ঝড় ও জলের জীবন
দক্ষিণে কড়ালগ্রাসী গাঙ ফুঁসে ওঠে আরেকবার। কাজেম মাঝি জোরে হাঁক ছাড়ে— ‘বইন্যা আইতেছে, হগ্গলে হুশিয়ার, সাবধান!’ ওদিক থেকে গাঙের ডাক আসে— গুম—গুম, হিস—সসস! শো—শো দমকা হাওয়ার ডাক শুনে বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে ওঠে কুসুমের। ঘরের সামনে দাঁড়ালেই গাঙের হুঙ্কার শোনা যায়। ঐ যে ছুটে আসছে পাগলা হাওয়ার দৈত্য! কুসুমের মনে নানান ভাবনা আসে। মাইনষ্যে কয়— আইজ আবার বইন্যা অইবে। হেই বছর য্যামন অইছিলো, হেইরহম। হেইলে আমরা যামু কই? আমাগো ঘর—সংসার কি ভাইস্যা যাইবে!
থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কুসুম। কখনও দক্ষিণে গাঙের পানে, আবার কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। তারপর বিড়বিড় করে নিজের সাথেই কথা বলে।
‘আল্লায় যদি মারে মাইনষ্যের সাধ্য কি বাঁচাইবে! এইবার যে ভাগ্যে কী আছে আল্লায়ই জানে।’
কথাগুলো নিজের উদ্দেশ্যে বলতে বলতে ঘর থেকে উঠোনে নেমে এলো কুসুম। সামনের ঘরের চৌকির উপরে বসে তার চার বছরের পঙ্গু ছেলে নবী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ইশারায় মাকে কী যেন বলছে। শো—শো বাতাসের শব্দে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
এখন বিকেল। তবে চারিদিক থেকে দানবের মতো অন্ধকারের একটা দেয়াল যেন দ্রুত ধেয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে আশেপাশের পুরো এলাকা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে। ভাবসাব এমন যেন যে কোনো সময় আকাশ ভেঙে নামবে। সেইসাথে ঝড়ো হাওয়ার তোড়ে গাছগুলো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হচ্ছে।
ঘরের সামনের পেয়ারা গাছের সাথে বাঁধা ছাগল দু’টি একনাগাড়ে চেঁচিয়েই যাচ্ছে। কুসুম খোঁয়াড় থেকে হাঁসমুরগিগুলোকে সামনের ঘরের এক কোণে এনে রেখে একদৌঁড়ে আবার বেরিয়ে গেল। ছাগল দু’টিকে ঘরে আনতে হবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে থেকে দ্রুত ঘরে ছুটে এলো আলতু। একবার ঘরের পেছনের দিকে গিয়ে আবার সামনে চলে এলো।
‘জয়নাল!’ জোরে একটা হাঁক ছাড়ল আলতু।
‘আইতেছি ম্যাবাই।’
পুকুরপাড় থেকে গলা চড়িয়ে বলল জয়নাল। এ বছর বেশকিছু মাছের চাষ করেছে তারা। সেই দুপুরের পর থেকে দুই ভাই মিলে পুকুরের পাড়ের উপরে জাল দিয়ে উঁচু ঘের তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। এইমাত্র কাজটা শেষ করেছে তারা। একছুটে ঘরের সামনে এসে জয়নাল জিজ্ঞেস করল,
‘কী অইছে ম্যাবাই, বোলাইছো ক্যা?
‘মোর লগে হাত লাগা। এই বাঁশ কয়ডা দিয়া ঘরডারে ঠেকা দেতে অইবে। য্যামনে পানি আইতেছে ঘরের ভিডার মাডি আলগা অইয়া গ্যালে ঘরডারে আর ঠেহাইতে পারমু না।’
ভাইয়ের সাথে ঘরের পেছন দিকে চলে গেল জয়নাল। আলতুর তুলনায় ছোট ভাই জয়নাল গায়ে—পায়ে বেশ তাগড়া। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা একহারা গড়নের শক্ত—সমর্থ পুরুষ জয়নাল। সে একাই অনেক কাজ করার শক্তি রাখে। কোদাল দিয়ে নিচের মাটিতে গর্ত করে একটার পর একটা বাঁশ দিয়ে ঘরটাকে ঠেঁস দিতে লাগল দুই ভাই। খুব দ্রুত কাজ করছে তারা। যে কোনো সময় ঝড় শুরু হতে পারে।
‘ঘর তো ঠেহা দিলা, কিন্তু শ্যাষ পর্যন্ত টিকতে পারমু তো? ঐদিকে চাইয়া দেহো, য্যামনে বাতাস ছাড়ছে কী যে অয় কেডা জানে!’ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল জয়নাল।
পেছন থেকে কুসুম বলে উঠল, ‘যাই অউক ঘর থুইয়া মুই কোনো হানে যামু না।’
জয়নাল কুসুমের কথা আমলে নিলো না। সে বলে উঠল, ‘ভাবিসাব, তুমি নিচে কিছু রাইখো না। সবকিছু উপরে তুইল্যা রাহো। নইলে ঘরে পানি ঢুইকা সব ভাইসা যাইবে।’
মড়মড় করে দক্ষিণ পাড়ের বড় রেইনট্রি গাছের মগডালটা ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা গেল। আলতু সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। বাতাসের শো—শো শব্দ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সে জয়নালের দিকে ঘুরে তাকাল।
‘খাইছে! মনে অয় তোর কতাই ঠিক। এই ঘরে আর থাহন যাইবে না। তাইলে সবগুলান একলগে মরতে অইবে।’
ঠিক তখনই চোখে পড়ল তোরাব আলী আর জোনাব আলীর পরিবার তাদের বাড়ির উপর দিয়ে রাস্তার দিকে ছুটছে। আলতুকে ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোরাব আলী বলে উঠল,
‘আরে আলতু, তুই এহনও ঘরে বইয়া রইছো! বেড়ি বান্ধ ভাইঙা গেছে। পানির ঢল আইতেছে। সবকিছু ভাইসা যাইবে। তাড়াতাড়ি স্কুলঘরে ল। হেইলে অন্তত জানডা বাঁচপে।’
জয়নাল বলে উঠল, ‘তোরাব ভাই ঠিকই কইছে, আর দেরি করনের সময় নাই। তাড়াতাড়ি লও।’
বলতে বলতে জয়নাল পঙ্গু ভাইপো নবীকে কোলে তুলে নিলো। কুসুম আলতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তুমি হাঁসমুরগির হাজিডা লও, মুই ছাগল দুইডারে লইয়া আইতেছি।’
তোরাব আলীর পেছন পেছন আলতুর পরিবারও ছুটল স্কুলঘরের দিকে। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই টের পেলো বাতাসের জোর ধাক্কা। টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার পাশের গাছপালাগুলো আর বাতাসের একটা অসম যুদ্ধ চলছে। বাতাসের কাছে ছোট ছোট গাছগুলো যেন শিশু! কিছু গাছ ইতিমধ্যেই এদিক—ওদিক ভেঙে পড়ে গেছে।
নদী উপচে ফসলের ক্ষেতে পানি ঢুকে পড়েছে। আর মাত্র ফুটখানেক হলে রাস্তা ডুবে যাবে। রাস্তার দু’দিকের বড় গাছের ডালপালা নুয়ে এসে মাটিতে পড়ার উপক্রম। কুসুম ভয় পায়। এই না বুঝি গাছের নিচে চাপা পড়ল! গাছের আড়াল সরে গেলে যখন খোলা জায়গায় এসে পড়ল তারা। নিজেকে আর সামলাতে পারল না কুসুম। বাতাসের ধাক্কায় ছিটকে একপাশে পড়ে যাচ্ছিল সে, ঠিক সময়মতো তাকে দেখতে পেয়ে হাতটা ধরে ফেলল আলতু।
‘ছাগল দুইডার দড়ি আমার দারে দাও আর একহাত দিয়া শক্ত কইরা আমারে ধরো। কাদায় পা দিও না, ঘাসের উপ্রে দিয়া হাডো।’
আলতু খেয়াল করল পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে। এভাবে চললে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তাটা ডুবে যাবে। স্ত্রীকে বলে নিজেও জোরে পা চালাতে লাগল। অবশ্য স্কুলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। জয়নাল ওদের ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা সামনে চলে গেছে।
ওরা যখন স্কুলে পৌঁছাল, ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। একটা কক্ষের এক কোণে ঠাঁই করে নিলো আলতু ও তার পরিবার। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। শো—শো বাতাস আর পানির স্রোতের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। স্কুলের দক্ষিণ দিক হতে দমকা হাওয়া তেড়ে এসে সোজা প্রবেশ করছে স্কুল—কক্ষগুলোয়। দক্ষিণ দিকটা প্রায় খোলা। কিছু গাছ রয়েছে, সেগুলো বাতাসের সাথে অনবরত লড়াই করছে। ডালপালাগুলো একবার একদিকে আরেকবার অন্যদিকে হেলে পড়ছে। যে কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে যেন।
জয়নাল বলল, ‘ম্যাবাই, দেহো গাছগুলান মনে অয় এহনই ভাইঙা পড়বে। অন্ধকারের মদ্যেও দেহা যাইতেছে।’
‘অইগুলা ভাইঙা গেলে পুব পাশের অই টিনের ঘরডাও আর টেকবে না।’ আলতু বলল।
আলতুর কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে বড় একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ আসলো। জয়নাল বলে উঠল, ‘এইতো গ্যালো!’
কিছুক্ষণের মধ্যেই মটমট করে কী যেন ভাঙার শব্দ শোনা গেল। সাথে সাথেই দড়াম করে স্কুলের পাশের জমিতে কী যেন ভেঙে পড়ল। জয়নাল বলে উঠল,
‘ম্যাবাই, একটু আগে যা বললা হেইডাই তো অইলো। ঐ যে ঘরডার চাল উড়াইয়া ক্ষেতে নিয়া ফালাইছে।’
‘আমাগো ঘরের যে কী অবস্থা আল্লায়ই জানে। রাইতটা পোহাইলেই বাড়ি যামু আমি।’
থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য আলোকিত হয়ে উঠেছে স্কুলঘরটা। সর্বত্র মানুষের হইচই আর চেঁচামেচির শব্দ। কেউ কারো কথা বুঝতেও পারছে না। স্কুলের মাঠে এখন হাঁটু সমান পানি। স্কুলঘরে প্রায় শ’দুয়েক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। খাবার কিংবা পানীয় জল নেই তেমন, কোনো কোনো রুমে অনেকে রাত কাটাচ্ছে অন্ধকারেই। আলতুদের রুমে কারা যেন একটা হারিকেন জ্বালিয়েছে। সেই মৃদু আলোয় একে অন্যকে দেখতে পাচ্ছে শুধু।
স্কুলের মাঠে থৈ—থৈ পানি, কোথাও কোথাও হাঁটুর অনেক উপরে। স্কুলঘরটা মাঠ থেকে বেশ উঁচুতে, তাই এখানে পানি ওঠেনি। প্রতিটা কক্ষে গিজগিজ করছে মানুষ। ওদিকে ঝড়ের তাণ্ডব চলছে প্রবলভাবে। আলতু জয়নাল নিজেদের কথা ভাবছে না। নবীকে একটা বেঞ্চের উপর শুইয়ে দিয়ে কুসুম তার পাশে বসে আছে। পাশে দাঁড়ানো আলতুর উদ্দেশ্যে কুসুম বলল,
‘আল্লায়ই জানে ঘরডা ঠিকঠাক আছে নাকি ভাইঙা পড়ছে।’
‘আগে জান তো বাঁচুক, পরে ঘরের কথা চিন্তা করিস। নবীর দিকে খেয়াল রাখিস, যেন পইড়া না যায়।’ কুসুমের উদ্দেশ্যে বলল আলতু।
কেউ একজন বলল, ‘আর এক বিঘত পানি বাড়লেই স্কুলের রুমে পানি ঢুইক্যা যাইবে।’
জয়নাল বলল, কিছু একটা করন দরকার। শক্ত মাটি দিয়ে দরোজাগুলার সামনে উচা কইরা বান্দ দিতে অইবে। ‘তোরাব, ল যাই। আমরা কামডা কইরা ফালাই। রাইতে পানি ঢুইক্যা পড়লে কই যামু?’
জয়নাল আর তোরাব মিলে সবগুলো দরোজার মুখে মাটি দিয়ে উঁচু করে বাঁধ দিয়ে দিলো। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো সবাই।
কেউ একজন কয়েক মুঠো মুড়ি এনে কুসুমের অঁাচলে ঢেলে দিলো। ‘এই কয়ডা খাইয়া লও, পেডের খিদাও তো মেটাইতে অইবে!’
জয়নাল বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। পাশে দাঁড়ানো আলতু জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে, কী কইতেছো?’
‘ভাবতেছিলাম নুরীর কতা। আমাগো এহানেই যদি এই অবস্থা অয়, অরা তো সাগরের আরও কাছে, তাইলে অগো কী অবস্থা কেডা জানে! ঐদিগে তো আরও বেশি পানি উঠনের কতা। এই সময় বেলাল বাড়িতে আছে নাকি ট্রলারে হেইডাও তো জানি না।’
‘হ রে! নিজেগো চিন্তায় বইনডার কতা ভুইল্লাই গেছিলাম। বেলাল বাড়িতে না থাকলে ছোড পোলাডারে লইয়া অয় একলা কী করতে আছে কেডা জানে। এহন এমন অবস্থা যে যাইয়া একটা খোঁজ নেওয়াও সম্ভব না। কী যে করি!’ আলতুর কণ্ঠে হাহাকারের সুর।
‘চিন্তা হইরো না ম্যাবাই। য্যামনে হউক, কাইল মুই গিয়া অগো খোঁজখবর নিমু।’ জয়নাল বলল।
‘হ। হেইডাই কর।’ আলতু ভাইয়ের কথায় সায় জানাল।
পানি ভেঙে বাড়ির দিকে ছুটছে আলতু। সকাল হতেই আর দেরি করেনি সে। কুসুম আর নবীকে স্কুলঘরে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে সে। বাতাসের বেগ গতকালের চেয়ে অনেক কম। তবে এখনও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়োছে। রাস্তায় এখন হাঁটুর উপরে পানি। এখানে ওখানে গাছ ভেঙে পড়ে আছে। সেই সাথে আছে স্রোত! স্রোতের তোড় ঠেলে বাড়ি অভিমুখে চলল আলতু।
ঘরের সামনে পৌঁছে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। ঘরটি এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তবে মেঝেতে থৈ—থৈ পানি। ঘরের সামনে দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছনে গিয়ে দেখল ঠেঁস দেয়া বাঁশগুলো এখনও তেমনই আছে। তবে ঘরের পেছনে আমড়া গাছটা ভেঙে পড়ে আছে। সেইসাথে কিছু চারাগাছ। রেইনট্রি আর মেহগনি।
আলতু ঘুরে ঘরের দিকে এগোতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়াল। একটা সাপ ভেঙে পড়া আমড়া গাছের ডালে পেঁচিয়ে আছে। আলতু গাছের একটা শক্ত ডাল হাতে তুলে নিলো। এটাকে এখান থেকে না সরালে যে কোনো সময় ঘরে ঢুকতে পারে। গাছে নাড়া লাগতেই সাপটা ডাল বেয়ে নেমে পেছনের জঙ্গলের দিকে চলে গেল।
ছপ—ছপ—ছপ! পানি ভেঙে দ্রুত ছুটছে জয়নাল। সে ভেতর থেকে একটা তাড়না অনুভব করল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। ওখান থেকে বাসে চড়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা লাগবে। একমাত্র বোনটির কী অবস্থা কে জানে!
রাস্তার বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও পানিতে ডুবে আছে। বাস গন্তব্যে পৌঁছাতে একঘণ্টার স্থলে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগল। জয়নাল বাস থেকে নেমে অটোস্ট্যান্ডে গিয়ে পড়ল আরেক বিপাকে। এখানে কোনো অটোরিকশা নেই। রাস্তায় এখনও পানি, এলাকার বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ভেঙে গেছে, গাছ উপড়ে পড়ে কোনো কোনো স্থানে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। তাই কোনো অটোরিকশা চলছে না। বেলালদের গ্রাম এখন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। জয়নাল দ্রুত পা চালাল।
পানি ভেঙে প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে বেলালদের গ্রামে পৌঁছাল জয়নাল। এই গ্রামের অবস্থা তাদের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক। যেদিকে তাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। এখানে সেখানে গাছপালা পড়ে আছে, যত্রতত্র ভাঙা ঘরবাড়ি, ছড়ানো—ছিটানো টিনের চালা।
আর মাত্র দু’টা বাড়ি পার হলেই তার বোনের বাড়ি। বাড়িটাতে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল জয়নাল। নীরব—নিথর, থমথমে একটা অবস্থা। কোথাও কেউ নেই। এ বাড়িতে দু’টো মাত্র ঘর। একটা তার বোন নুরীর, অন্যটা ওর ভাসুরের। দু’টো ঘরই ভেঙে পড়ে আছে। মানুষজনের চিহ্নও নেই! তাহলে কি নুরী আগেই বাড়ি থেকে সরে গিয়েছিল? নাকি! জয়নাল আর ভাবতে পারল না। সে কয়েকবার বোনের নাম ধরে ডাকল। কোনো সাড়া নেই। আশেপাশে কাউকে চোখেও পড়ছে না যে জিজ্ঞেস করবে।
জয়নাল পায়ে পায়ে বোনের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ঘরের এক পাশের টিন উড়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। জয়নাল এদিকে ওদিকে খোঁজে। ঘরের পেছনের চত্বরে, পুকুরে ও তার আশেপাশে। কোথাও নুরী কিংবা এক বছরের ভাগ্নে হাসুর চিহ্নও নেই! আবারও কয়েকবার নুরীর নাম ধরে ডাকল জয়নাল। কেউ সাড়া দিলো না।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ কানে এলো জয়নালের। থমকে দাঁড়াল সে। পেছনে ফিরে এদিকে ওদিক চোখ বোলাল। ‘নুরী! নুরী!’ বলে কয়েকবার ডাকল আবার। আবারও সেই গোঙানির শব্দ। এবার কিছুটা স্পষ্ট শোনা গেল। ঘরের চৌকির উপরে চাপা পড়া টিনের চালার এক প্রান্ত উঁচু করে ধরল জয়নাল।
‘ছোট ভাই!’ মৃদুস্বরে ডাকটা ভেসে এলো।
অস্থির হয়ে উঠল জয়নাল। খুব সাবধানে টিনের চালা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো সে। দু’টো পা চোখে পড়ল। জয়নাল বুঝে ফেলল তার বোন এই ঘরের চালার নিচে চাপা পড়েছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চালাটা মাথার উপরে তুলতেই দেখতে পেল ভেঙে যাওয়া চৌকির একপাশে শুয়ে আছে নুরী। কাদায় মাখামাখি অবস্থা।
‘নুরী! নুরী! তুই ঠিক আছস তো!’
‘আছি।’ কান্নাজড়িত মৃদু কণ্ঠ নুরীর।
‘আরেকটু খাড়া! আমি তোরে বাইর কইরা আনতেছি।’
জয়নাল পিঠের উপর চালাটার ভার নিয়ে বোনের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলো। নুরী ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো। জয়নাল নিজের পিঠের উপর থেকে টিনের চালাটা সরিয়ে বোনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নুরীর কোলের মধ্যে তার এক বছরের ছেলে হাসু।
‘তুই ঠিক আছোস তো!’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল জয়নাল।
‘হুম।’ ম্লান হেসে জবাব দিলো নুরী।
‘আর হাসু?’
‘হ। আমার হাসুরে আগলাইয়া রাখছি। তয় তুমি সময়মতো না আইলে যে কী হইতো জানি না।’
‘তোর ভাসুরেরা সব কই? হেরাও কি আটকা পড়ল নাকি?’
‘না। বড় ভাবিরা একদিন আগেই তার বাপের বাড়ি চইলা গেছে।’
‘যাউক। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে তোগো ছহি ছালামতে ফিরা পাইলাম। ল, এহন বাড়ি যাই।’
‘হাসুর বাপে যদি ফিরা আইসা আমগো না পায়? হেয় তো চিন্তা হরবে।’ নুরীর কণ্ঠে শঙ্কা।
‘অসুবিধা নাই। সামনে কাউরে পাইলে জানাইয়া যামু। বেলাল ফিইরা আইলে য্যান আমগো বাড়ি যায়।’ সান্ত্বনার সুরে বলল জয়নাল।
নুরীর মনে শান্তি ফিরে এলো। সে মৃদু হাসল। জয়নাল ভাগ্নে হাসুকে কোলে তুলে নিলো। আবার পানি ভাঙতে পথে নামে জয়নাল। সাথে ছোট বোন নুরী ও তার ছেলে হাসু।
ঝঞ্ঝা—বিক্ষুব্ধ সময়ের গল্পে আলতু—জয়নালের মতো আরও অনেকে লড়াই করে এভাবেই বেঁচে থাকে। ঝড় ও বানের জলে ভাসা মানুষের জীবনে এমন সময় বারবার আসে। প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তারা। এই অনিয়শ্চয়তা আর অঘোর নিয়তি নিয়েই দিন কাটে তাদের। হাসে—কাঁদে, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
জয়নাল নুরীর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দেয়। শক্ত করে বোনের হাতটি ধরে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ‘ছপ—ছপ—ছপ’ পানি ভেঙে এগিয়ে যায় নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
পল্লবী, ঢাকা