Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০১:২১, ৩০ মার্চ ২০২৫

প্রবন্ধ

মদিনা জিয়ারত

মদিনা জিয়ারত
ছবি: সবার দেশ

মক্কা-মদিনায় আমাদের সময় ছিল খুবই টাইট। ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে পুনরায় বাড়ি ফেরা পর্যন্ত প্রতিটি দিন তারিখ ও সময় ছিল তফসিলভুক্ত। কখন কি করবো, কোথায় থাকবো, কোথায় যাবো ইত্যাদি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে ‘টাইম অ্যান্ড ওয়ার্ক’ ভ্রমণ তফসিলে পূর্ব নির্ধারিত ছিল। ঈদের দিন মদিনা জিয়ারত করার কথা থাকলেও সকাল ৮ ঘটিকায় মক্কার হোটেল থেকে বের হয়ে রাত ৩ ঘটিকায় মদিনার হোটেলে পৌঁছার পর ভ্রমণ তফসিল থেকে ‘টাইম অ্যান্ড ওয়ার্ক’ উলট-পালট হয়ে যায়। মদিনা প্রবেশ করে বাস ডিপোতে পৌঁছার আগে প্রথম রিংরোডের বাঁক ঘুরার সময় মদিনা মনোয়ারার কয়েকটি মিনারসহ চির পরিচিত ঘনসবুজ গম্বুজটি কয়েক পলক চোখে পড়েছিল। মসজিদে নববীর মায়াবী গম্বুজের মায়ার জালে আগেই জড়িয়ে পড়েছিলাম। প্রতি বছর হজ্জের ভিডিও চিত্রসহ পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত সবুজ গম্বুজটি চোখে পড়ার মতো। কোনো কোনো মসজিদ মাদ্রাসার সামনেও টাইলসের বানানো সবুজ গম্বুজ বসিয়ে রাখা হয়। এত দেখার পরেও এ মসজিদ-এ-নববীর বিস্তারিত কিছু জানতাম না। বিস্তারিত জানতে পারি কোনো এক ঘটনাক্রমে। 

ঘটনা হলো, আমাদের গ্রামের গোটা বিশেক বাড়িসহ শত বর্ষের একটি পুরানো মসজিদ গত ২৮/৯/০৭ খ্রিস্টাব্দে মেঘনার ভাঙ্গনে নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। এ সংবাদ গত ৩০/৯/০৭ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রায় সকল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এরপর আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়। নতুন মসজিদের নামকরণ করা হয় ‘খাঁজা চিশতি (রা.) জামে মসজিদ’। নামকরণ তো হলো, এখন নতুন মসজিদের একটি গঠনতন্ত্র আবশ্যক। মুসলিম বিশ্বের বিশেষ কোনো মসজিদের আদর্শের অনুকরণে পরিচালিত হবে ‘খাঁজা চিশতি (রা.) জামে মসজিদ’ এই বিষয়ে সবাই একমত হয়। কা’বা মসজিদের পরেই মসজিদে নববীর স্থান। তাই সর্ব সম্মতিক্রমে মসজিদে নববীর আদর্শ ও গঠনতন্ত্র খুঁজতে শুরু করি। বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক অনেক প্রকাশনাসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অনেক অনুসন্ধানের পরেও নববী মসজিদের আদর্শ ও গঠনতন্ত্র সম্পর্কে গ্রন্থ পেতে ব্যর্থ হই। পরিশেষে ইন্টারনেট থেকে মসজিদে নববীর ইতিহাসসহ আদর্শ ও উদ্দেশ্য সংগ্রহ করে আমাদের খাঁজা চিশতি (রা.) জামে মসজিদের গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করি।

মসজিদ-এ-নববীর বিষয়ে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে মসজিদে নববীর আদর্শ-উদ্দেশ্যসহ বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রথমিক ধারণা পেয়ে যাই। বিশেষ করে গগন বিদারী মিনারাসহ বিশ্বের সর্বজন বিদিত ঘন সবুজ গম্বুজটি তখন থেকেই স্মৃতির ক্যামেরায় স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়ে যায়। এ কারণে চলন্ত বাস থেকে মসজিদে নববীকে এক পলক দেখা মাত্রই চিনে ফেলেছি। দেখা মাত্র পাশে বসা সালমাকে চিৎকার করে-
দেখো দেখো, আমরা মদিনা মুনাওয়ারায় নবী করীম (স.)-এর রওজা শরীফ মসজিদে নববীতে পৌঁছে গেছি।

গিন্নী চোখ কচলানো শেষ করতে না করতে মসজিদটি আবার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।

আমরা যে রাতে মদিনা প্রবেশ করি সে রাতে আর ঘুমাইনি। খাওয়া- দাওয়ার পর্ব শেষ করে ভোর পাঁচটায় নবী (স.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের জন্য মসজিদে নববী বরাবর পা বাড়াই। মসজিদে নববী জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সুন্নত। যখন মসজিদে পৌছে যাবে তখন রাসূল (স.) ও তাঁর দু’সঙ্গী আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর কবর জিয়ারত করে নেয়া উত্তম। এ সম্পর্কে রাসূল (রা.) বলেছেন-
‘তিনটি মসজিদ ছাড়া বরকতের আশায় অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে লম্বা সফর করা যাবে না। তিনটি মসজিদ হলো মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও বায়তুল মোকাদ্দাস’। (বুখারী ১১৮৯, মুসলিম ১৩৯৭)।
রাসূল (স.) আরো বলেন-
- ‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমায় জিয়ারত করলো সে যেন আমার জীবিত অবস্থায় আমাকে জিয়ারত করলো।’

হোটেল থেকে বের হয়ে পা বাড়ানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নববী মসজিদের সুউচ্চ মিনারসহ সবুজ গম্বুজ নজরে পড়ে। নজরে পড়ার সাথে সাথে-
‘আল্লাহর নামে এ শহরে প্রবেশ করছি। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত ভাল কাজ করা ও খারাপ কাজ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মঙ্গলের পথে পরিচালিত করো এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখো। তুমি আমাকে সে পথ দেখাও যে পথে তোমার অলি-আওলিয়া ও ইবাদতকারী বান্দাগণ সম্মানিত হয়েছেন। হে আল্লাহ, তুমি তোমার করুণা বর্ষণসহ আমাকে সৎ ও হালাল রিজিক দান করো। হে আল্লাহ! তুমি এ শহরে আমাকে শান্তি ও স্বস্তি দাও।’
মনে মনে পাঠ করতে করতে খোলা চত্বর পার হয়ে মসজিদে নববীর দরজায় পৌঁছে যাই। ডান পা বাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে করতে-
‘আল্লাহর নামে প্রবেশ করছি। অসংখ্য সালাম ও দরুদ আল্লাহর রাসূলের প্রতি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ, আমার অপরাধ মাফ করে আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।’
পাঠ করে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করি।

তারপর আমরা মসজিদে নববীতে ফজরের নামায আদায় করি। এখানেও নামায শেষে জানাজা নামায আদায় করা হয়। মক্কা ও মদিনার প্রধান দু’মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় শেষে প্রত্যেকবারই জানাজা নামায আদায় করা হয়। প্রথম দিকে এর কারণ জানতে না পেরে এর ব্যাখ্যা নানা দিকে প্রসারিত করতাম। পরে জানতে পেরেছি- উভয় মসজিদ এলাকায় মৃত ব্যক্তিদের জানাজা নামাযের জন্য মসজিদ প্রিমিজে রাখা হয়। উভয় এলাকায় কয়েক লক্ষ লোকের বাস। তাই কখনো কখনো লাশের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যায়। পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে কোনো ওয়াক্তে লাশ ছিল না এমন ঘটনা খুবই কম। নর-নারীর জন্য কোনো পৃথক জামায়েত করা হয় না। লাশ মসজিদের নির্ধারিত স্থানে রাখার পর সবার জন্য একত্রে কমন জানাজা নামায আদায় করা হয়ে থাকে।

ফজরের নামায আদায় শেষ করে নবী করীম (স.)সহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) সমাধি জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সামনের দিকে এগুতে থাকি। তার আগে মহিলাদের জন্য সমাধি জিয়ারতের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বাইরে রেখে বাইরের চত্বর দিয়ে হেঁটে সবুজ গম্বুজ ও জান্নাতুল বাকী বরাবর আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে বলে দিই। নবী করীম (স.)-এর সমাধির কাছে ভীষণ ভীড়। প্রচÐ চাপের মধ্যে বাম দিকে মাজার রেখে পা টিপেটিপে মাজারের কাছে পৌঁছে সালামসহ-
- ‘হে আল্লাহর রাসূল (স.), আপনার ওপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।’
এ ভাবে সালাম প্রদান করার পর-
‘হে আল্লাহর নবী, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে সৃষ্ট জগতের উত্তম সৃষ্টি, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে নবীকুলের সর্দার, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানোসহ আমানত আদায় করে দিয়েছেন, উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন। হে মুমিনগণ, তোমরা নবী (স.)-এর প্রতি অনুগ্রহ প্রার্থনা করো এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।

নবী করীম (স.)-এর গুণকীর্তন বর্ণনা করতে করতে একই পাশে বিদ্যমান হযরত আবু বকর (রা.)-এর মাজার বরাবর পৌঁছে-
‘হে আল্লাহর রাসূলের প্রিয় খলিফা! তাঁর গুহাসঙ্গী, সফরসমূহের সহযাত্রী ও গোপনীয় বিষয়সমূহের বিশ্বস্ত রক্ষক আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আপনার ওপর দরুদ ও শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আপনার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হন এবং আপনাকে সন্তুষ্ট করুন। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উম্মতের পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।’
ঠিক পাশেই হযরত উমর (রা.)-এর মাজার বরাবর পৌঁছে-
‘যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা দ্বীন ইসলামের সম্মান বর্ধিত করেছেন- হে মুমিনগণের নেতা উমর ফারুক, আপনার প্রতি রইলো আমার অসংখ্য সালাম। আপনি জীবিত ও মৃত সকল মুসলমানের স্বীকৃত নেতা। আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রতি রাজি হোন। মুহাম্মদ (স.)-এর উম্মতের পক্ষ থেকে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
পরে ফেরেশতাগণের উদ্দেশ্যে এই মর্মে সালাম নিবেদন করি-
-‘হে ফেরেশতাগণের সর্দার জিবরাইল, মীকাইল, ইসরাফিল, আজরাইল- সহ আসমান জমিনে অবস্থানকারী আল্লাহর অপরাপর ফেরেশতাগণ আপনাদের সবাইকে সালাম। আপনাদের প্রত্যেকের ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।
পরিশেষে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে এই মর্মে প্রার্থনা করি-
‘হে আল্লাহ, হে বিশ্বের প্রতিপালক, অসহায় মানবের আশ্রয় দাতা, বিপন্ন মানুষের ত্রাণকর্তা, সর্বপোরি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তুমি আমার জিয়ারত কবুল করো। এ বিষয়ে কোনো দোষ-ত্রæটি হয়ে থাকলে তা ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাকে সৎ কাজ করার তওফিক প্রদান করো এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখো। হে বিশ্বের প্রতিপালক! তুমি আমাকে পবিত্র মক্কায় উপস্থিত হয়ে হজ্জব্রত পালনসহ পবিত্র মদিনায় এসে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীগণের মাজার জিয়ারত করার মতা প্রদান করায় তোমার ওপর হাজারবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এবং তোমার আনুগত্য স্বীকার করছি।’

জিয়ারতের সময় মাজারে হাত দিয়ে স্পর্শ করা, চুমো খাওয়া, রাসূল (স.)-এর কাছে চাহিদা পূরণ, বিপদাপদ দূরীকরণ ও অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ মর্মে দোয়া বা প্রার্থনা করা অবৈধ বলে জানিয়ে দেয়া হয়।

মাজার জিয়ারত শেষ করে আমাদের মহিলাদের সাথে নিয়ে জান্নাতুল বাকীর দিকে পা বাড়াই।

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক