উপন্যাস
আকাশ মেঘলা হলেও হাসে

(পর্ব দশ)
আমি বিছানায় একবার শুয়ে পড়লে ঘুমিয়ে যাই। মাঝরাতে উঠাউঠির কোন ঝামেলা নেই। এক ঘুমে সকাল। কিন্তু ইদানীং মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর মাথায় ঘুরে আমাকে সকালে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে। রীতিমত একটা শাস্তি। আজকেও ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে। একটু পানি খেতে ইচ্ছে করছে। মাথার কাছে রাখা কাঁচের মগে রাখা পানি ঢক ঢক করে পান করলাম। আজকাল সবাই এতো মগ উপহার দেয় বাসাটা একদম মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। মোবাইলের স্ক্রিনে সময়টা দেখে, খাটের কাছেই পাশের ছোট টেবিলের ওপরে রেখে দিলাম। একটু শীত শীত লাগছে, কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে আবার ঘুম দেবার চেষ্টায়। মাথার ভিতরে একটা চিন্তা এখনো শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, কবে ঢাকায় ফিরবো?
সকালে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। অফিসে যেতেও মন টানে না ইদানীং, বাসায় ফেরার কথা মনে হলে গায়ে জ্বর চলে আসে। পায়ের ব্যাথাটাও বেড়েছে। চিন চিন করে ছন্দের মতো একটা ব্যাথা ওপরে ওঠে আর নীচে নামে। বেড-টি খাবার অভ্যেস আমার কশ্চিনকালেও ছিলো না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। তবে ধনীদের এ অভ্যেস বিয়ের পরে ধীরে ধীরে আমিও আত্বস্থ করেছি। বিছানায় থাকা অবস্থায় আমার চা চলে আসে, সাথে একটা সিদ্ধ ডিম, মাঝে মাঝে টোস্ট বিস্কুট। আমার সহধর্মিনী নিজেও সকালে চা খায়, আমাকেও দেয়। তবে আমার এমন নেশা নেই যে সকালে চা খেতেই হবে, কফি খেতেই হবে।
খাট থেকে নেমে চোখে মুখে পানি দিয়ে, বাথরুম থেকে বের হলাম। রুমের দরজা খুললেই ডাইনিং টেবিল দেখা যায়। উঁকি মেরে দেখি আমার রাজকন্যা নাস্তা করছে। আমি দরজার পাশে ঝুলিয়ে রাখা একটা টি-শার্ট ও জিন্স পরে বেরিয়ে গেলাম ডাইনিং এর দিকে।
বাবা তুমি কি যাবে? নাকি আম্মু যাবে? মেয়ের প্রশ্ন।
আমি যাবো বাবা, তোমাকে নামিয়ে আমি লেকে গিয়ে হেঁটে আসবো।
তুমি কিন্তু ব্যায়াম করছো না, পায়ের ব্যাথা ব্যায়াম না করলে যাবে না।
তুমি দ্রুত নাস্তা করো, ঘড়ির দিকে দেখো, সময় নেই।
সমস্যা নেই, দশ মিনিট দেরী হলে কিচ্ছু হবে না।
সারাজীবনের জন্য সত্য কথা হচ্ছে মেয়েরা বাবার আর ছেলেরা মায়ের। আমার ছেলে আমার খবর টবর নেয় না। আমি আর মেয়ে বেরিয়ে গেলাম, তাদের মমতাময়ী মা, প্রতিদিনের মতো লিফট অব্দি এগিয়ে দেয়। সাথে কিছু উপদেশ বানী।
স্কুল বাসা থেকে দূরে না, মেয়েকে নামিয়ে আমি চলে যাই ধানমন্ডি লেকে। পায়ের ব্যাথার জন্য হাঁটতে পারি না। একটা স্থানে বসে আবার হাঁটা শুরু করলে দশ মিনিটের মতো আমার গতি আসে। কষ্ট সহ্য করে হাঁটি। এর পরে যখন সহ্য করতে পারি না, তখন বসে পড়ি। মনে মনে ভাবি সামনে তো অনেক পথ পার হতে হবে। জীবনকে টেনে নিতে হবে। আব্বা এ কথাটা বলেন, এখন অসুস্থ হলে কী করে চলবে। আব্বার বয়েস আশির কাছাকাছি এখনো দিব্যি ফুল টাইম চাকরী করছেন একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিদিন সকালে নামাজ পড়ে নিজের পড়ার টেবিলে কিছু সময় কাটানোর পরে হাঁটতে বেরিয়ে যান। এখনও পুরো ফিট।
আজ সকালে তেমন একটা রোদ নেই, ঘড়িতে আটটা বেজেছে বেশ আগেই। লেকের পানিগুলো কচুরীপানাতে ভরে গেছে। লেকের ভেতর দেখা যায় অনেকেই ব্যায়াম করেন, ছোট ছোট দল করে এ চর্চা চলতে থাকে। কিছু কিছু ট্রেনার দেখা যায় যারা আর্মিতে যাবার জন্য তরুণ-তরুণীদের ট্রেনিং দেন। লেকের ভিতরে ব্যাটমিন্টনের কোর্ট আছে অনেকগুলো সারা বছর এখানে খেলা চলে, ছোট গোলপোষ্ট বানিয়ে ফুটবল খেলে, ভলিবল খেলে। কী আর করবে এদের খেলার জায়গা নেই তাই এটা এদের দখলে। অনেক ছেলে মেয়েরা আসে সকাল থেকেই প্রেম করতে। হকার আছে, মাঝে মাঝে বিশেষ করে ছুটির দিনে ব্যাংকের লোকজন আসে, ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে বলে। আর প্রতিদিন তো নানা ধরনের ক্যাম্পেইন চলে। লেক ধীরে ধীরে তার জৌলুস হারাতে বসেছে। এত লোকের আনাগোনা, এদের দেখে বহিরাগত মনে হয়। রাতের বেলা আরো খারাপ অবস্থা। গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়। (চলবে,,,)
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার