সারপ্রাইজ
মধ্যরাত। বাবা-মা এখন অবসরে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। এই পৃথিবীতে এখন একটা ওয়াস্ট পেপার। হঠাৎ ঘরের বেইলটা বেজে উঠে। এতো রাতে কে এলো? বাবা এগিয়ে যান। কে? উত্তর আসে- মামা আমি মুগ্ধ! তুমি এতো রাতে কোত্থেকে? প্রশ্ন করতে করতে দরোজা খুলে। দরোজা দাঁড়িয়ে প্রবাসী ঐশ্বিক। পেছনেই মুগ্ধ! বাবা কাঁপতে থাকে। ঐশ্বিকের মাকে ডাকে। মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। দুজনকে সারপ্রাইজ দিল ছেলে। বাবা-মা হারিয়ে গেলো অতীতে...
বড় দুঃসময়ে তার আগমন। মায়ের প্রাণের ধন। সামর্থ্য না থাকলেও অনাবিল স্নেহ ছিল। নাদুসনুদুস দেখতে। জাস্ট একটা ডল। বাজারের নিষ্প্রাণ ডল সাধারণত মেয়ে হয় কিন্তু ও ছেলে বাবু। প্রাণ-সম্পন্ন। হাঁটতে চাইতো না। বাবার চেয়ে মাকে বেশি পছন্দ করতো। বাপের সাথে খেলতো। কিন্তু মাকে কাছে পেলেই টগবগিয়ে ফুটতো। প্রথম যখন কথা বলতে শিখে, তখন মাকে ডাকতো; মা সিমেলা, সিমেলা! নাকট, নাকট! শিশুর আধো আধো বোল মিষ্টি।
বাবা-মা অভাবেও সুখি। বহু কষ্টে একটা সাদাকালো ১৪" টিভি কিনেছে। নব ঘুরিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করতে হয়। ছাদের উপরে এন্টেনা বসিয়ে দেখতে হয়। এন্টেনার দুই পাশে দুটো সিলবারের ঢাকনা। তাও চ্যানেল ক্লিয়ার নয়! ঐশ্বিক টিভি দেখে। "দেখো দেখো দেখোরে রুমানার বাহার, রঙেরই বাহার।"-এই বিজ্ঞানটা তার খুব পছন্দ! হাততালি দিতো এটাতে। বাবা সখ করে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেয়। ছোট্ট ঐশ্বিক তা বাজানোর চেয়ে তার উপরেই বসতে পছন্দ করে। অভাবের সংসারে ঐশ্বিক আনন্দের উপকরণ।
জীবনের প্রয়োজনে বাবা দূরে থাকে। তবুও ছেলের টানে প্রতি সপ্তাহে চলে আসে। ছুটি দীর্ঘ হলে ছেলের সাথে কুস্তি খেলে। ছোট্ট ঐশ্বিক মনে করে বাবাকে হারিয়ে দিয়েছে। আসলে বাবা হেরে যাওয়ার অভিনয় করে। বীরপুরুষ ঐশ্বিক। বাবা চলে যাবে শুনলেই অসুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু প্রয়োজন সমস্যা বুঝে না! এখনকার মতো তখন ভিডিও কল ছিল না! হাতে হাতে মোবাইলও ছিল না। এখন মানুষ যান্ত্রিক সুবিধা নেয়, তবে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কারোর চক্ষুলজ্জা নেই। নিজেই যেন সেরা! অপরকে ঠকিয়ে আস্ফালন করে। আসলে প্রতিপক্ষ বোকা নয়, বিশ্বাসী ছিল। বিশ্বাসী মানুষকে ঠকিয়ে নিজেকে সেরা ভাবে।
টুকটুক করে হাঁটে আর কথা বলে। শহরতলিতে থাকা ছেলেটি একদিন বাপের সামনে গিয়ে বলে,"আমি ধান গাছে চড়বো।" শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠাদের অভিজ্ঞতা এমনই! বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"হায়রে কৃষকের নাতি!' অবশেষে রিকশায় চড়ে নিয়ে যায় জমিতে। ধান গাছ দেখে অবাক ঐশ্বিক! এটাতে চড়া যায়? বাবা, ধান করতে কৃষকের পরিশ্রমের কাহিনি বলে। ছোট্ট ঐশ্বিকের বিস্ময়, এতো কষ্ট কেন? বাজার থেকে কিনলেই হয়! জেনারেশন গ্যাপ। গ্রামের ছেলে আধুনিক যন্ত্র বুঝে না। আর শহুরে ছেলে কৃষি বুঝে না। তার কাছে বাজার মানেই সব কিন্তু বাজারের সরবরাহ মাথায় ঢুকে না!
ছেলে ধীরে ধীরে বড় হয়, বাবা-মা বৃদ্ধ হয়। একই পরিবেশে একই খাবারে একজন বাড়ে একজন কমে এটাই প্রকৃতি। দুদিনের দুনিয়া একটা মঞ্চ। এখানে চলে উদয় অস্তের অভিনয়। তারপর অজানায় হারাতে হয়। অজানা থেকে আগমন, অজানায়ই প্রস্তান। যতজন হারিয়েছে কেউ ফিরেনি।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার