Advertisement

আসমা সরকার


প্রকাশিত: ০০:১৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

আপডেট: ০০:৪২, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

আকাশের চোখ

আকাশের চোখ
ছবি: সবার দেশ

(২য় পর্ব)

পার্টি থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো। বৃষ্টি কাপড় বদলে নিতে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলে আকাশ বসার রুমেই সোফায় আধশোয়া হয়ে মোবাইলে আজকের তোলা ছবিগুলো দেখছে।বৃষ্টি ইচ্ছে করেই অনেকক্ষণ সময় ধরে দরজা বন্ধ রাখলো।

অন্যসময় হলে আকাশ চেচামেচি শুরু করে দিতো,দরজা খোলার তাড়া দিতো। আজ কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি বুঝতে পারছে সবই,কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। কি বলবে? কাকে বলবে? কার সম্পর্কে বলবে? নিজের চিন্তাভাবনাকেই বা এতো নগন্যভাবে প্রকাশ করবেইবা কি করে? দরজা খুলে দেখে আকাশ জুতাটা শুধু খুলে মোজা পায়েই কাত হয়ে মোবাইল দেখছে। বৃষ্টি তাড়া দিলো,,,
এই জলদি কাপড় পালটে ফ্রেশ হও।খুব ক্লান্ত লাগছে,শুয়ে পড়বো।
আধশোয়া হয়েই আকাশ বললো, 
তুমি শুয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।
মৃদু আপত্তি করলো বৃষ্টি, 
আরে ধুর, আমি শোয়ার পর তুমি লাইট জ্বালবে, শব্দ করবে আমি কি ঘুমাতে পারবো নাকি?
আকাশ রসিকতার সুরে বললো, 
বাব্বাহ, মনে হচ্ছে সকালে অফিস আদালত আছে! ঘুমের ডিস্টার্ব হলে কাজের ডিস্টার্ব হবে! হাহ,, 

একটু হোঁচট খেলো বৃষ্টি। চোয়াল শক্ত করে বললো,
অফিস আদালত না থাকলে কি ভালো ঘুমের প্রয়োজন নেই? নাকি যারা অফিসে যায়না তারা মানুষ না?তারা কি সারাদিন বাড়িতে গা এলিয়ে বসে থাকে?
তাও আবার তোমার মতো কিপ্টার সংসারে?

আকাশ সোজা হয়ে বসলো। মোজা খুলতে খুলতে বললো, তা কিপটার সংসারের হাল ধরলেইত পারো।
কোনো স্মার্ট মেয়েরা ঘরে বসে থাকেনা। স্বামীর ঘাড়ে বসে খায়না। তোমার বান্ধবীকে আজ দেখেছো? এতো বড় একটা আয়োজন নিজের টাকায় করেছে। সমস্ত কিছু কি চমৎকারভাবে টেককেয়ার করলো! আবার সেই রকম স্মার্ট ও। বিশ্বাসই হয়না ও তোমার বান্ধবী।
বলেই বেডরুমের দিকে হনহন করে চেলে গেলো আকাশ।

বৃষ্টি শোয়ার আয়োজন করে এসেছিলো, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বসেই কাটিয়ে দিবে এই বসার রুমেই।
কি বলতে এসে কি শুনতে হলো! নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে না পারলেও আকাশ কি অবলিলায় তার ভাবনার কথা ব্যক্ত করে গেলো? অথচ বৃষ্টি কিছুই বলতে পারলোনা। ধপ করে বসে পরলো। সেজন্যই কি বলে?
মেয়েদের বুক ফাঁটে ত মুখ ফোটেনা!

বৃষ্টি মনে মনে কয়দিন ধরেই ভাবছিলো, চাকরি বাকরি কিছু একটা করবে। সে ত আর অশিক্ষিত নয়!কিন্তু লেখাপড়া শেষ হতে না হতেই বাবা মা বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। ভালো ছেলে হাতছাড়া হলে শনির দশা লাগে। আরও দুটো ভাইবোন আছে। ছোট বোনটারও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। তাই বৃষ্টি আর আপত্তি করেনি। কেমন করে তিনটা বছর কেটে গেলো। মাঝখানে বাবার মৃত্যু,আর নিজেরও সন্তান নষ্ট হওয়ার মতো বিপদ তাকে আরও যেনো অবশ করে ফেলেছিলো। নিজের যন্ত্রণা আকাশের উদাসীনতায় একবার বাঁচতে গিয়ে দশবার মরে। তাই মানসিক শক্তিও যেনো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো। সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ধরে রাখতে পারেনি বলে স্বামী আর স্বামীর বাড়ির মানুষের নানারকম কথা শুনতে শুনতে যদি অতিষ্ঠ হয়ে আকাশের কাছে সামান্য অভিযোগ করেছে, উল্টো বৃষ্টিকেই আকাশ অভিযুক্ত করেছে। 

বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে স্বামীই হচ্ছে মেয়েদের একমাত্র অবলম্বন। অথচ আকাশ কখনোই বৃষ্টির পাশে থাকেনি, কোনো সমস্যাতেই না। বৃষ্টি একাই সয়েছে, একাই বয়েছে সংসারের অযাচিত অনেক যন্ত্রণা। মা ভাইবোন কাউকেই কিছু বুঝতে দেয়নি।

আজ মেঘলার পার্টিতে যাওয়া থেকে শুরু করে ফেরার সময়টুকু বৃষ্টিকে তিনবছরের কষ্টগুলো একসাথে যেনো ফিরিয়ে দিল। ভালোই হলো। আকাশের ভেতরের কথাগুলো বের হয়ে এলো।।
বৃষ্টি সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। বেডরুমে গিয়ে দেখে বাতি নিভিয়ে আকাশ শুয়ে পড়েছে। বৃষ্টি ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখলো। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলো। এতোক্ষণ ঘুমের যে আবেশ ছিলো তার লেশমাত্রও এখন নাই। আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে
সিদ্ধান্ত নিলো, আগামীকালই বৃষ্টি মায়ের বাসায় গিয়ে সব সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে চাকরির সন্ধানে ছুটবে।
 
স্মার্ট হতে হবে তাকে। আকাশের মতো পুরুষেরা বউ নয়, পার্টনার পছন্দ করে। ওরা সৌন্দর্য বুঝেনা, মেকি আবরণ আর ববকাট চুলের রমণীর মাঝে স্মার্টনেস খোঁজে। বৃষ্টি অতোটা না পারলেও, সমাজের এক কোণে নিজেকে বেশ দাঁড় করাতে পারবে বলেই তার বিশ্বাস। কারণ, স্কুলের লাস্ট বেঞ্চের মেঘলা যদি হাই ক্লাসের চলাফেরা করতে পারে, তবে ফার্স্ট বেঞ্চের তুখোর ছাত্রী মেঘলা কেনো আকাশের মতো ব্যক্তিত্বহীন পুরুষের অবজ্ঞা অবহেলায় নিঃশেষ হবে?
বৃষ্টি আর শুধু ঝরবেনা, মেঘের পাহাড়কেও অতিক্রম করবে নিজস্ব মহিমায়।

(চলবে,,,,)

লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক

আরও পড়ুন: জীবন এমনও হয়?