প্রবন্ধ
মদিনা ও নববী

(শেষ পর্ব)
বর্তমানে বর্গাকারের খোলা চত্বরসহ মসজিদে নববীর দৈর্ঘ্য কম-বেশি ৫৫০ মিটার। চত্বরের মাঝখানে মসজিদের দৈর্ঘ্য কম-বেশি ৪০০ মিটার ও প্রস্থ কম-বেশি ৩০০ মিটার। বাইরের খোলা চত্বরসহ কম-বেশি ৩০০,০০০ (তিন লক্ষ) বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট মসজিদে নববীর পূর্বদিকে কিং আবদুল আজিজ রোড। কিং আবদুল আজিজ রোডের পশ্চিম দিক থেকে শুরু হয়ে নববীর পূর্ব সীমানার রিংরোড পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে জান্নাতুল বাকী এলাকা। দক্ষিণ দিকে খেজুরের মার্কেট। শত প্রকারের খুরমা খেজুর এখান থেকে পাইকারি ও খুচরা কিনতে পাওয়া যায়। উত্তর দিকে প্রথম রিংরোডের ভেতর রয়েছে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ভবন, মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্সসহ বহুতল বিশিষ্ট বেশকিছু এপার্টমেন্ট। প্রথম রিংরোডের বাইরে সৈয়দ আস সুহাদা সড়ক, কিং ফাহাদ সড়ক ও আবিতার আল গাফ্ফারি সড়ক। এসব সড়কের উভয় পাশেই মদিনার প্রধান হাট-বাজার ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। পশ্চিম দিকে রিংরোডের পরেই জাবাল সালা নামক পাহাড়িয়া এলাকা। পাহাড়ের পেছনে বেশকিছু এগ্রিকালচারাল এলাকা রয়েছে বলে জানা যায়।
বর্তমানে খোলা চত্বরে দন্ডাায়মান কলামের ওপর বিশেষ প্রযুক্তিতে বসানো হয়েছে ফোল্ডিং ছাতা, রোদের তাপ বাড়তে না বাড়তেই প্রজাপতির পাখার মতো ছাতাগুলো খুলে যায়, বন্ধ হয়ে যায় রোদ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই। ফোল্ডিং ছাতাগুলো একসাথে খুলে গেলে সমগ্র খোলা চত্বর ছায়ার মায়ায় মিলেমিশে কাল্পনিক রূপকথার পরীর রাজ্যে পরিণত হয়ে যায়।
প্রথমে কা'বা মসজিদ ও পরে নববী মসজিদের স¤প্রসারণ ও পুনঃনির্মাণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম। আমরা ১১ দিন দু মসজিদের পাশে থেকে উভয় মসজিদ স্বচক্ষে দেখলাম। উভয় মসজিদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে: রয়েছে বৈসাদৃশ্যও। আমার দেখা প্রধান প্রধান বৈসাদৃশ্যগুলো নিম্নরূপঃ
১. কা’বা মসজিদ খোলা চত্বরসহ মোট আয়তন কমবেশি ২১১,০০০ বর্গমিটার। নববী মসজিদ খোলা চত্বরসহ মোট আয়তন কম-বেশি ২৮৪,০০০ বর্গমিটার।
২. খোলা চত্বরসহ কা’বা মসজিদ আয়তকার এবং খোলা চত্বরসহ মসজিদে নববী বর্গাকার ভূমির উপর স্থাপিত।
৩. কা’বা মসজিদের খোলা চত্বর পেরিয়ে ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে নবী করিম (স.)-এর পৈত্রিক ভূমি, যা বর্তমানেও নবী (স.) এর বাড়ি হিসেবে সর্বজন বিদিত। মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বিশ্ববিখ্যাত সবুজ গম্বুজের কাছে নবী করিম (স.)-এর খরিদা বসতবাড়ি। বসত বাড়ির পাশেই দক্ষিণ-পশ্চিম গেটের পাশে নবী (স.)-এর রওজা অবস্থিত।
৪. কা’বা মসজিদে নামায আদায় করতে হয় কা’বাকে কেন্দ্র করে চতুর্দিক থেকে বৃত্তাকারভাবে দাঁড়িয়ে আর মসজিদে নববীতে নামায আদায় করতে হয় কা'বার দিকে (দক্ষিণ দিকে) মুখ করে।
৫. কা’বা মসজিদের সিলিং ও দেয়ালে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বদা শো শো শব্দে সমগ্র এলাকা সরব থাকে। নববী মসজিতে বাতাস পরিচালিত হয় সেন্ট্রাল এসি থেকে। প্রতিটি কলামের গোড়ায় সংযুক্ত এসি থেকে সর্বদা শীতল বাতাস বের হতে থাকে।
৬. কা’বা মসজিদে তওয়াফকারীগণ সশব্দে জরুরি দোয়া ও তালবিয়াহ পাঠ, অহর্নিশি (শুধু ফরজ নামাযের জামায়াত আদায়ের সময়টুকু বাদ দিয়ে) কা’বা তওয়াফ, একইভাবে সাফা মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করার ফলে পরিবেশ সর্বক্ষণ অস্থির, কোলাহলপূর্ণ ও জনাকীর্ণ থাকে। নববী মসজিদের পরিবেশ সম্পূর্ণ উল্টো অর্থাৎ সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত ও শান্ত।
৭. কা’বা মসজিদে বিশেষ বিশেষ নামায আদায়ের সময় প্রচুর ভীড় হয়, অনেক সময় নামায আদায় করার জন্য স্থান পাওয়া যায় না। নববীতে এ অবস্থা হয় না।
৮. কা’বা মসজিদের কেন্দ্রের চারদিকে কম-বেশি ১৩,০০০ বর্গমিটার এলাকায় মহিলা অবস্থান নেই। অত্র এলাকা বাদ দিয়ে মহিলা মহল। অর্থাৎ কা’বা প্রদক্ষিণের জন্য চিহ্নিত গোলচত্বরের চারপাশের খোলা স্থানে মহিলা আসন নেই। এ এলাকা ছাড়া মহিলা আসন সুচিহ্নিত হলেও পর্দা/ পার্টিশন দিয়ে সুরক্ষিত নয়। নববীতে নবী করিম (স.)-এর সমাধির পাশে মহিলা অবস্থান নেই। মহিলাদের জন্য সমাধি দর্শনেও বারণ আছে। এ ছাড়া নববী মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মহিলা আসন সুচিহ্নিতসহ পর্দা/ পার্টিশন দিয়ে সুরক্ষিত।
৯. উভয় মসজিদের নির্মাণ শৈলী অত্যাধুনিক শিল্প সমৃদ্ধ হলেও নববী মসজিদের নির্মাণ শৈলী পরিপূর্ণ সুবিন্যস্ত, সুবিশাল ও সুনিপুণ।
১০. কা’বা মসজিদের বাইরের চত্বরে উষ্ণতা শোষক শ্বেত পাথর নেই- নেই রোদ ঠেকানোর ব্যবস্থাও। নববীতে বাইরের চত্বরে রয়েছে উষ্ণতা শোষক শ্বেত পাথরসহ রোদ ঠেকানোর জন্য বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত ছাতা।
১১. কা’বা মসজিদের স¤প্রসারণসহ এখনো নির্মাণ কাজ চলছে, তাই অনেক কিছুই এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো। নববী মসজিদের সম্প্রসারণসহ নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে, তাই সবকিছুই গোছানো গাছানো, সদ্য স্নাত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
১২. কা’বা মসজিদ আল্লাহর ঘর অর্থাৎ হা’রাম শরীফ কেন্দ্রিক, কা’বা ঘরকে বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গণ্য করে যুগে যুগে কা’বার চারদিক সম্প্রসারণসহ গড়ে উঠেছে কা’বা মসজিদ। নববী মসজিদ নবী করীম (স.)-এর রওজা মোবারক কেন্দ্রীক, রওজা মোবারককে মধ্যমণি হিসেবে গণ্য করে রওজার তিন দিকে গড়ে উঠেছে নববী মসজিদ।
১৩. কা’বা মসজিদের চারদিক থেকে কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করতে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। নববী মসজিদে নবী (স.)-এর রওয়াজা মোবারক বরাবর ইমাম সাহেবের ইমামতির সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে জামায়াতে নামায আদায় করতে বারণ আছে।
উভয় মসজিদে দিন দিন নামাযীর সংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়াতে হচ্ছে নামাযীদের নামাযের স্থানও। নববীর ১৪০০ বছর আগের এক’শ পঞ্চান্ন বর্গমিটার পরিমিত পরিমাণ ভ‚মি আজ কম-বেশি তিন লক্ষ বর্গমিটারে সম্প্রসারিত হয়েছে। সুহাইল ও সাহল নামীয় এতিম ভ্রাতৃদ্বয়ের এক টুকরো জমির উপর নবী করীম (স.) এর হাতের পরশ লাগা নববী নামের পরিমিত পরিসরের সেই টুনটুনি মসজিদটি মর্তবার দিক থেকে শান্তির বিচ্ছুরিত এক টুকরো আলোকরশ্মি আজ মহালোকসজ্জার মহীরূহে পরিণত হয়ে মহাবিশ্বকে মহিমান্বিত করে রেখেছে, চেতনার দিক থেকে এর ঐশ্লামিক ঐশ্বর্য ও ঈশপ্রাণতা ঈর্ষাতুর এবং সর্বোপরি স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে বিশ্বের বিস্ময়কর সকল স্থাপত্যকর্মকে পেছনে ফেলে ভুবন মনোহারিত্য নির্মাণশৈলী নিয়ে স্থাপনাটি যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে এভাবে স¤প্রসারিত হতে থাকলে একদিন প্রথম রিংরোডের ভেতরের পুরো এলাকাটাই মসজিদে নববীর সুশীতল চত্বরে চলে আসবে।
মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজের জন্য আবদুল আযীয ‘হালীম আফন্দী’ নামীয় একজন বিশিষ্ট প্রকৌশলীকে পাঠিয়েছিলেন। তার সাথে পাঠানো হয়েছিল একদল দক্ষ পাথর কাটার কারিগরসহ উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী। কারিগরগণ এই নির্মাণে অভিনব ও নজিরবিহীন কারুকার্য পেশ করেন। এ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে ৩ বছর। নববী মসজিদ নির্মাণের সময় পাথরের কারিগরেরা মূল্যবান পাথরের সন্ধানে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে যতো মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় সেখান থেকে সে পাথর তুলে এনে গভীর মনোযোগসহকারে মসজিদে নববীতে বসিয়ে দেয়।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বাদশা আব্দুল আজিজ মদিনার নববী মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পর যে নির্মাণসামগ্রী বেশি হয় সে অতিরিক্ত নির্মাণসামগ্রীসহ যন্ত্রপাতি ও কারিগর পাঠিয়ে দেয়া হয় মক্কার কা’বা মসজিদ নির্মাণের জন্য। তাই উভয় মসজিদের কারিগর ও মালামাল প্রায় এক ও অভিন্ন হলেও প্রতিবারই কাজের শুরু হয়েছে নববী থেকে এবং শেষ হয়েছে কা’বায়। যারা মসজিদে নববী দিয়ে যে কাজ শুরু করেছিলেন তারাই সে কাজ শেষ করেছেন কা’বা মসজিদ দিয়ে। তাই নববী মসজিদে যেখানে রয়েছে প্রশান্তি সেখানে কা’বা মসজিদে সেখানে রয়েছে ক্লান্তির ছাপ। মনে হয়, নববীতে প্রথম ব্যবহারের ফলে টেকনিশিয়ানদের টেকনোলজির ধার কমে গিয়েছিল। সেই ভোতা টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়েছে কা'বা মসজিদের সংস্করণ কাজে। আমার কাছে তো সেরকমই মনে হলো।
তার পরেও উভয় মসজিদে নামাযীদের ঠাঁই দিতে কর্তৃপক্ষকে যেভাবে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে, তা দেখে কবির ভাষার সাথে মিলিয়ে বলা চলে-
রাসূলের সৈনিক দিন দিন বাড়ছে
আল্লাহর ঘর ভরে মাঠ-ঘাট ছাড়ছে।
ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট এই চত্বর
বিশ্বের জমাজমি ভরে যাবে সত্তর! (সমাপ্ত)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক