গল্প
আকাশের চোখ

(১২তম পর্ব)
নাসরিন এর কাছ থেকে মেঘলা সম্পর্কে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মেঘলা একজন সিঙেল মাদার। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় একাই পৈতৃক সুত্রে পাওয়া নিজের ফ্ল্যাটে মেয়েকে নিয়ে থাকে। প্রথম প্রথম একদম একা থাকতো। তিন বছরের মেয়েকে ফেলেই চলে এসেছিলো মগবাজারের বাবার বাড়ি। মেঘলা ছাত্রী হিসেবে তেমন যুতসই না হলেও দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ স্কুলের সেরা সুন্দরীই বলা চলে। কম্বাইন্ড স্কুল হওয়ায় ছেলেদের নজর ও থাকতো মাত্রাতিরিক্ত। কথায় আছে সুন্দরী মেয়েরা বোকা ও ভীতু হয়। মেঘলাও হয়তো তাই বোকা ও ভীতু ছিলো। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে প্রায় লুকিয়ে বসে থাকতো। তবুও ছেলেরা মেঘের আড়ালে চাঁদ দেখার জন্য উসখুস করতো। বাসায় আসা-যাওয়ার পথেও প্রায়ই এলাকার পোলাপান গায়ে পরে কথা বলতে আসতো। মাকে গিয়ে এই বিষয়গুলো জানালে মা বাবাকে চাপ দিতে লাগলেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও বলে। বাবা বলতেন, এখনই কেনো? পড়াশুনা শেষ করুক,
মা খিচিয়ে উঠতেন,
হয়েছে হয়েছে, পড়াশোনা করে জজ ব্যারিস্টার হলেও চুলাই ঠেলতে হবে। মেয়ে মানুষ আর ঢেকি একই।
বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা উঠেপড়ে লাগলেন মেঘলার বিয়ের জন্য। বাসায় মহিলা ঘটকের আনাগোনা শুরু হলো। প্রায়ই মেঘলাকে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হতো এইসব কারণে। বাবা প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও পরে ছেলেদের জ্বালাতনের কথা শুনে অবশেষে মত দিলেন।
ঘটকের দ্বারাই এক উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে বাবা মা আগ্রহের সাথে রাজি হলেন। ছেলেপক্ষও মেঘলাকে দেখেই পছন্দ করলো। দেখতে এসেই এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। ছেলেরা আংটি নিয়েই এসেছিলো।
সবকিছু এতো দ্রুত হলো যে,মেঘলার কাছে সব স্বপ্নের মতো লাগছে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই, নাকি কোনো কাজে তাড়াহুড়া করতে নেই, কোনটা মানা উচিৎ বুঝতে পারছেনা। কিন্তু বাবা মায়ের উপরই যেহেতু সব ছেড়ে দিয়েছে, তখন আর এতোসব বুঝেও কাজ নেই। কোনোরকমে মেট্রিক পরীক্ষাটা শেষ হতেই জীবনের পরীক্ষায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো মেঘলাকে। পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা না করলেও জীবন পরীক্ষার ফলাফলের জন্য প্রতিদিন নতুনভাবে জেগে উঠতে হতো তাকে।
বিয়ের দিনই তার শ্বাশুড়ি তার হাতে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বলেছেন,
দেখো বৌ মা,আমি অনেকদিন ধরেই সংসারের যাঁতাকল থেকে মুক্তির পথ খুজছিলাম। আর অপেক্ষা করতে পারবোনা। এই ধরো সবকিছুর মালিকানা।
মেঘলার তো এতো কিছু বুঝার বয়স বা বুদ্ধি কোনোটাই নাই। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সে। কাঁপা কাঁপা হাতে নতুন ঘোমটা টেনে নিচু কন্ঠে বললো,
না না আম্মা, এখনি না। আপনার ছায়াতলে থাকতে পারলেই আমি খুশি। তাছাড়া বাবার বাড়িতে আমি তেমন কোনো দায়িত্বই পালন করিনি। আর এটা তো সম্পুর্ন অচেনা পরিবেশ।
শ্বাশুড়ি মাজু বেগম নরম গলায় বললেন,
,,,তাতে কি? অচেনাকেই ত চিনতে হবেরে মা। শুরুতেই সবকিছু শুরু করতে হয়। আমিও তোমার বয়সেই এসে এই সংসারে ঢুকেছি। আমার শ্বাশুড়িও বিয়ের প্রথম দিনই সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি অবশ্য বাবার বড় মেয়ে ছিলাম আবার এখানে এসেও বড় বউ হওয়ায় তেমন অসুবিধা হয়নাই। বড় মেয়েদেরকে সৃষ্টিকর্তাই অনেক দায়িত্বশীল করে পৃথিবীতে পাঠান। তুমিতো আবার ছোট মেয়ে। ওহ, তুমিতো একটাই মেয়ে। তাই আহলাদ দিয়ে বড় করেছে বলে দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছো। আচ্ছা অসুবিধা নাই। কেউ দেখে শিখে, কেউ ঠেকে শিখে। তোমার কোনটাতে শেখা হয় আল্লাহ ই ভালো জানেন। ঠিক আছে তুমি তোমার ঘরে যাও। যাওয়ার আগে আমাকে আর তোমার শ্বশুরকে দুই কাপ চা দিয়ে যাও। মদিনাকে বলো ও সবকিছু দেখিয়ে দিবে।
মেঘলা মদিনার কাছ থেকে রান্নাঘরের টুকিটাকি জেনে নিয়ে নতুন সংসারের প্রথম কাজ শ্বশুর শ্বাশুড়িকে চা দিয়ে নিজের ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। মাথার ওড়না,টিকলি আর ভারি গয়নাগাটি খুলে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো।
নতুন বাড়ি,নতুন মানুষ নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সে পারবে কি না,সময়ই বলে দিবে।।
দরজা খোলার শব্দে আচমকাই ঘুরে দাঁড়ালো মেঘলা।
আকর্ন হাসি হাসলো তামিম। কি ব্যাপার? ভুত দেখার মতো চমকে উঠলে যে?
মাথা নিচু করে নববধূর মতো আস্তে করে বললো,
না মানে,অন্য কেউ এসেছে কিনা ভাবলাম।
মাথা খারাপ? আমার বাসরঘরে অন্য কেউ আসবে মানে?
বাড়িতে আরও অনেকেই আছে না?
থাকলেও কেউই নক করা ছাড়া আমার বেডরুমে ঢুকবেনা কখনোই। এমন কি বাবা মা ও না।
মেঘলা আশ্বস্ত হয়ে উচ্চারণ করলো শুধু,,
ওহ!
তামিম মেঘলাকে আস্বস্ত করে নিজের হাতেই খাট থেকে ফুলগুলো একটা একটা করে সরিয়ে ফেলছে, আর মেঘলার মন থেকে অস্বস্তি, অপরিচিত, অজানার দুয়ারগুলো একে একে বন্ধ হচ্ছে। (চলবে,,,)
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক