Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:১৫, ২৩ মার্চ ২০২৫

প্রবন্ধ

মদিনা ও নববী

মদিনা ও নববী
ছবি: সবার দেশ

(২য় পর্ব)

(আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত)

ষষ্ঠদফা: ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পাঁচ'শ বছর আব্বাসীয় শাসনকাল। এ সময় খলিফা মাহদী বিন আবু জাফর হজ্জ করতে এসে মদিনা এসে জাফর বিন সুলাইমানকে মদিনার গভর্নর নিযুক্ত করেন। খলিফার নির্দেশে নতুন গভর্নর মসজিদ স¤প্রসারণের কাজ শুরু করেন। তিনি উত্তর দিক প্রশস্ত করণসহ আশপাশের অনেক বাড়ি-ঘর খরিদ করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করেন।

সপ্তম দফা: ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খেলাফত পতনের পর ক্ষমতা চলে যায় মিসরীয় মামলুক বাদশাহদের হাতে। তাদের মধ্যে মসজিদের স¤প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখান আশরাফ কাইতবাই। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে রমজান মাসে যখন মসজিদে আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় তখন কাইতবাই মসজিদটি পুনঃনির্মাণসহ ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। সমাধির চারদিকের দেয়াল নির্মাণ করেন। দেয়ালের চারদিকের পিলার নির্মাণ করে নবী করিম (স.)-এর চেম্বারটি (যা বর্তমানেও বিদ্যমান আছে) পুনঃনির্মাণ করেন। বর্তমান মেহরাবটিও তখনই নির্মিত হয়েছিল। মাকসুরা সংলগ্ন পূর্ব দিকে সোয়া দু’গজ বৃদ্ধি করেন। ছাদের উচ্চতা বাড়ান ২২ ফুট।

অষ্টম দফা: সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ক্ষমতায় আসেন তুর্কিগণ। কাইতবাইয়ের নির্মাণ কাজের পর দীর্ঘ পৌনে চার'শ বছর মসজিদের কোনো নির্মাণ কাজ না হওয়ায় নানা স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয়। তা লক্ষ্য করে তৎকালীন মসজিদের ইমাম দাউদ পাশা সুলতান আবদুল আজিজ আল-আওয়ালের নিকট পত্র লিখে মসজিদের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনের কথা বলেন।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন সুলতান আব্দুল আযীয। তুর্কী সুলতানদের মধ্যে তিনি মসজিদের ব্যাপক উন্নয়নসহ পুনঃনির্মাণের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সুলতান আবদুল আযীয় জনৈক হালীম আফন্দীকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে জরুরি সরঞ্জাম, টাকা-পয়সা, দক্ষ পাথর কাটার কারিগরসহ অপরাপর কাজের যোগ্য কারিগর যোগাড় করেন। কারিকরেরা বিভিন্ন পাহাড়ে সুন্দর পাথরের খোঁজে বের হয়ে পড়েন। সে সময় মাকসুরা, মিম্বার, পশ্চিম দেয়াল, মেহরাবে নববী, মেহরাবে ওসমানী, মেহরাবে সোলাইমানীসহ পুনঃনির্মাণ সাধন করেন। কারিগরগণ এ কাজে অভিনব ও নজিরবিহীন কারুকার্য পেশ করেন। তখন দেয়ালের নিচে মার্বেল পাথর, ছাদের গম্বুজে নক্সা এবং রওয়াজার খুঁটিতে রঙিন মারবেল পাথর বসানো হয়। মিনারের ভিতের জন্য পানির লেভেল পর্যন্ত খনন করে কালো পাথর দ্বারা ভিত্তিমূল স্থাপন করা হয়। এ কাজ শেষ হতে সময় লাগে ১২ বছর। সুন্দর ও মজবুত মসজিদ ভবনের পরিধি দাঁড়ায় ৪০৫৬ বর্গ মিটার। নববী মসজিদের নির্মাণ ও স¤প্রসারণ কাজ শেষ হওয়ার পর একই করিগর, প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রী কা'বা মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করেন।

নবম দফা: সউদ-পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ এবনে সাউদের মৃত্যু হয় ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তিনি সউদী সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন করে যান। তৎপুত্র সাউদ এবনে আবদুল আজিজের সময় ইব্রাহিম পাশা কর্তৃক দখলচ্যুত হয়ে পুনঃদখলের কারণে সউদী সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় সাউদ এবনে আবদুল আজিজকে। একই অবস্থা হয়েছিল আব্দুল আজিজ বিন আবদুর রহমান আল সাউদ (১৮৭৬-১৯৫৩) এর আমলেও। তাই তাকে বলা হয় তৃতীয় সৌদি সাম্রাজ্যের প্রথম বাদশা। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ‘হারামাইন থেকে শরীফাইন' (মক্কা ও মদিনার মসজিদ)-এর উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। সউদী আমলের নির্মাণ কাজকে দুই পর্বে ভাগ করা যায়।

প্রথম ভাগ: ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসে বাদশাহ আবদুল আজিজ মসজিদে নববীর প্রশস্তকরণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা প্রকাশ করে একই সালে প্রাথমিক কাজ আরম্ভ করে দেন। মসজিদের উত্তর-পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের ঘরবাড়ি খরিদ করে ভেঙে ফেলা হয়। উত্তর দিকের বারান্দার পূর্বের ৬২৪৬ বর্গ মিটার আয়তনের সাথে আরো ৬০২৪ বর্গ মিটার পর্যন্ত স¤প্রসারণ করেন। অপরাপর স¤প্রসারণসহ মসজিদের মোট আয়তন দাঁড়ায় ১৬৩২৬ বর্গ মিটার আর খরচ হয় পাঁচ কোটি রিয়েল। প্রথম সউদী ইমারতের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে ১২৮ মিটার ও প্রস্থে ৯১ মিটার। সমস্ত মেঝেতে ঠাÐা মার্বেল পাথর বিছানো হয়। পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে সিঁড়ি বের করা হয়। পূর্ব দিকের সিঁড়ি বরাবর গেটের নাম আব্দুল আজীজ গেট আর পশ্চিম দিকের গেটের নাম রাখা হয় বাদশা সউদ গেট। আগের নির্মিত পাঁচটি মিনারা পরিবর্তন করে পূর্ব ও পশ্চিম কোণে ৭২ মিটার উঁচু আরো দুটি মিনার নির্মাণ করার পর নববীর চার কোণে চারটি মিনার হয়ে যায়।

বাদশা ফয়সাল মসজিদের পশ্চিম দিকে নামাযের অতিরিক্ত জায়গা প্রস্তুত করার জন্য ঐ দিকের বাড়ি-ঘর ভেঙে মালিকদের পাঁচ কোটির অধিক রিয়েল ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। বাইরে ছায়ার জন্য ৩৫,০০০ বর্গ মিটার জায়গায় ছাউনী তৈরি করা হয়। এসব কাজ হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

দ্বিতীয় ভাগ: দ্বিতীয় সউদী স¤প্রসারণ হয় ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। নববী স¤প্রসারণের ইতিহাসে এটি সব চেয়ে বড় স¤প্রসারণ কাজ। কারণ এ স¤প্রসারণ করার আগে যতো লোক নামায আদায় করতে পারতো এ সম্প্রসারণ করার পর নামায আদায় করতে পারে এর চেয়ে নয় গুণ বেশি। পরিশেষে নববী মসজিদে সর্বমোট মিনারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। মিনার দশটির অবস্থান যথাক্রমে বাদশা আবদুল আজিজ কর্তৃক সম্প্রসারিত এলাকার চার কোণে চারটি, বাদশা ফাহাদ কর্তৃক সম্প্রসারিত এলাকার চার কোণে চারটি ও উত্তর দিকের মাঝামাঝি রয়েছে দুটি মিনার। প্রত্যেকটি মিনারার আলাদা আলাদা নাম ও গুরুত্ব রয়েছে।

এ সংস্কারের নির্মাণ কাজ এতোই নয়নাভিরাম ছিল যে, পৃথিবীর যে কোনো প্রথম শ্রেণীর স্থাপত্য শিল্পকে পেছনে ফেলে দিতে পারে মসজিদে নববীর স্থাপত্য শিল্প। বর্তমানে দিনের বেলায় মসজিদের খোলা চত্বরে বসলে দেখা যাবে মাথার উপর প্রকাণ্ড আকারের অনেক ছাতা। প্রজাপতির ডানার মতো বিচিত্র বর্ণের স্বচ্ছ এ ছাতাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোদের তাপ বাড়তে শুরু করলেই খুলতে শুরু করে। রোদের তেজ কমে গেলে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে একেকটি ছাতা একেকটি সুদর্শন থামে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অটো ছাতাগুলো এতই বড় আয়তনের যে, মাত্র আশিটির মতো ছাতা পূর্ব দিকের সমগ্র খোলা চত্বরটি ঢেকে রাখতে পারে।
সারা মুসলিম জাহানের অহংকার যে, নবী করীম (স.)-এর মাজার শরীফের ওপর বিশ্ব বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কর্ম মাথা উঁচু করে ইসলামের জয়গান প্রচার করছে। সউদী বাদশাহী আমলের মসজিদে নববীর স¤প্রসারণ ও নামায আদায়কারীর ধারণ সংখ্যা দাঁড়ায় নিম্নরূপঃ

তুর্কী সম্প্রসারণসহ প্রথম সউদী স¤প্রসারণের পর মোট স্থানের আয়তন ১৬,৩২৬ বর্গ মিটার ও নামাযীর ধারণ সংখ্যা ২৮,০০০ জন। দ্বিতীয় সম্প্রসারণের পর গ্রাউন্ড ফ্লোরের আয়তন ৮২,০০০ বর্গ মিটার ও লোকসংখ্যা ধারণ ক্ষমতা ১,৬৭,০০ জন। ছাদের আয়তন ৬৭,০০০ বর্গ মিটার লোক সংখ্যা ৯০,০০০ জন। খোলা চত্বরের আয়তন ১,৩৫,০০০ বর্গ মিটার এবং লোক সংখ্যা ধারণ ক্ষমতা ২,৫০,০০০ জন। মসজিদ, ছাদ ও চত্বর এ তিন এলাকায় সর্বমোট নামাযীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৩৫,০০০ জন।

অবকাঠামো: এতবড় মসজিদে সুযোগ-সুবিধাসহ আর কি কি রয়েছে কার না জানতে ইচ্ছে করে। বিশ্বের বৃহত্তম সৌন্দর্যে অনুপম মসজিদে রয়েছে:
১. ২৭টি গ্রাইনডিং ডোর। কাঠের তৈরি প্রতিটি ডোরের ওজন আড়াই টন ৷
২. গম্বুজ ডেকোরেশন করতে লেগেছে ৬৮ কেজি স্বর্ণ।
৩. গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে ২,১৭৪ টি, বেইজমেন্টে রয়েছে ২,৫৫৪ টি ও ছাদে রয়েছে ৫৫০ টি পিলার বা খুঁটি।
৪. খুঁটির ডেকোরেশনে লেগেছে ১,৬০০ টন পিতল।
৫. চলন্ত সিঁড়ি ৪ জোড়া ও সাধারণ সিঁড়ি ১৮ জোড়া।
৬. স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ক্যামেরা ৫৪৩ টি।
৭. গ্রানাইট মোজাইককৃত এলাকার পরিমাণ ৪৫,০০০ বর্গ মিটার।
৮. শ্বেতমার্বেল পাথর বসানো এলাকার পরিমাণ ১৬০,০০০ বর্গ মিটার 
৯. এসি টানেলের দৈর্ঘ্য ৭ কিলোমিটার।
১০. এসি টানেলের প্রস্থ ৬.১ মিটার।
১১. এসি টানেলের উচ্চতা ৪.১ মিটার।
১২. এসি প্লান্টের আওতা ৭০,০০০ বর্গমিটার।

নবী করিম (স.)-এর আমলে মসজিদের কোনো মিনার ছিল না। উমর বিন আবদুল আজিজ সর্বপ্রথম চার কোণে চারটি মিনার নির্মাণ করেন। প্রত্যেকটির উচ্চতা ২৭.৫ মিটার। পঞ্চম মিনারটি নির্মাণ করেন কাইতবাই। সউদী স¤প্রসারণের সময় পূর্বের পাঁচটি মিনারের মধ্যে তিনটির স্থলে ৭২ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন দুটি মিনার নির্মাণ স্থাপন করা হয়।

সউদী দ্বিতীয় সম্প্রসারণের সময় ১০৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট আরো ৬টি মিনার যোগ করা হয়। প্রতিটি মিনারের অর্ধচন্দ্রাকৃতির উচ্চতা ৬ মিটার এবং ওজন ৬.৫ টন।

মসজিদ এলাকায় মোট ২২টি কার পার্কিং এলাকা রয়েছে। ২২টিতে একসাথে ৪,৪৪৪টি গাড়ি অবস্থান করতে পারবে। মসজিদ চত্বরে ১৪টি ধৌতাগার রয়েছে। আর রয়েছে ৬,০০০ পানির ট্যাপ ও ২,০০০ টয়লেট।

আঙ্গিনার পাশে ফোল্ডিং গম্বুজ। মুক্ত আলো বাতাসের জন্য গম্বুজগুলো খুলে রাখা যায়, গম্বুজগুলোর আরো বৈশিষ্ট্য এই যে, ৮০ টন ওজন সম্পন্ন গম্বুজের গোলাকৃতির ভেতরের দিক কাঠের তৈরি, যার মধ্যে হাতের কারুকাজ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো স্থানে ভেতরের দিকে খাঁটি সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো, আর বাইরের দিক রয়েছে জার্মানি সিরামিক।

৫৮,২৫০ বর্গ মিটার আয়তনের ছাদ, ছাদে লাগানো হয়েছে মার্বেল পাথর, ছাদের উপর ৫ মিটার উঁচু ১১০০০ বর্গ মিটার আয়তনের বারান্দা। ছাদ এমনভাবে তৈরি যে, ইচ্ছে করলে দ্বিতল করা যায়।
২৩৫,০০০ বর্গমিটার আয়তনের খোলা চত্বর, যার বেশকিছু অংশ বিশেষ তাপ প্রতিরোধক মার্বেল পাথরে ঢাকা। খোলা চত্বরে কিছু দূর পর পর রয়েছে ১৫১টি লাইট পিলার। খোলা চত্বরে একসাথে ৪,৩০,০০০ জন নামাযী নামায আদায় করতে পারে। বর্তমান প্রধান ইমাম-
১. শেখ ড. আলী বীন আবদুর রহমান হুদাইফি।
২. শেখ ড. আবদুল বারি আল যুবাইতি।
৩. শেখ হুসাইন আল সায়িক ও আরো অনেকে। মুয়াজ্জিন -
১. শেখ আবদুল রেহমান কাশিকজী। (চলবে,,,)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক