গল্প
আকাশের চোখ

(১৩তম পর্ব)
সময় যেনো বয়ে চলে নদীর স্রোতের মতই। কখনো বালুময় তীরে কখনো শৈবালের ভীড়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এগিয়ে চলে। মেঘলার বিবাহিত জীবনের সময়টুকুও আলো আর আঁধারের খেলা খেলতে খেলতেই কেটে গেলো আড়াইটা বছর। এরই মধ্যে এক কন্যা সন্তান এলো ওদের পরিবারে। পুত্র সন্তান বংশের বাতি, কন্যা সন্তান জান্নাতের সাথি।
তবুও পৃথিবীতে কন্যার চেয়ে পুত্রের প্রাধান্যই বেশি। কারণ, মায়াময় পৃথিবীর সবটাতেই পৃথিবীর জন্যই লড়ে সবাই। জান্নাত জাহান্নাম সেতো মৃত্যুর পরে।
তাই সন্তান জন্মের পর এক পরিবারের সবাই একরকম খুশি না হলেও শ্বশুর মশাই খুবই আহ্লাদিত হতেন প্রতিমুহূর্তে। শ্বাশুড়ির মন বুঝা দায়। তিনি আদর করেন কোলে নেন খেলা করেন নাতিনের সাথে, তবে কোথায় যেনো সামান্য ফারাক। মেঘলা সারাক্ষণই মেয়েকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার কারণে কে খুশি কে অখুশি তা দেখার সময়ই পায়না। যেটুকু সময় পায় মেয়ের পাশে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে তন্দ্রাঘোরে নেতিয়ে থাকে।
একদিন দুপুরে এমনি ক্লান্তিতে চোখ বুঝে এলে মেঘলা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলো। এমন সময় শ্বাশুড়ির চিৎকারে তন্দ্রাভাব ছুটে গেলে শ্বাশুড়ির রুমের দিকে ছুটলো মেয়েকে রেখে। গিয়ে দেখে শ্বশুরের অর্ধেক শরীর বাথরুমের ভেতর, অর্ধেক শরীর বাইরে। শ্বাশুড়ি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন টেনে তুলতে, পারছেননা। মেঘলা সাথে সাথে গিয়ে শ্বাশুড়িকে সাহায্য করতে গিয়ে শ্বশুরকে টেনে তুলতে গেলো, এমন সময় পাশের রুম থেকে ধপ করে একটা শব্দ হলো, সাথে শিশুকন্যার চিৎকার। বুঝতে বাকি রইলোনা বাচ্চাটা খাট থেকে পড়ে গেছে। আবার দৌড়ে গেলো নিজের রুমে। গিয়ে দেখে সে যা ভেবেছিলো তা-ই। মেয়েকে কোলে করে আবার শ্বাশুড়ির রুমে এসে জমিলাকে চিৎকার করে ডাকলে জমিলাও ছুটে এসে তিনজনে ধরে চৌধুরী সাহেবকে বিছানায় তুললেন। মেঘলা ফোন করলো তামিমকে। তামিম ডাক্তার আর এম্বুলেন্স নিয়ে বাসায় এসে বাবার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। মাথার একপাশ দিয়ে রক্ত পড়ে পড়ে অবশেষে জমাট বেধে আছে। পাঞ্জাবিটার সাদা রঙের মাঝেমাঝে কালচে হয়ে আছে রক্তের দাগগুলো।
ডাক্তার এসে কিছুক্ষণ দেখেশুনে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বললে কোনোরকমে পাঞ্জাবিটা বদলে দিয়ে নিয়ে গেলো হাসপাতালে।
সাথে শ্বাশুড়ি আর কাজের মেয়েটাকেও যেতে হলো।
খালি বাসায় মেঘলা তার একমাত্র কন্যাকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বাচ্চাটার মাথাও একপাশে ফুলে গেছে তা এতোক্ষন খেয়ালই করেনি। শিশুরাও হয়তো বিপদ আঁচ করতে পারে তাই বাসার পরিস্থিতি দেখে ও কান্না ভুলে সবাইকে দেখছিলো। যখনই মাকে কাঁদতে দেখলো সেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মেঘলা মেয়ের মাথায় একটুকরো বরফ ঘষছে আর শ্বশুরের জন্য দোয়া করছে। পুরো বাড়িটাতে মেঘলা তার শিশুকন্যাকে নিয়ে একা একা এ মাথা ওমাথা পায়চারি করছে আর একটা ফোনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। (চলবে,,,)
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক