Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৯ মার্চ ২০২৫

প্রবন্ধ

জাবালে সওর

জাবালে সওর
ছবি: সবার দেশ

আমাদের ক্যাব চির পরিচিত আরাফা ময়দানের পাহাড়ের কাছে এসে থেমেছিল। এখানে আরাফা ময়দান এবং মহানবী (স.)-এর ভাষণের নিমিত্তে দন্ডায়মানের জন্য সুচিহ্নিত স্থান-এ দুয়ের মাঝামাঝি স্থানটি অনেকটা শিশু পার্কের মতো। বিনোদনের জন্য এখানে বেশ কয়েকটা উট ও ঘোড়া ছাড়াও রয়েছে কয়েকজন প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান। শিশু-কিশোররা পয়সার বিনিময়ে ঘোড়া ও উটের উপর উঠে আরাফার মাঠ কিংবা মাঠের অংশ ঘুরে দেখতে পারে। কেউবা বসে বসে মেহদির গুঁড়া, শুষ্ক খাবার কিংবা খেলনা জাতীয় সামগ্রী বিক্রি করছে।

নবী করিম (স.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন ঐ স্থানে আরোহণ করাও দুষ্কর ও দুর্গম। কারণ, পাহড়ের খাড়া অবস্থান ছাড়াও এখানে রয়েছে বড় বড় পাথরের খন্ড। কোনো কোনো পাথর খন্ডের ওজন কয়েক’শ টন হতে পারে। এখানে এসে আমার ইচ্ছে করছে নবী করিম (স.)- এর পদচিহ্নিত পরিচিত পবিত্র পাথরের কাছে নিজেকে জড়িত করে কিছু ছবি তোলা।

পাশেই ছবি তোলার জন্য এরাবিয়ান ক্যামেরাম্যানগণ উসখুস শুরু করে দিয়েছে। বলতে না বলতেই নানান পোজে গোটা চারেক ছবি উঠিয়ে ফেললো। চারটা ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান আমার কাছে ষোল রিয়েল পারিশ্রমিক দাবি করে। মাত্র চারটি ছবির জন্য আমার কাছে ষোল রিয়েল অনেক বেশি মনে হলো। গাইডের কাছে জানতে চাইলাম-
- টাকা খুব বেশি লাগছে, দামাদামি করে কিছু কমানো যায় না?
ওরা জাতে বেদুঈন। পাহাড়ে বাস করে। আমাদের দেশের দুর্গম পার্বত্য এলাকার উপজাতিদের মতো। ওরা এখনও মরুবাসী। ওদেরকে নানা রকম আরাম-আয়েসসহ বসবাসের সুযোগ-সুবিধা করে দিলেও ওরা শহরে বাস করবে না কিংবা আধুনিকতার ধার কাছ দিয়েও যাবে না। মহাকালের পরিক্রমায় অনেকের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন হলেও তাদের চরিত্রে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। বই-পুস্তকে আরবের প্রাচীন বেদুঈনদের বিষয় যা বলা হয়েছে তার অনেকটা এখনো তাদের চরিত্রে অবিকৃত রয়ে গেছে। তাদের দিয়ে ছবি তোলার আগে দামাদামি না করে এখন দামাদামি করলে কোনো ফায়দা হবে না। এখন সে যা চাইবে তাই দিতে হবে। শক্তিতেও আমরা সবাই মিলেও ওদের একজনের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবো না। দেশের শাসন ও সরকার আজ পর্যন্ত তাদের আইনের শৃঙ্খলের আওতায় আনতে পারেনি। সামান্য ব্যাপারে খুন-খারাবি করতে তাদের হাত একটুও কাঁপে না। এসব করে হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায়। বিচারের সামনে হাজির করানোর জন্য তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।

মনে পড়েছে, আরবের বেদুঈন জাতি সম্পর্কে ইসলামের প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি। এক সময় আরবের মোট জনসংখ্যার শতকরা আশি জনই ছিল যাযাবর জাতি। তাদের একমাত্র বৈধ পেশা ছিল পশু পালন করা। পশুর প্রধান খাদ্য ঘাস। মরুভ‚মিতে ঘাস পাওয়া এতো সহজ কথা নয়। তাই ঘাসের সন্ধানে তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতো। প্রচন্ড রৌদ্র ও মরুর তপ্ত লুহ্ হাওয়া থেকে রক্ষা পেতে তাদের ছিল পশুর ছাল নির্মিত তাঁবু। পরিবার পরিজন নিয়ে যে সময় যেখানে তাঁবু টানাতো সে সময়ের জন্য সেখানেই হতো তাদের ঘরবাড়ি। বৈধ পেশা ছাড়াও লুণ্ঠন ছিল তাদের সাধারণ কর্ম। সুযোগ পেলেই তারা পথিক কিংবা নিজেদের মধ্যে লুণ্ঠন কর্ম সংঘটিত করতো। তাদের চরিত্রের গুণাগুণ বলতে স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ, অতিথিপরায়ণতাও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল। তাদের আভিজাত্যের মধ্যে রক্তের পবিত্রতা, কবিতা, বাগ্মিতা, তরবারি, ঘোড়া ও বীরত্ব বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো। 

আমাদের দেশের নদীবাসী বেদেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ওদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক মিল রয়েছে। আমাদের নদীমাতৃকতা থেকে বেদেরা যেভাকে জীবন ও জীবিকা খুঁজে বের করেছে- ঠিক সেভাবে মরুমাতৃকতা থেকে তারা জীবন ও জীবিকা খুঁজে বের করে। বেদেদের গোত্র প্রধানের মতো ওদেরও গোত্র প্রধান রয়েছে। ওদের স্বদেশ ও জাতীয়তাবোধ বলতে গোত্রপ্রীতিকেই বুঝাত। বেদেদের নৌকার মতো তাদের প্রতিটি তাঁবুকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি ‘হেই’ গঠিত হয়। কয়েকটি হেই-এর সমন্বয়ে গঠিত হয় একেকটি গোত্র, কিছু সংখ্যক গোত্র মিলে জাতি। যার নাম বেদুইন জাতি। ওদের জগৎ, শাসন ও নিয়ন্ত্রণ আমাদের সভ্য জগৎ ও জাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

দিনের সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকচক্রবাল রেখার কাছে চলে যাচ্ছে। এখন হোটেলে ফেরা আবশ্যক। ক্যাবে ওঠার পর সামসু ভাই বলেন-
আরো কয়েকটি ফযিলতের স্থান রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদে খায়েফ। মসজিদে খায়েফে ৭০ জন নবী নামায আদায় করেছেন। বিদায় হজ্জের সময় রাসূল (স.) এ মসজিদে নামায আদায় করেছিলেন। (আঙুল দিয়ে সামনে বাম দিকে ইশারা করে) ঐখানে মসজিদে খায়েফ। এখন মসজিদে খায়েফে নামায আদায় করতে গেলে সওর পর্বতে যাওয়া হবে না। 

সওর পার্বত কেন বিখ্যাত?

- মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরতকালে সওর পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন।
- তিনি কখন এবং কেন হিজরত করতে গেলেন?
- ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। প্রধানত দুটি কারণে কোরেশগণ নবী করিম (স.)-কে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তিনিও দু’কারণেই মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করতে মনঃস্থির করেছিলেন। কারণ দুটি হলো-
প্রথমত: কোরেশদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, জুলুম-অত্যাচার ও লোভ-লালসা কোনো কিছুতেই যখন হযরত (স.)-কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারলো না তখন তারা হযরত (স.)- কে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে।

দ্বিতীয়ত: যখন কোরেশগণ জানতে পারলো তাদের শত্রুভাবাপন্ন মদিনা ইসলাম প্রচারের অনুকূলে, হযরত যেকোনো সময় মদিনা চলে যেতে পারেন। তখন কোরেশগণ হযরত (স.)- এর আপন চাচা আবু জেহেলের ঘরে পরামর্শ সভায় বসে। আবু জেহেল হযরতকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করলে সবাই সে প্রস্তাবে সম্মত হয়। প্রস্তাবের শর্তানুসারে, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে কিলিং মিশন গঠন করা হয়। কিলিং মিশন আবু জেহেলের নেতৃত্বে যে রাতে হযরত (স.)-কে হত্যা করতে বের হয় সে রাতে আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে হযরত (স.) আবু বকর (রা.)-কে সাথে করে মদিনার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন। 

হত্যাকারী মিশন হত্যার উদ্দেশ্যে হযরত (স.)-এর শয়নকক্ষ অনুসন্ধান করে তাঁকে না পেয়ে দিগ্বিদিক খুঁজতে বের হয়ে পড়ে। শত্রুর চোখ থেকে আড়াল হওয়ার জন্য তারা যে পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন সে পাহাড়ের নামই সত্তর পাহাড়। এ জন্যই সত্তর পাহাড় বিখ্যাত।
গুহায় আত্মগোপন কালে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও নবী করীম (স.)-এর মধ্যে যেসব কথোপকথন হয়েছিল তার মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হলো-
রাসূল (স.) ও আবু বকর (রা.) সত্তরের গুহায় আত্মগোপন কালে আবু বকর (রা.) নবী করিম (স.)-কে বলেন,
আমরা মাত্র দু'জন, ওরা (কাফেররা) সংখ্যায় অনেক বেশি।
তা শুনে রাসূল (স.) বলেন,
আমাদের সাথে আরো একজন আছেন।

আবু বকর (রা.) চারদিকে চেয়ে বিস্মিত হয়ে-
- কে সে?
এক আল্লাহ।
নবী করীম (স.) বলেছিলেন-
-‘হে আবু বকর, এই দুর্দিনে তোমার কি ধারণা যাঁদের সাথে আল্লাহ আছেন?’
এখানে চিত্রে বর্ণিত পাহাড়ের গুহায় তাঁরা তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। চতুর্থ দিনে তাঁরা গুহা থেকে বের হয়ে মদিনাভিমুখে যাত্রা করেন। পথে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তাঁরা ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর (১২ রবিউল আউয়াল) মদিনার নিকটবর্তী কুবা নামক মরূদ্যানে এসে পৌঁছেন।

ততক্ষণে আমরা সওরের পাশে পৌঁছে গেছি। নিচ থেকে পাহাড়ের গুহা দেখা যাচ্ছিল না। গাইড আঙুল দিয়ে গুহার অবস্থান দেখালেন শুধু। এখানেও কয়েকজন ক্যামেরাম্যান ছিল। প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্বেও আগের ঘটনার কথা চিন্তা করে ছবি তোলার ইচ্ছা দমন করেছিলাম। এ সময় আমাদের গাইড
বলল:

- এখানকার ছবি তুলবেন?
- না! এতো বেশি টাকা দিয়ে ছবি তুলবো না।
তারপরেও ছবি উঠালাম। বেদুঈন ক্যামেরাম্যান দিয়েই। তবে, আগের মতো দরকষাকষি না করে নয়। শক্তভাবে দরকষাকষি করে, অনেক কম টাকায় কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছি। আগের বারের বেদুঈন ক্যামেরাম্যানের কথা চিন্তা করে আমার সহহাজী বলে ওঠেন-
-‘মক্কায়ও গাধা আছে।’
তা শুনে আমি বলি, বিদেশ-বিভূঁইয়ে দরকষাকষি না করে কাজ করলে আমাদের মতো বুদ্ধি ব্যবসায়ীদেরও গাধাদের কাছে ‘বোকাপাঁঠা’ হয়ে যেতে
হয়।

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক