দর্পচূর্ণ
(ওমরাহ ও যিয়ারত উপলক্ষে ১৪ সেপ্টম্বর থেকে ২০০৯ থেকে ২৫ সেপ্টম্বর ২০০৯ তারিখ পর্যন্ত সউদী আরব ছিলাম। প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছিল ‘আমার দেখা আরব’ হজত্রীদের জন্য সহায়ক হবে: লেখক))
(প্রথম পর্ব: জেদ্দা থেকে মক্কা)
দেশ ভ্রমণ অফিস থেকে বলে দেয়া হয়েছিল সামসুল হক নামে একজন ভদ্রলোক বিমান বন্দর থেকে আপনাদের নিয়ে যাবে।
এ কথা শোনার পর, আমরা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম-
-বুঝতে পারলাম, সামসুল হক নামের এক ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে যাবে, কিš‘ আমরা ভদ্রলোককে চিনবো কি করে? কিংবা ভদ্রলোকই আমাদের চিনবেন কি করে?
-সামসুল হকের মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিয়েছি।
- মোবাইল করবো কিভাবে? আমাদের বাংলাদেশী মোবাইল জেদ্দায় কাজ করবে না তখন উপায় কি হবে?
- গাইডের বুকে ‘দেশ ভ্রমণ' নামের বোর্ড ঝুলানো থাকবে।
আমরা গাইডের বুকের কাছে পৌঁছতে পারলে তো বুকে ঝুলানো বোর্ড দেখতে পাবো।
আরে এতোকিছু ভাবছেন কেন? হাজার হাজার নিরক্ষর লোক পার পেয়ে যায়- আর আপনারা পার পেতে পারবেন না, এটা কি হয়!
যেহেতু দাম্মাম বিমান বন্দরে যাবতীয় শুদ্ধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষ করে পাসপোর্ট ভিসা রেখে দিয়ে ফেরত দিয়েছে একটি স্লিপ সেহেতু স্লিপ হাতে জেদ্দায় অবতরণ করে বিনা পরীক্ষায় বহির্গমন পথে বের হয়ে লাগেজবাহী চলন্ত বেল্টের কাছে চলে আসি। লাগেজের জন্য বেল্টে অপেক্ষা করার সময়ে জনৈক লোক মোবাইলের সীম নিয়ে আসে। সীমের গুণাগুণ বর্ণনা করে জানায়-
- সীমের দাম মাত্র সত্তুর রিয়েল। সত্তুর রিয়েল দিয়ে কিনলে সত্তুর রিয়েলেরই কথা বলা যাবে।
- ছবিসহ নাম পরিচয় নিবন্ধন করণ ছাড়া সীম কিনবো কিভাবে? আর আপনি বিক্রিইবা করবেন কিভাবে?
- এসব কিছুই দরকার পড়বে না। সত্তুর টাকা এক হাতে দিবেন, আরেক হাতে সেটের ভেতর সীম লোড করে দিব। সাথে সাথে কথা বলে সত্যতা পরীক্ষা করা যাবে।
- কি জানি ভাই, নাম রেজিস্ট্রেশন ছাড়া সীম কিনে আবার কোন টীমের পাল্লায় পড়ি তা আল্লাহ বলতে পারবে।
এর মধ্যে হামিদ ভাই সীম কিনতে সম্মত হয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল সেট বের করে দিয়েছে। লোকটির হাতে দিতেই লোকটি পনের সেকেন্ডের মধ্যে সীম লোড করে প্রার্থীত নাম্বারে কল দেয়ার জন্য হামিদ ভাইয়ের হাতে দেয়। হামিদ ভাই প্রার্থীত নাম্বারে টিপাটিপি করে ডেলিভারি বাটনে টিপে কানের কাছে নিয়ে।
- সামসু ভাই, আপনি কোথায়?
আমি আপনাদের সামনেই আছি।
বলতে বলতে এরাবিয়ান জুব্বা পরিহিত মধ্য বয়সি এক ভদ্রলোক একেবারে আমাদের সামনে এসে হাজির। চিনতে আর বাকি থাকে না যে, কানে মোবাইল ধরে রাখা বেঁটে-খাটো ও কাঁচা-পাকা শ্মশ্রুমন্ডিত ভদ্রলোকই মি. সামসুল হক। তা দেখে আমি হামিদ ভাইকে লক্ষ্য করে-
দেখলেন তো এরাবিয়ান মোবাইলের কি ক্ষমতা, সাপের কড়ি চালান করার মতো- কল করার সাথে সাথে শুধু প্রার্থীত লোকের কণ্ঠটাই নিয়ে আনে নি- প্রার্থীত লোকটিকে স্বয়ং সামনে এনে হাজির করে দিয়েছে। এমন শক্তিশালী সীম না কিনলে কি চলে!
সামসু ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের পর্বটা এভাবেই শুরু হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, প্রথম দর্শনে লোকটিকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। নানা কারণে এক ধরনের লোকের প্রতি আমার সন্দেহের তীর তাক্ করাই থাকে। দু'চার দিনের মধ্যেই সামসু ভাইয়ের প্রতি সন্দেহের তীর ভোতা হয়ে করুণার তীর শানিত হতে থাকে। জেদ্দা বিমান বন্দরে নানা প্রকারের ঝুট ঝামেলা হতে শুরু করে।
পাসপোর্ট গ্রহণ করার সময় জনৈক সুদর্শন যুবক আমাদের হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে যায়। আমরা বন্দরের বাইরে আসার পরেও পাসপোর্ট ফেরত পাইনি। বিনা প্রমাণে যে যুবক আমাদের হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে যায় সে যুবককে কোনো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি মনে হলো না। যে অবস্থায় পাসপোর্ট নিয়েছিল সে অবস্থায়য় পাসপোর্ট না দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। পাসপোর্ট হাতছাড়া হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ বিষয়টা ভেবে নিজেদের বোকা বোকা ঠেকছিল।
সামসু ভাইকে পাওয়ার পর পাসপোর্ট হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি তাকে অবগত করলে তিনি বিষয়টি তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। গেটের বাইরে তিন দিক খোলা ছোট একটি বসার ঘর। এসি বিহীন বসার ঘরে বসতেই উষ্ণ হাওয়া গায়ে লাগতে শুরু করে। মিনিট পাঁচেক পরেই এরাবিয়ান যুবক আসে। তার হাতে শক্ত করে ধরা আমাদের চারটি পাসপোর্ট। যুবকটি পাসপোর্ট জিম্মি হিসেবে আটকিয়ে কি সব বিষয়াষয় নিয়ে সামসু ভাইয়ের সাথে তর্ক-বিতর্ক শুরু করছে।
তর্ক-বিতর্কের ধরন শুনে মনে হলো যুবকটি সরকারি কোন লোক নন। তার পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখার নমুনা দেখে মনে হলো লোকটি সরকারের লোক না হলেও সব সরকারের বাবা। পুলিশের নাকের ডগায় পাসপোর্ট নেয়ার সময় পুলিশ টু শব্দটিও করেনি।
জেদ্দা বিমান বন্দরের ঝুট- ঝামেলা দেখে বাংলাদেশের মাস্তানদের কথা মনে পড়লো। বাংলাদেশের মাস্তানদের মধ্যেও অনেক সুদর্শন যুবক রয়েছে। ইন্ডিয়ান সিরিয়ালে সুদর্শন যুবকদেরকে ভাড়াটিয়া খুনী ও মাস্তান চরিত্রে দেখানো হয়। সুদর্শন যুবকদের কারো কারো চেহারা কাটা-কুটি করে বীভৎস করা হয়। এখানেও দেখলাম সুদর্শন নায়ক নায়ক চেহারার একজনের হাতের মুঠোয় যেন পুরো বিমান বন্দরটা আটকে রেখেছে। জেদ্দা বিমান বন্দরের ঝুট-ঝামেলা দেখে আমাদের জিয়া (বর্তমানে শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরকে গঙ্গায় ধোয়া পুতঃপবিত্র সতী-সাবিত্রীর মতো মনে হলো।
সামসু ভাই আমার আপাদমস্তক অবলোকন করে-
- আপনার চেহারার এ অবস্থা কেনো?
পাক্কা সাত ঘণ্টা জার্নি ও তিন ঘণ্টা শুদ্ধতা যাচাইয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে বন্দর থেকে বের হওয়ার পর যেটা দেখতে পা”েছন সেটাই আমার আসল চেহারা!
- আরে আপনার চেহারা সুন্দর অসুন্দর নিয়ে কথা হচ্ছে না- কথা হচ্ছে, আপনি একজন পর্যটক না একজন হবু হাজী?
- আমি একজন হবু হাজী।
আপনার লেবাস দেখে তো তা মনে হয় না।
- ইহরাম বাঁধিনি বলে এ কথা বলছেন। হোটেলে পৌঁছে ইহরাম বেঁধে নেবো। তার কারণ, এতো বড় জার্নির ধকল সামাল দিতে গিয়ে ইহরামের মান-ইজ্জত ঠিক রাখা যাবে না বলে ইহরাম বাঁধা হয় নি।
আপনার হোটেল মীকাতের ভিতরে। ইহরাম বাঁধতে হবে মীকাতের বাইর থেকে। তাই হোটেলে প্রবেশ করে ইহরাম বাঁধলে হজ্জ শুদ্ধ হবে না।
- (আতঙ্কিত হয়ে) তা হলে উপায়?
উপায় নিশ্চয়ই আছে। হয় আপনাকে এখান থেকেই ইহরাম বাঁধতে হবে নয়তো মীকাত এরিয়া থেকে বের হয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে। দ্বিতীয়টা করতে হলে আপনার পক্ষে আজ আর হজ্জব্রত (ওমরাহ) পালন করা সম্ভব নয়।
মীকাত এলাকা আবার কোনটা?
প্রাচীন কাল থেকে হারাম এলাকার একটা নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে। ঐ নির্দিষ্ট সীমানাকে মীকাত এরিয়া বলা হয়।
আমরা কি এখন মীকাতের বাইরে?
- জ্বী! আমরা এখন মীকাতের বাইরে।
-কোন খান থেকে মীকাতের সীমানা শুরু হয়?
- মদিনাবাসীর জন্য 'যুলহুলাইফা', শামবাসীর জন্য 'জুফ্ফাহ' (বর্তমান রাগেব), নাজদবাসীর জন্য 'কারণে মানাযেল' (বর্তমান সায়েল), ইয়ামানবাসীর জন্য 'ইয়ালাম লাম' এবং ইরাকবাসীর জন্য ‘যাত ইরক'।
- এর মধ্যে আমরা বঙ্গবাসীরা পড়েছি কোন সীমানায়?
Ñ ইয়ালাম লাম। ইয়ালাম লামকে সা’দিয়াহও বলে কেউ কেউ। জেদ্দা বিমান বন্দর ইয়ালাম লাম পাহাড়ের বাইরে তাই জেদ্দা বিমান বন্দর এলাকা থেকেও ইহরাম বাঁধা চলবে। তা না হলে আপনাকে আবার বিবি আয়শা (রা.) মসজিদে গিয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে।
- আয়শা (রা.) মসজিদে কেন?
কারণ, আমরা যে হোটেলে উঠবো সে হোটেল থেকে আয়শা (রা.) মসজিদই মীকাতের বাইরে নিকটবর্তী ও সুবিধাজনক স্থান।
ইহরাম না বাঁধলে আজ ওমরাহ করা চলবে না। এ কথা শোনার পর আর বিতর্ক না করে ইহরামের পরি”ছদ বের করতে শুরু করি। যে ওয়েটিং রুমে বসা ছিলাম সে ওয়েটিং রুমের পেছনের অন্ধকারে গিয়ে মেয়েলী ধাঁচের সেলাই বিহীন সাদা কাপড় পরিধান করতে শুরু করি। একে তো স্থুলকায় পেট তার উপর এ রকম পরিচ্ছদ পরিধানে অনভ্যাসের কারণে কোমরে বাধাঁ কাপড় বারবার খসে পড়ছিল। গিন্নীদের কোমর থেকে যে কাপড় জীবনেও খসে পড়ে না সে কাপড় বারবার আমার কোমর থেকে খসে পড়ছে কেন? বিব্রতকর অবস্থায়য় গিন্নীকে ডাকাডাকি শুরু করি। গিন্নী এসে স্বভাবসুলভ মেজাজ প্রদর্শন করে আমার কোমরের সাথে কাপড়টা শক্ত করে গীট লাগিয়ে দেয়ার পর খসে পড়া বন্ধ হয়।
এ পোশাকে চড়ার পর হাইওয়ের ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে সা সা করে চললো আমাদের ক্যাব। জেদ্দা থেকে মক্কার দূরত্ব কম-বেশি ৭৮ কিলোমিটার। লোহিত সাগরের উপকূল ধরে শহর এলাকা। উপকূল এলাকার আয়তন উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি কমবেশি ১০০ কিলোমিটার ও প্রস্থে কম-বেশি ১০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকাই বাণিজ্যিক ও শহর এলাকা। জেদ্দা থেকে একটি এক্সপ্রেসওয়ে ও একটি ডিভাইডেড হাইওয়ে মক্কা চলে গেছে। এ ছাড়া অসংখ্য আনডিভাইডেড হাইওয়ে জেদ্দার বাণিজ্যিক এলাকা জালের মতো বিস্ত ার করে রয়েছে। আরবের প্রধান নগর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও বুরায়দায় যে পরিমাণ হাইওয়ে রয়েছে সারা দেশেও সে পরিমাণ হাইওয়ে নেই। এক্সপ্রেসওয়েটি ডিভাইডেড হাইওয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে আনুমানিক ত্রিশ কিলোমিটার পাশাপাশি চলার পর ডিভাইডেড রোডটি উত্তর দিকে এবং এক্সপ্রেসওয়েটি সামান্য দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে পুনরায় মক্কার দিকে চলে গেছে। ক্যাব ছাড়ার মিনিট চল্লিশেক পর ড্রাইভার সামনে ইশারা করে জানায়-
- এখান থেকে হারাম এলাকা শুরু। মানে আমাদের সামনেই ইয়ালাম লাম পাহাড়।
সামনে তাকিয়ে আরবিতে লেখা একটি সাইনবোর্ডসহ পাহাড়ের মতো কিছু একটা দেখলাম কিনা ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। তবে অতিরিক্ত আলোক সজ্জার ভেতর ইংরেজি ও আরবিতে কয়েক স্থানে স্বাগতম জাতীয় কিছু লেখা রয়েছে দেখতে পেলাম। আমাদের বাম দিকে কিছু দূরে আরো একটি রাস্তা দেখতে পাই। জানতে পারি- বাম দিকের রাস্তার নাম পুরানো মক্কা-জেদ্দা রোড।
এক সময় জেদ্দা থেকে পুরাতন মক্কা-জেদ্দা রোড দিয়েই হারাম এলাকায় প্রবেশ করতে হতো। পরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে কোনো এক বাদশাহের নামে নামকরণ করা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা রিংরোড ক্রস করে একটা ট্যানেলে প্রবেশ করি। ট্যানেল থেকে বের হতেই তীব্র আলোর ঝলকানিতে বামদিকে কা'বা মসজিদের সুউ”চ আলোকিত মিনারসহ কা'বা মসজিদ চোখে পড়ে। সামনে এবং ডান দিকে তাকিয়ে দেখি ইহরাম বাঁধা হাজার হাজার লোক কা'বা মসজিদ বরাবর আসা যাওয়া করছে। তা দেখে ড্রাইভারের কাছে-
কিরে ভাই, এখন তো কোনো নামাযের সময় নয়। তবে এতো মানুষ মসজিদ পানে যাচ্ছে কেন?
নামাযের সময় নয় বলেই এতো মানুষ। নামাযের সময় মানুষে মানুষে এই রোড ব্লক থাকে। গাড়ি চালানো দূরের কথা- রাস্তায় তিল ধরার ঠাঁইও থাকে না।
বলেই রাস্তার ডান পাশে একটা বারবার শপের (সেলুন) সামনে আমাদের নামিয়ে দেয়।
গাজা এলাকায় ‘দ্বার আবু তুর্কী' নামক হোটেলে প্রবেশ করে শাওয়ারের গরম পানি দ্বারা ওজু-গোসল সেরে ফ্রেশ হই। পুনঃ শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতঃ একই পরি”ছদে মাথা ঢেকে দু'রাকাত ইহরামের নামায আদায় করি। নামায আদায় শেষে-
‘হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর নিয়ত করছি, তুমি আমার জন্য ওমরাহ সহজ করে দাও এবং ওমরাহ কবুল করে নাও।'
মর্মে প্রার্থনা করি। প্রার্থনা শেষ করে কাপড়ের আচ্ছাদন থেকে ডান হাত খোলা রেখে কা'বার উদ্দেশ্যে ডান পা বাড়িয়ে কা'বার মাঠে প্রবেশ করি। রাত অনুমান দুই ঘটিকার দিকে কা'বার গোলচত্বরের লোকদের সাথে সুপরিচিত আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক (তালবিয়া) পাঠসহ তওয়াফ করতে শুরু করি।
“লাব্বায়কা আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক, লাব্বায়কা লা শারীকা লাকা লাব্বায়ক; ইন্নাল হামদা ওয়ানিয়ামাতা লাকা ওয়াল মুল্ক। লা শারীকা লাক্।' (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির; নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামত এবং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মা- তোমারই। তোমার কোনো শরীক নেই)।
হজ্জ উপলক্ষে বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘হজ্জ : উমরাহ : যিয়ারত' গ্রšে’র বর্ণনানুসারে 'আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক' দোয়া ছাড়া বাংলায় অনূদিত বিশেষ বিশেষ কয়েকটি দোয়ার সারমর্ম ব্যবহার করেছি। কা'বা ঘরের বিভিন্ন অংশের পরিচয়সহ দোয়াসমূহের বাংলা অর্থ ও সারমর্ম নি¤œরূপ:-
১. ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া : আল্লাহর নাম করে ও তাঁর ওপর নির্ভর করে বের হ”িছ। তাঁর সাহায্য ছাড়া কোনো সৎ কাজই সমাধা হয় না এবং অসৎ কাজ থেকেও বেঁচে থাকা যায় না।
২. যানবাহনে আরোহণকালে: আল্লাহ মহান (৩বার)। পবিত্র সত্তা আল্লাহ, যিনি আমাদের জন্য যানবাহন বশীভূত করে দিয়েছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া যানবাহন বশীভূত করার সাধ্য আমাদের ছিল না। আমরা সকলেই তাঁর পানে ফিরে যাবো। হে আল্লাহ, এ সফরে তুমি আমাদের সাথী এবং বাড়িতেও তুমি আমাদের পরিবার পরিজন ও ধন-সম্পদের হেফাযতকারী। হে আল্লাহ এ সফরে তুমি আমাকে নেকী, তাক্ওয়া ও তোমার পছন্দ মতো আমল করার তওফীক দিও। হে আল্লাহ, এই সফরের দূরত্বকে কমিয়ে, কষ্টকে লাঘব করে, জান-মালের হেফাযতসহ সকল প্রকারের নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। আমাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ও নবী করিম (স.)-এর সমাধি যিয়ারতের তওফিক দিও। আমিন।
৩. জেদ্দা বন্দর নজরে পড়ার সাথে সাথে : হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট এই শহর ও এর অভ্যন্তর, সবকিছুর মঙ্গল কামনাসহ সকল অকল্যাণ থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
৪. জেদ্দায় অবতরণের সময় : হে আল্লাহ, যেখানে যাওয়া ও বের হয়ে আসা শুভ আমাকে সেখানে নিয়ে যাও এবং বের করে আন। তুমি আমাকে সাহায্য করো ও শক্তি দাও।
৫. হারাম শরীফে প্রবেশ কালে : হে আল্লাহ, ইহা তোমার সুরক্ষিত ও পবিত্র স্থানন। এখানে প্রবেশকারী সবাই নিরাপত্তা পায়। সুতরাং তুমি আমার রক্ত, মাংস, অস্থি ও চর্মকে দোজখের আগুনের জন্য হারাম করে দাও।
৬. কা'বা শরীফ দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র : আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির। তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমার, আর সকল সাম্রাজ্যও তোমারইÑ কোনো শরীক নেই তোমার। {অতি পরিচিত (লাব্বায়কা) তাবালিয়া পাঠ করতে হয়}।
৭. কা'বা এলাকায় প্রবেশের সময় : বিতাড়িত শয়তানের কবল থেকে মহা শক্তিবান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মহান আল্লাহর নামে প্রবেশ করছি। আল্লাহর রাসূলের প্রতি অজস্র ধারায় রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ, আমার সমস্ত পাপ মাফ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি শান্তিময়। তুমি আমার জন্য শান্তি ও রহমতের দরজা খুলে দাও। হে আমাদের প্রভু, তুমি আমাদেরকে শান্তিময় জীবন দান কর। তোমার শান্তির গৃহে আমাদের প্রবেশাধিকার দাও। হে আমাদের রব, তুমি বরকতময় এবং মহান। তুমি মহীয়ান ও গরীয়ান।
৮. তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদের নিকটে পৌঁছে : আল্লাহ ছাড়া অপর কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর ওয়াদা সত্য। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। তিনি একাই কাফির গোত্রকে পর্যুদস্ত করেছেন। আল্লাহই একমাত্র মাবুদ। তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজ্য ও সমস্ত প্রশংসার স্বত্বাধিকারী একমাত্র আল্লাহ। তিনি সর্বশক্তিমান।
৯. তাওয়াফের প্রথম দোয়া : আল্লাহর নামে শুরু করছি এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অজস্র ধারায় আল্লাহ তায়ালার রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলে করিম (স.) ও তার আওলাদের প্রতি।
১০. তাওয়াফের সময় ঘড়ির কাঁটার উল্টা নিয়মে চলতে চলতে : আল্লাহ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। মহামহিম আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া ভাল কাজ করারও কোনো ক্ষমতা নেই এবং মন্দ থেকে বেঁচে থাকারও কোনো উপায় নেই। অবারিত শান্তি ও দয়ার ধারা প্রবাহিত হোক আল্লাহর প্রিয় রাসূল (স.) এর প্রতি এবং তাঁর আওলাদের প্রতি। হে আল্লাহ, আমি তোমাকেই মাবুদ স্বীকার করছি, তোমাকেই সত্য জেনেছি, তোমার কিতাবকে সত্য বলে স্বীকার করছি, তোমার নবী ও প্রিয় হাবীব আমাদের নেতা হযরত মুহাম্মদ (স.) এর তাবেদারী করে তোমার নিকট দেওয়া ওয়াদা পালন করেছি। হে আল্লাহ, তোমার ক্ষমার দরজা আমার জন্য সর্বদা খোলা রেখ, দুনিয়া ও আখেরাতে আমাকে মঙ্গল দান কর। বেহেস্ত দান করে আমাকে সাফল্য প্রদান কর এবং জান্নাতের আগুন হতে আমাকে রক্ষা করো।
১১. রুকুনে ইয়ামানীকে (সম্ভব হলে) স্পর্শ করে : হে আমাদের প্রতিপালক, দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মঙ্গল প্রদান করো, পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচাও এবং পুণ্যবানের সঙ্গী করে বেহেস্তে প্রবেশ করাও - হে মহা পরাক্রমশালী, হে ক্ষমাশীল ও হে বিশ্বপালক।
১২. এক পাক শেষে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে হাত উচিয়ে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।
১৩. দ্বিতীয় তওয়াফ শুরু করতে : হে আল্লাহ, এই ঘর তোমার, এ হারাম তোমার, এ নিরাপত্তা তোমারই নিরাপত্তা, এখানকার বাসিন্দাগণ তোমারই বান্দা। আমিও তোমারই বান্দা এবং তোমার বান্দার সন্তান। দোজখের আগুন থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। তুমি আমাদের গোশ্ত ও চর্মকে দোজখের আগুনের জন্য হারাম করে দাও। হে আল্লাহ, ঈমানকে আমাদের নিকট প্রিয়তর করে দাও এবং আমাদের অন্তরকে আকর্ষণীয় করে তোল। কুফরী, অবাধ্যতা ও অপরাধ প্রবণতার প্রতি আমাদের অন্তরসমূহে ঘৃণার সঞ্চার করো এবং আমাদেরকে সত্য পথের পথিক বানাও। হে আল্লাহ, যেদিন তুমি তোমার বান্দাগণকে বিচারের জন্য সমবেত করবে, সেদিনের শাস্তি থেকে আমাকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, আমাকে বিনা বিচারে বেহেশ্ত নসীব করো।
১৪. রুকুনে ইয়ামানীকে(সম্ভব হলে) স্পর্শ করে : হে আমাদের প্রতিপালক, দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মঙ্গল দান করো, পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচাও এবং পুণ্যবানগণের সঙ্গী করে বেহেশতে প্রবেশ করাও- হে মহাপরাক্রমশালী, হে ক্ষমাশীল, হে বিশ্বপালক।
১৫. পাক শেষে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে হাত উচিয়ে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।
১৬. তৃতীয় তওয়াফ শুরু করতে : হে আল্লাহ, এই ঘর তোমার, এ হারাম তোমার, এ নিরাপত্তা তোমারই নিরাপত্তা, এখানকার বাসিন্দাগণ তোমারই বান্দা। আমিও তোমারই বান্দা এবং তোমার বান্দার সন্তান। দোজখের আগুন থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। তুমি আমাদের গোশ্ত ও চর্মকে দোজখের আগুনের জন্য হারাম করে দাও। হে আল্লাহ, ঈমানকে আমাদের নিকট প্রিয়তর করে দাও এবং আমাদের অন্তরসমূহকে আকর্ষণীয় করে তোল। কুফরী, অবাধ্যতা ও অপরাধ প্রবণতার প্রতি আমাদের অন্তরসমূহে ঘৃণার সঞ্চার করো এবং আমাদেরকে সত্য পথের পথিক বানাও। হে আল্লাহ, যেদিন তুমি তোমার বান্দাগণকে বিচারের জন্য সমবেত করবে, সেদিনের শাস্তি থেকে আমাকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, আমাকে বিনা বিচারে বেহেশত নসীব করো।
পাক শেষে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে হাত উচিয়ে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।
১৭. রুকুনে ইয়ামানীকে (সম্ভব হলে) স্পর্শ করে : হে আমাদের প্রতিপালক, দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মঙ্গল দান করো, পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচাও এবং পুণ্যবানগণের সঙ্গী করে বেহেশতে প্রবেশ করাও- হে মহাপরাক্রমশালী, হে ক্ষমাশীল, হে বিশ্বপালক। (চলবে)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
[email protected]
আরও পড়ুন: মালয় থেকে মালয়েশিয়া