে ‘ওকাজ’ মেলায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ওকাজ মেলা বন্ধ হয়ে মুসলমানগণ কর্তৃক সর্বপ্রথম হজ্জব্রত পালন করা হয়।
সে হিসাবে (ইতিহাসের বর্ণনা সঠিক হয়ে থাকলে) মুসলমানগণ কর্তৃক রাসুল (সা.)-এর আমলে হজ্জব্রত উদযাপন শুরু হয়েছিল ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে এবং হজ্জের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার কারণে হজ্জ'বিশ্বব্যাপী প্রচার ও বেগবান হয়েছিল। নতুন মাত্রাটি ছিল, মহানবী (সা.)-এর মহাপ্রয়াণের প্রাক্কালে ঘোষিত মহাবাণী বা বিদায় হজ্জের ভাষণ। হজ্জ আদায়ের বিধি-বিধানের কোথাও বিদায় হজ্জের বিদায়ী ভাষণের অবস্থান না থাকায় বিশ্ববাসী বিস্মিত হতেই পারেন।
হজ্জের ফরজ আদায়ে কোন প্রতিবন্ধক না হয়ে থাকলে, হজ্জ আদায় পদ্ধতিতে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না হলে কিংবা রাসূল (সা.)-এর বাণী প্রচারে বাধা-নিষেধ না থাকলে আরাফার ময়দানে রাসূল (সা.)-এর মহাবাণী প্রচার করতে বাধা কোথায়? বোখারী শরীফের বর্ণনানুসারে রাসূল (সা.) শুধু একদিন নয়, একাদিক সময়ে একাদিক স্থানে বারবার মানুষকে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণসহ কল্যাণের জন্য যেসব দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন- সেসব দিকনির্দেশনা সংকলিত করে হজ্জের সময় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী হাজিদের কাফেলায় তাদের স্ব স্ব ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ (লিখিত ভাবে কিংবা বক্তব্যের আকারে) প্রচার করলে অনেকের ধারণা, রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ও নির্দেশের যথাযথ মূল্যয়ণ করা হবে। বোখারী শরীফের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, রাসূল (সা.) ভাষণ শেষ করে ‘শাহাদত আঙ্গুল আকাশের প্রতি ঊর্ধ্বমুখী এবং লোকদের প্রতি নি¤œমুখী করতে বললেন, ‘হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো! হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো! হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো’ এরূপ তিনবার করলেন।
এ সময় ছাহাবীগণ রাসূল (সা.) এর সামনে আখেরী ভাষণের মর্যাদা সমুন্নত রাখবে মর্মে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, পরবর্তীকালে মুসলমানগণ পবিত্র মদিনায় হযরতের রওজা পাকের সামনে উপস্থিত হয়ে দরুদ-ও-সালাম পাঠ করার সময় উক্ত অঙ্গীকার প্রদানের উক্তি পুর্নব্যক্ত করে গেছেন (বোখারী উপর শরীফের অনুকরণে)। ছাহাবীগণ থেকে এ অঙ্গীকার প্রতিটি মুসলমনের বর্তায়। কি অঙ্গীকার! কি বিষয়ের উপর অঙ্গীকার! এ সম্পর্কে হাজীগণসহ অনেক মুসলমানই অন্ধকারে রয়েছে।
মাওলানা আজিজুল হক সাহেব কর্তৃক বাংলায় অনূদিত হামিদিয়া লাইব্রেরী লি: কর্তৃক প্রকাশিত ২য় খন্ড বোখারী শরীফের নবম সংস্করণের ১২৪ পৃষ্ঠায় উপরে উল্লেখিত বর্ণনা থেকে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাসূল (সা.) ঘোষিত মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো প্রচারের নির্দেশ নবী করিম (সা.) নিজেই প্রদান করে গেছেন এবং এ আদর্শ বহাল রাখা হবে মর্মে রাসূল (সা.) মুসলমানদের নিকট থেকে অঙ্গীকারও আদায় করে নিয়েছিলেন। ৮৫৯ নং হাদীছের মাসআলায়, ‘জিলহজ্জ চাঁদের নবম তারিখে রোজা রাখা অতিশয় ফজিলত ও ছওয়াব মর্মে বর্ণিত আছে।’
তারপরেও উল্লেখিত তারিখে কেউ রোজা রাখে না-কারণ- রাসূল (সা.) ঐ দিন রোজা রাখেননি। এখানেও রোজা রাখা না রাখার বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর অভিপ্রায়কেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। যেখানে হযরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ, পশু কোরবানি করা, বিবি হাজেরা (রা.) কর্তৃক সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাত বার দৌড়াদৌড়ি করা, এবং দৌড়ানোর সময় মা হাজেরা কোথায় গিয়ে কিভাবে দৌড়াতেন সে বিষয়গুলোও প্রতীকী হিসেবে হজ্জের উপাদানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে সেখানে (কোরআনুল কারীমে বাধা না থাকলে) আখেরী নবী (সা.)-এর আখেরী ভাষণ হজ্জের অন্তর্ভূক্ত করে রাসূল (সা.) এর অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববাসীর প্রাণের পিপাসা নিবৃত করার জন্য মুসলিম ইম্মাহর কাছে আহবান জানাচ্ছি। (সমাপ্ত)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক