প্রবন্ধ
মদিনা ও নববী

(১ম পর্ব)
(আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত)
মদিনার সম্মান ও আদিকথা: ‘খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দের দিকে মিশরের আদিবাসী আমালিকরা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে যেখানে মদিনা সেখানে বসতি স্থাপন করে। এদের নেতার নাম ছিল থারমাস ইয়াসরাব। তার নামানুসারেই মদিনার আদি নামকরণ করা হয় ‘ইয়াসরাব’। আমালিকগণ দিনে দিনে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে শুরু করে। তখন হযরত মুসা (আ.) কর্তৃক প্রেরিত একদল ধর্ম প্রচারক অত্র এলাকায় আসেন। তারা বহু যুদ্ধ-বিগ্রহের পর আমালিকদের পরাজিত করে বনি ইসরাঈলদের বসতি স্থাপন করেন। বুনসর কর্তৃক ব্যাবিলন অধিকৃত হলে পরাজিত ইহুদিরা ব্যাপকভাবে ইয়াসরাবে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইয়েমেনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে সেখানকার অধিবাসী হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় ইয়াসরাবে বসতি স্থাপন করে। (এ অংশটুকু দিওয়ান-ই- মুইনুদ্দিন থেকে)। এভাবে মিশরের আমালিক, বনি ইসরাইল, ইহুদি ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর বংশধরই মদিনার আদিম নাগরিক।
কারো কারো মতে, ইয়াসরাব হযরত নূহ (আ.)-এর পরিবারের একজন লোকের নাম। ইয়াসরাব যে শহরকে প্রতিষ্ঠা করে নিজের নামে নামকরণ করেন ‘ইয়াসরাব’– পরবর্তীতে সে ইয়াসরাব শহরের নামকরণ করা হয় ‘মদিনা’। কারো কারো মতে, মদিনার আরো ২৭ টি নাম রয়েছে। যার মধ্যে আল-মদিনা, তাইবাহ, ইয়াসরাব, বুলদান, জাবেরাহ ও তা-বা-বা সমাধিক সুপরিচিত।
মদিনার অন্যতম ফজিলত হচ্ছে: নিকৃষ্ট লোকেরা সেখানে অবস্থান করতে পারবে না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করীম (স.)
বলেছেন-
‘মক্কা ও মদিনা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই যেখানে মুনাফিক ও দাজ্জাল প্রবেশ করবে না। আর মদিনার সমস্ত রাস্তায় ফেরেস্তাগণ কাতারবন্দী হয়ে পাহারা দিচ্ছে। অতএব, সে আপদহীন ভূমিতে অবস্থান করবে। তারপর মদিনা তিনবার প্রকম্পিত হবে, যার ফলে কাফের ও মুনাফিকগণ মদিনা ত্যাগ করে দাজ্জালের নিকট পৌঁছে যাবে।’ (বুখারী- ১৮৮১ এবং মুসলিম - ২৯৪৩)।
পবিত্র মক্কার ন্যায় পবিত্র মদিনাও হারাম ঘোষিত থাকায় হারাম এলাকায় শিকারকে ভীতি প্রদর্শন, বৃক্ষ কর্তন, এমনকি সেখানে পড়ে থাকা বস্তুও উঠিয়ে নেয়া চলে না। কা’বা যেমন করে মক্কার প্রাণকেন্দ্র, ঠিক তেমন করে মসজিদ- ই-নব্বীও মদিনার প্রাণকেন্দ্র। নবী (স.)-এর নিজ হাতে নির্মিত, তাই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে ‘মসজিদ-এ-নববী’।
প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি নির্মাণের পর থেকেই উত্তরোত্তর এখানে নামাযীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, নামাযীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মসজিদের আকার-আয়তন, সৌন্দর্য্য ও লালিত্য। আকার-আয়তন গাণিতিক হারে বাড়তে থাকলে নামাযীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। যার ফলে সমসাময়িক সরকার ও শাসক সর্বদা নববী মসজিদের স¤প্রসারণের দিকে নজর রাখেন। এ সাড়ে চৌদ্দশ বছরে মসজিদ- ই-নববীর উন্নয়ন ও স¤প্রসারণ মাত্র সাড়ে চৌদ্দ কথায় কিছুতেই শেষ করা যাবে না। তাই মহান সৃষ্টিকর্তার নামে সিন্ধুকে বিন্দুর মতো করে সংক্ষিপ্তভাবে নববী মসজিদ সংস্কার ও সম্প্রসারণের প্রধান প্রধান ঘটনা বর্ণনা করছি-
মসজিদে নববীর স্থান নির্বাচন: রাসূল (স.) মদিনা পৌঁছার সাথে সাথে ‘আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন’ মর্মে চারদিক থেকে রব উঠতে থাকে। অনেকেই রাসূল (স.)-কে অতিথি হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। সকলের আব্দারের জবাবে রাসূল (স.) বলেন, ‘আমার দাদা আবদুল মোত্তালিবের নানীর বংশ ‘বানু নাজ্জার’ এর কাছে মেহমান হয়ে তাদের সম্মান করবো। বানু নাজ্জারের বনী আমর বিন অত্তফের নিকটে অবতরণ করে ১৪ রাত অবস্থান করেন। প্রথমতঃ যেখানে নামাযের সময় হতো সেখানেই নামায আদায় করতেন। পরে তিনি মসজিদ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্য বানু নাজ্জারের সর্দারকে ডেকে বলেন ‘তোমরা তোমাদের এই বাগানের মূল্য আমাকে বলো?’
প্রতিউত্তরে তারা বললো, ‘আল্লাহ্র কসম! আমরা তার মূল্য গ্রহণ করবো না, মূল্য গ্রহণ করবো আল্লাহর কাছ থেকে।’ নববী মসজিদের স্থানটি চিহ্নিত হয় বিশেষ কায়দায়।
অর্থাৎ রাসূল (স.) তাঁর সওয়ারী যে উটের উপর সওয়ার ছিলেন সে উটটির নাম ছিল কাসাওয়া। কাসাওয়া হাঁটতে থাকে, আর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে তাঁর লোকজন। অতঃপর সে উট যে স্থানে গিয়ে বসে যায়, সে স্থানটিই চিহ্নিত হয় মসজিদের স্থান হিসেবে। বর্ণিত আছে: ‘বিশ্বনবী (স.) দক্ষিণাভিমুখে নজ্জার বংশীয়দের বাড়ির অভিমুখে গমন করছিলেন, সেই সময়ে তাঁর প্রিয় বাহন কাসাওয়া পথের পাশে নজ্জার পরিবারের বাড়ির সমুখে উপবেশন করেছিল। হযরত কাসাওয়াকে জিজ্ঞেস করলেন-
- তুমি পথে যেতে যেতে এমন এক স্থানে শয়ন করবে এবং সে স্থানে আমি আশ্রয় নেব। এটাই প্রভুর আদেশ। আমি জানতে চাই, আমরা কি সেই পবিত্র স্থানে উপস্থিত হয়েছি?
হযরত (স.)-এর বচন শ্রবণমাত্র কাসাওয়া পুনরায় উঠে দাঁড়াল।
পরে যে স্থানটিতে রাসূল (স.)-এর উট বসে পড়েছিল সে স্থানটি ছিল সুহাইল ও সাহল নামীয় দুই এতিম ভাইয়ের। তাদের নিকট থেকে নবী করীম (স.) স্থানটি খরিদ করতে চাইলে তারা বিক্রির পরিবর্তে দান করতে চাইলো। রাসূল (স.) দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করে স্থানটি মসজিদের জন্য খরিদ করে নেন। এর পর রাসূল (স.)-এর নির্দেশে ঐ স্থানের উঁচু-নিচু স্থান সমান করা হয়, কিবলার দিকে খেজুরের গাছ সারবন্দী করে দেয়াল বানানো হয়, ডানে ও বামে পাথরের দেয়াল তৈরি করা হয়। নির্মাণকালে নির্মাণকারীদের সাথে রাসূল (স.) স্বয়ং পাথর বহন করেছিলেন এবং বলেছিলেন-
এ বোঝা খেজুরের বোঝা নয়, হে আমাদের রব, এটি পবিত্র ও নেক কাজ। (বুখারী- ৩৯০৬)।
বর্ণিত আছে রাসূল (স.)-এর সময় মসজিদের ভিত্তি ছিল ইটের, ছাদ ছিল খেজুর ডালের এবং খুঁটি ছিল খেজুর গাছের কান্ডের। নবী (স.) খায়বার থেকে ফিরে আসার পরই মসজিদ বর্ধিত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তখন থেকে শুরু করে বাদশা ফাহদ-এর সময়কাল পর্যন্ত মসজিদে নববীর সস্প্রসারণ ও সংস্কারকে মোট ৯ ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম দফা: মসজিদে নববীর নির্মাণকাল থেকে নবী করিম (স.)-এর পরলোকগমনকাল পর্যন্ত দুইবার সম্প্রসারণ করতে হয়েছে। নির্মাণের সময় মসজিদের মোট গেট ছিল ৩টি। পশ্চিম দিকের গেটের নাম ‘বাব-আল- রহমা’। ‘বাব-আল-রহমা’ একই নামে একই স্থানে বর্তমানেও বিদ্যমান আছে। পূর্ব দিকের গেটের নাম ‘বাব্ জিব্রিল’। এই গেটের স্থান স্থানান্তরিত হয়েছে। জেরুজালেমের দিক থেকে যেদিন কেবলা পরিবর্তন হয় সেদিন থেকে দক্ষিণ দিকের ‘বাব-আল-নিশা’ গেটটি বন্ধ করে উত্তর দিকে খোলা হয়। নবী করিম (স.) খাইবার থেকে ফিরে এসে প্রথমবার বর্ধিত করার পর আয়তন দাঁড়ায় ১২০০ বর্গ হাত অর্থাৎ মসজিদের দৈর্ঘ্য ছিল ৪০ হাত আর প্রস্থ ছিল ৩০ হাত। দ্বিতীয়বার স¤প্রসারণের পর দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার, প্রস্থ ৫০ মিটার ও উচ্চতা ছিল সাড়ে তিন মিটার।
দ্বিতীয় দফা: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সময় স্বার্থপর মুসলমানগণ মুরতাদ হয়ে যেতে থাকে। ভন্ড মুসলিমগণ শুধু ধর্মই পরিত্যাগ করেনি- ইসলামের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছে। সেসব সমস্যা দূর করতে করতেই তাঁর খিলাফতকাল শেষ হয়ে যায়। তার পরেও তিনি খেজুর গাছের অনেক কান্ডের পরিবর্তন করে দেন।
তৃতীয় দফা: তৃতীয় দফা পরিবর্তন হয় হযরত ওমর (রা.)-এর হাতে তিনি খেজুরের কান্ডের পরিবর্তে কাঠের খুঁটি লাগান। তিনি মানুষের স্বাভাবিক উচ্চতা বরাবর পাথর দ্বারা ভিত্তি তৈরি করেন।
চতুর্থ দফা: কা'বা মসজিদ সংকুচিত হয়ে পড়ায় হযরত উসমান (রা.) মসজিদ নববীর বড় রকমের সংস্করণের আহবান জানান। এ ব্যাপারে সবাই ঐক্যমত পোষণ করলে তিনি নিজে সাধারণ কাজের তদারকি করেন। ওয়াদীয়ে নাখল থেকে পরিষ্কার চুন সুড়কি আনয়ন করা হয়। তিনি কিবলা, উত্তর ও পশ্চিম দিকে প্রশস্ত করেন। কিবলার দিকে একটি বারান্দা বের করেন। পশ্চিম দিকেও একটি বারান্দা বের করেন এবং উত্তর দিকে দশ গজ বৃদ্ধি করেন। ‘ওসমানা মিহরাব’ নামে তিনি যে মিহরাবটি নির্মাণ করেছিলেন বর্তমানেও ইমাম সাহেব ঐ মিহরাবের স্থানে দাঁড়িয়ে নামায পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর এ নির্মাণ ছিল নক্সাকৃত পাথর ও সিমেন্টের। তিনি সুগন্ধি কাঠ দ্বারা মসজিদের ছাদ ঢেকে দেন। কাজ শুরু হয় হিজরী ২৯ সালের রবিউল আউয়াল মাসে আর শেষ হয় মহররম মাসে।
পঞ্চম দফা: হযরত ওসমান (রা.)-এর পর ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নব্বই বছর ছিল উমাইয়া শাসনকাল। ওলীদ বিন আবদুল মালেকের সময় মদিনার গভর্নর ছিলেন ওমর বিন আবদুল আজিজ। ওলীদ ওমরকে নবীজীর মসজিদ নির্মাণ ও স¤প্রসারণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে ওমর মসজিদের পশ্চিম দিকে বিশ হাত এবং পূর্ব দিকে ত্রিশ হাত বৃদ্ধি করেন। ওমর বিন আবদুল আজিজের নির্মাণের সময়ই সর্ব প্রথম মহিলাদের জন্য মসজিদে হুজরা স্থাপন করা হয়। তিনি মসজিদে পাথরের খুঁটিসহ চার কোণে চারটি মিনার তৈরি করেন। এ ছাড়াও দেয়ালের ভেতর মার্বেল পাথর, দরজায় সোনার প্রলেপ ও রঙিন পাথর বসানোসহ দরজা রাখা হয় বিশটি।
নবী করিম (স.)-এর সমাধি বরাবর যে ঘন সবুজ রঙের ভুবন মোহিনী একটি গম্বুজ রয়েছে সে গম্বুজটি কখন কে নির্মাণ করে গেছেন এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নববী মসজিদের নির্মাণকাল থেকে সর্বশেষ প্রযুক্তি খোলা চত্তরের ইলেকট্রনিক ছাতার নির্মাণ পর্যন্ত আমি যে কয়েকটি গ্রন্থ অনুসরণ করেছি সে কয়েকটি গ্রন্থে প্রধান গম্বুজটির নির্মাণকাল ও নির্মাতার নাম না পেয়ে ড. মুহম্মদ ইলিয়াস আবদুল গনী-এর লিখিত ‘পিকটোরিয়্যাল হিস্টরি অব মদিনা মনোয়ারা’ গ্রন্থের ছাব্বিশ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত নক্সা অনুসরণ করি। নক্সায় নববী মসজিদের শুরু থেকে বাদশা ফাহাদ-এর সময়কাল পর্যন্ত স¤প্রসারণের ‘রঙ’চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। রঙ চিত্রে গম্বুজটি উমাইয়া আমলে মসজিদের স¤প্রসারিত অংশে প্রদর্শন করা হয়েছে। এ যুক্তি সঠিক ধরে নিলে বিশ্ব বিখ্যাত সবুজ গম্বুজটির বয়স সাড়ে তের’শ বছর। সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে-- পরিশেষে ইন্টারনেট থেকে যা পাওয়া গেলো তার অর্থ: আব্বাসীয় শাসনের শেষ দিকে সবুজ গম্বুজ সম্পর্কে সর্ব প্রথম জানা যায়। কিন্তু কখন নির্মিত হয়েছিলো তা অদ্যাপি জানা যায়নি। বিশ্ব বিখ্যাত সবুজ গম্বুজটির নির্মাণ ইতিহাস হয়তো অনুদ্ঘাটিতই থেকে যাবে। (চলবে,,,)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক