Advertisement

আসমা সরকার


প্রকাশিত: ০১:৪১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

জীবন এমনও হয়?

জীবন এমনও হয়?
ছবি: সবার দেশ

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের  দুটি মেয়ে । মাঝেমধ্যে লিফটে কিংবা দরজার পাশে দেখা হয় মেয়ে দুটির সাথে।দুজনেই নর্থসাউথে পড়ে। একজন এম বি এ,আরেকজন মাত্র CSE তে ভর্তি হয়েছে। ওরা চুপচাপ আসে আর যায়। আমার আবার এই চুপ করে কারো সামনে দিয়ে আসাযাওয়া করা হয়ে উঠে না। তাই একদিন নিজে থেকেই মেয়েদের সাথে আলাপ পরিচয় করলাম। তারপর থেকে ওরাও ইজি হলো। দেখলে সালাম দেয়,কথা বলে।

ঘরের ভিতর যখন অস্থির লাগে,তখন গিয়ে লিফটের সামনে রাখা সোফায় গিয়ে বসে বাইরে
বের হওয়ার স্বাদ নিই। লকডাউনের কারনে কেয়ারটেকার ও বাইরেই বসে। বাহির থেকে কেউ এলে ওখানে আগে বসে জুতা খুলে নিয়মমাফিক ঘরে প্রবেশ করে। আগে সবুজের ছায়া ছিলো, কিন্তু গাছগুলো মরে যাওয়াতে আর সেই সবুজের ছোঁয়া নাই। তবুও গিয়ে বসতে ভালো লাগে। বাইরের ঘ্রাণ নিতে পারি বলে।

এখনও বসি,তবে A3 ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠে। বিধাতা কখন কাকে নিয়ে কি খেলা খেলে সেটা এই দরজাটার দিকে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগে। জীবন এমনও হয়??

মেয়ে দুটি ওদের চাচার সাথে এখানে ভাড়া থাকতো। বাসায় কোন কাজের লোক ছিলো না। চাচা আর মেয়েরা মিলেই ঘরের কাজ সারতো। ছোট মেয়েটির এসএসসি পরীক্ষার সময় ওদের মা মারা যায়। ওদের বাবা আর বিয়ে করেননি। বড় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন ভালো এবং অনেক টাকাপয়সা ওয়ালা সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তা মেয়েটির কথাবার্তায় জানতে পারলাম।

একদিন গেটের সামনে রুমুর চাচাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,রুমু ঝুমুকে অনেক দিন দেখিনা ভাই,ব্যাপার কি? ওরা কি গ্রামে গেছে?
ভদ্রলোক কাঁদো কাঁদো গলায় কোনোরকমে বললেন,
----আপা,,আমার ভাইস্তি জামাইটা রোড এক্সিডেন্টে গতসপ্তাহে মারা গেছে। হুন্ডা নিয়ে ঢাকা আসতে নিয়া,,,,,,

আমি আর শুনতে পারলামনা। একটা কষ্ট গলার মধ্যে আটকে গেলো। কাঁদতে ও পারছিনা। ওরা ত আমার রক্তের কেউনা,হাউমাউ করে কান্নাটা শোভা পায়না। কিন্তু আমি বাসায় এসে আর কান্না চেঁপে রাখতে পারিনি। যতবার রুমুর মুখটা চোখে ভাসে,ততবার চোখ ভিজে আসে।

বেশ কিছুদিন পর লিফটের সামনে রুমুর সাথে দেখা। আগের সেই উচ্ছ্বলতা নেই। আমি ও আর হাসতে পারিনি ওদের দেখে। শুধু এই সোফায় বসে শুনলাম ওর কুমারী বৈধব্যের কাহিনী। ওর বাবা বেশি ভেংগে পড়েছে বললে আমি বললাম,
---সান্তনা কিভাবে দিতে হয় আমি জানিনা মা। তবে বাবার সামনে তুমি শক্ত থাকার অভিনয়টা অন্ততঃ করো।

কিছুদিন আগে ওর বাবা এলো। রমজান মাস এখানে থাকবে। লকডাউন শেষ হলে মেয়েদের নিয়ে বাড়ি যাবেন। ঈদের ছয়দিন আগে ইফতারির আগে আমার সাহেব এসে বললো,
----আহহারে! পাশের বাসার ভদ্রলোকটা স্ট্রোক করছে। হাসপাতাল নিতে নিতে রাস্তায়ই মারা গেছে।
আমার সেদিন কোনো কাজই আর হাতে উঠেনাই। দৌড়ে গিয়েছিলাম নিচে গ্যারেজে। কিন্তু ওরা ততক্ষণে গ্রামের পথে রওনা দিয়েছে।।

গতকাল এসে মালামাল নিয়ে ওরা বাসা ছেড়ে চলে গেলো। দরজার এপাশে সবই আগের মতোই আছে। শুধু মানুষগুলো চলে গেছে,কেউ পৃথিবী ছেড়ে,কেউ বাসা ছেড়ে। আমি এখন আর বসে কারো জন্য অপেক্ষা করিনা,আর কেউ মিষ্টি হেসে বলবেনা,
---আন্টি কেমন আছেন?

আমি আমার মা হারানোর কষ্ট আর ওর সাথে  শেয়ার করতে পারিনি। কিভাবে করবো? ওর হারানোর কাছে আমি হেরে গেছি। এইটুকু বাচ্চা একটা মেয়ে এই বয়সেই অনেক হারিয়েছে। জানিনা, এই এতো বড় জীবন আর ছোট বোনটিকে নিয়ে রুমু কিভাবে এগুবে? কিভাবে সামাল দিবে মাঝপথে থেমে যাওয়া অচল হওয়া জীবনটাকে?
 মনে শুধু প্রশ্ন জাগে,
জীবন এমনও হয়?

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক