Advertisement

হাসান জাকির


প্রকাশিত: ০০:১৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

আপডেট: ০০:৫৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

নেয়ামতের আমানত 

নেয়ামতের আমানত 
ছবি: সবার দেশ

নেয়ামত গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে গাছের গুঁড়িতে কুড়ালের কোপ দিলো। 
‘হেই-ও!’ 
এক কোপে গুঁড়ির একাংশ স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল। নেয়ামত বিড়বিড় করে আওড়ায়- ‘হালার-ফো হালা, কাটবি না!’ 
পাশে দাঁড়ানো সফিক গাজী হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘ও নেয়ামত, গাছের গুঁড়িও কি তোর হালার-ফো হালা?’
‘অই হইলো! সবই তো হালার-ফো হালা।’ নেয়ামত গাছে দ্বিতীয় কোপ দিতে দিতে উত্তর দিলো। একটু থেমে গাছের গায়ে আলতো করে কোপ দিয়ে ডান হাতে কুড়ালটা ধরে ঘুরে তাকাল সফিকের দিকে। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, 
‘এই বাজারে ভালো মানুষ কেডা? যহন দরকার অয় মাথায় হাত বোলাইয়া নেয়ামতরে কামে লাগায়, আর নিজেগো কাম উদ্দার অইয়া গ্যালে সবাই ভুইল্যা যায়। তইলে কও ভালো মানুষ কেডা? সবই হালার-ফো হালা।’ 
ইসমাইল হাওলাদার হাতের ইশারায় সফিককে থামায়। কাছাকাছি এলে বলল, ‘থাউক, অরে ক্ষেপাইস না। কাম করতে দে।’  

কলমিলতা বাজারে নেয়ামতকে চেনে না এমন কেউ নেই। সত্তর বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের শিশু পর্যন্ত সবাই নেয়ামতকে চেনে। নদীর পাড় ধরে পাঁচ পাঁচটা স-মিলের সবগুলোতেই বড় বড় সব কাজে সবার ভরসা এই নেয়ামত। রোদে-পোড়া তামাটে বর্ণ গাঁয়ের রঙ, বয়স পয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী নেয়ামতের শরীরে অসুরের মতো শক্তি। জোরে হাঁক ছাড়লে বাজারের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় গমগম করে ওঠে তার কণ্ঠস্বর। বাজারের সবাই তাকে সমীহ করে। বিষয়টা সমীহ না বলে বলা যেতে পারে ভয় পায়। এর অবশ্য কারণও আছে। কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ না করে থাকতে পারে না নেয়ামত, সে যতবড় কেউকেটাই হোক না কেন। কারো মুখের উপর উচিত কথা বলতেও তার বুক কাঁপে না। এমন কি প্রয়োজনে অনেককে চড়-থাপ্পড়ও দিয়েছে, এমন নজির একেবারে কম নয়। তাই পারতপক্ষে কেউ তাকে ঘাটায় না।

কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না নেয়ামত। আর এ জন্যই তাকে সবাই পছন্দ করে। এই বাজারে যে সব শ্রমিক স-মিল কিংবা বিভিন্ন ভারী কাজ করে থাকে তাদের সবার থেকে নেয়ামত পারিশ্রমিক বেশি নেয়, তবুও সবার প্রথম পছন্দ এই নেয়ামতই। 
ইসমাইল হাওলাদারের স-মিলে বিশাল এক গাছের গুঁড়ি মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে সাইজমতো কেটে ফেলেছে সে। কাঠ চিরাতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল নেয়ামতের। বাড়ি থেকে তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে ছোট্ট সুমন। নানি প্লাস্টিকের কন্টেইনারে ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিয়েছে। একমাত্র নাতিকে দেখে মুখে হাসি ফুটল নেয়ামতের। 
‘মোর লইগ্যা ভাত লইয়া আইছো ভাই?’
‘হ। নানি তোমারে তরতরি খাইয়া ফালাইতে কইছে। নইলে নষ্ট অইয়া যাইবে।’   
‘নানা ভাই, তুমি খাইছ?’
‘হ।’ 
‘আর কিছু খাবা?’
‘হ। আমিত্তি খামু।’
‘আইচ্ছা। মুই ভাত কয়ডা খাইয়া লই, হেরপরে তোমারে আমিত্তি কিইন্যা দিমু আনে।’
সুমন ঘাড় কাত করে মিষ্টি করে হাসে। নেয়ামতের মন ভরে যায়। হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার মেয়ের কথা। নদীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী করমু ভাই, সবই আমাগো কপাল।’ 

নেয়ামতের দাদা হেকমত মোল্লা ছিল একজন ডাকসাইটে লোক। একসময় তারা সচ্ছল গৃহস্থ ছিল। বিস্তর জমিজমা ছিল, পুকুর-দিঘি ভর্তি মাছ, গোহালে গরু-গাভির কোনো কমতি ছিল না। তবে তার বাবার আমল থেকেই অবস্থা পড়তির দিকে। নদী ভাঙনে আজ তারা প্রায় নিঃস্ব। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত শেষ সম্বল একখন্ড জমিতে বসতি গেড়েছে নেয়ামত। তবে এসব নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। নিজের পরিশ্রমের বলে আজও বেশ ভালোভাবেই চলছে তার দিনকাল। বাবা গত হয়েছে বছর আটেক আগে, মা-তো আরও আগেই পাড়ি জমিয়েছে পরপারে। ভাইবোন বলতে এ সংসারে তার আর কেউ নেই।
নেয়ামতের সংসারে মাত্র তিনজন বাসিন্দা। সে নিজে, তার স্ত্রী আর ছয় বছরের নাতি সুমন। সুমন তার একমাত্র মেয়ে শরীফার ছেলে। 

আট বছর আগে শরীফার বিয়ে হয়েছিল পাশের গাঁয়ের রুস্তম জোয়ার্দারের একমাত্র ছেলে বশিরের সাথে। তখন শরীফার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। বশিরের বয়সও তেমন বেশি নয়, উনিশ। অনেকেই বাল্য বিবাহ বলে আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু ছেলেপক্ষের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহের মুখে সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল শরীফা আর বশিরের। 

সুখেই কাটছিল ওদের দিন। তবে বছরখানেক আগে নেয়ামতের আকাশে সূচনা হয়েছিল দুর্ভাগ্যজনক এক ঝড়ের। বিয়ের প্রায় দু’বছরের মাথায় সবার যেদিন আনন্দে ভাসবার কথা ছিল, ঠিক সেদিনই নেয়ামত ও তার স্ত্রী মদিনার জীবনে নেমে এলো ঘোর অমানিশা। শরীফা-বশিরের ঘর আলো করে এক ছেলে শিশুর জন্ম হলো ঠিকই, তবে সে শিশুর চাঁদমুখ দেখার সৌভাগ্য হলো না শরীফার। ছেলেকে জন্ম দিয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওপারে পাড়ি জমালো সে। কারো তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, কেবল নেয়ামত আর তার স্ত্রী একমাত্র সন্তান হারিয়ে আজ আবার নিঃস্ব। রুস্তম জোয়ার্দার তার ছেলেকে আবার বিয়ে দিয়েছে, তবে শরীফার ছেলে সুমনের আর স্থান হয়নি সে বাড়িতে। 

শরীফা আজ বেঁচে নেই। মেয়ের জ্বলজ্বলে স্মৃতির আতিশয্যে আজও হালভাঙা নাবিকের মতো অবস্থা নেয়ামতের। বেঁচে আছে মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন- তার একমাত্র ছেলে সুমন। তাইতো নেয়ামতের কাছে সুমন এক বড় আমানত। দুই চোখের মণি। নেয়ামত প্রায় সময়ই নাতিকে কাঁধে করে বাজারে নিয়ে আসে। নাতির পছন্দের মিষ্টি, জিলাপি খাওয়ায়। স্কুল না থাকলে সারাদিন সে তার নানার আশেপাশেই থাকে আবার কাজ শেষে নানার সাথে বাড়ি ফিরে যায়। 

এভাবেই নাতিকে পেয়ে মেয়ের শোক কিছুটা হলেও ভুলে থাকে নেয়ামত। ভালোই কেটে যাচ্ছিল তার দিন। নাতি সুমন মাঝে মধ্যে একা একাই কলমিলতা বাজারে আসে, নানার আশেপাশেই থাকে। এই বাজারে এখন মোটামুটি সবাই সুমনকে চেনে। 

নানা-নানি কেউ চোখের আড়াল করে না সুমনকে। তবুও মাঝে মাঝে খেলাচ্ছলে সুমন এদিক ওদিক চলে যায়। নানিও ঘরেরর নানান কাজে ব্যস্ত থাকে, তাই কখনও কখনও একটু এদিক সেদিক হয়ে যায়। এমনি করে একদিন ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। বাগানের পাশে খেলতে গেলে সাপে কামড়ে দিল সুমনকে। হৈচৈ পড়ে গেল চারিদিকে। বাজারে নেয়ামতের কাছে খবর গেলে ঝড়ের বেগে ছুটে আসলো সে। ওঝা এনে ঝাড়ফুঁক, কত কী করা হলো! সুমন ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছিল। প্রমাদ গুনল নেয়ামত। তবে কি চিরতরে হারিয়ে যাবে তার একমাত্র মেয়ের আমানত? কেউ কেউ বলল হাসপাতালে নিয়ে যাও। আর দেরি করল না নেয়ামত। সদরে হাসপাতালে নিয়ে গেল নাতিকে। অবশেষে দু’দিন পরে সুস্থ হয়ে ফিরল সুমন। নেয়ামত হাফ ছেড়ে বাঁচল।  

কলাবতী বাজারটি বহু পুরনো। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী ইরাবতী। একসময় এই নদীটি বেশ বড় আর খরস্রোতা ছিল। এখন পলি জমে জমে ছোট হয়ে গেছে অনেকটাই। আগে বড় বড় কার্গো জাহাজ ভিড়ত এই ঘাটে, তবে এখন আর তেমনটি নেই। স-মিলগুলো সব নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে। দূর-দূরান্ত থেকে এই নদীপথে বিভিন্ন সাইজের গাছ স-মিলে এনে রাখা হয়। গাছগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সাইজের কাঠ তৈরি করার কাজে একমাত্র ভরসা এই নেয়ামতের মতো শ্রমিকরা। এখানে নেয়ামতের সাথে কাজ করে বজলু, রফিক, কাঞ্চন, সমীর ও হাসেম। এদের সবার নেতা হচ্ছে- নেয়ামত।    
সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেটুকু আয় হয় তাতেই খুশি নেয়ামত। অনেক বেশি চাহিদা তার নেই। যত খাটুনিই হোক, দু’বেলা পেটপুরে খাওয়া আর শান্তির একটা ঘুম- এতেই তৃপ্ত সে। 

গাছের গুঁড়িতে পরবর্তী কোপটা দিতে যাবে এমন সময় নেয়ামতের চোখে পড়ল পাশের বাড়ির মতলু মাঝির ছেলে শাহীন চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘নেয়ামত কাকা, সুমনরে হরি ঘোষ মারছে।’
‘কী কইলি!’
কুড়ালটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নেয়ামত। তারপর এক লাফে স-মিলের এরিয়া পেরিয়ে হরেন ঘোষের মিষ্টির দোকানের দিকে ছুট লাগাল। মুখ দিয়ে অনবরত বুলি ছুটছে- ‘ওরে হালার-ফো হালা, তুই আমার নাতির গায়ে হাত দিছোস, তোর ঐ হাত আইজ আমি ভাঙমু।’
ইসমাইল হাওলাদার প্রমাদ গুনল। সে সফিক গাজীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি ল, এহনই আরম্ভ অইয়া যাইবে নেয়ামতের কেয়ামত। অরে সামাল দেবে কেডা?’
‘এই হরির বড় বাড় বাড়ছে। প্রায়ই যার-তার লগে খারাপ ব্যবহার হরে। ও কি জানে না নাতিটা নেয়ামতের জানের টুকরা।’ ইসমাইলের সাথে ছুটতে ছুটতেই বলে উঠল সফিক।
‘আরে তাড়াতাড়ি পা চালা। এতক্ষণে হরির হাত-পা আস্ত থাকলে অয়।’
‘নেয়ামতের হাতে কয়েক ঘা খাইলেই অর শিক্ষা অইবে।’ সফিক গাজী ক্ষোভ ঝাড়ল।
‘আরে বলদ, বোঝো না ক্যা নেয়ামতের এক ঘা নেয়ার ক্ষমতা আছে অর? বেতইন গাছের লাহান শরিল।’ রাগত স্বরে বলল ইসমাইল।
‘ঐ যে দ্যাহো মানুষ গিজগিজ করতেছে, কী যে ঘটছে আল্লাহই জানে।’ হরেনের দোকানের কাছাকাছি গিয়ে বলল সফিক।

সফিকের কথা শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে প্রায় চমকে উঠল ইসমাইল। হরেন ঘোষের দোকানের সামনে বড় ধরণের একটা জটলা। ভেতরে কী ঘটছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। জোর পা চালিয়ে দু’জনে ঘটনাস্থলে পৌঁছাল। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখ আরেকবার কপালে উঠল ইসমাইল হাওলাদারের। হরেন ঘোষের দোকানের সামনেটা যেন একটা ধ্বংসস্তূপ। চুলা থেকে মিষ্টি রান্নার কড়াই মাটিতে কাত হয়ে পড়ে আছে, সেইসাথে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মিষ্টি, সন্দেশ, জিলাপি, আমিত্তি; আর মিষ্টি রাখার সেলফটা উপুর হয়ে পড়ে আছে। হরেন ঘোষকে কোথাও দেখা গেল না। নেয়ামত ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে পাশের ডিসপেনসারির দিকে ছুটছে।

ডিসপেনসারির এক কোণে ছোট্ট একটা টুলের উপর চুপ করে বসে আছে সুমন। তার হাতের ছড়ে যাওয়া ক্ষতটায় স্যাভলন মাখানো তুলা দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে কম্পাউন্ডার সত্যেন।
নাতির কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে নেয়ামত বলল, ‘তোমার কী অইছে নানা ভাই?’ 
সুমন কিছু বলার আগেই সত্যেন বলল, ‘তেমন কিছু অয় নাই। একটু চামড়া ছিল্লা গ্যাছে। মুই পরিষ্কার কইরা ওষুদ দিয়া দিমুনে। চিন্তা কইরো না দাদা।’
সত্যেনের কথায় কিছুটা সান্ত¡না পেলেও নেয়ামত নাতিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কোনোহানে ব্যতা পাও নাই তো?’ 
সুমন ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ‘না।’
নেয়ামত হাফ ছেড়ে বাঁচল। চুপচাপ কিছুক্ষণ নাতিকে সত্যেনের পরিচর্যা করা দেখছে আর বারবার ঘুরে হরেনের চায়ের দোকানের দিকে তাকাচ্ছে। ইসমাইল হাওলাদার হাত নেড়ে লোকজনকে কী যেন বলছে। হরেনের দোকানের ছেলেটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দু’হাত কচলাচ্ছে। নেয়ামত বুঝল হরেন এখনও পলাতক। মনে মনে আওড়াল, ‘হালার-ফো হালা, তোমারে একবার হাতের দারে পাইয়া লই, আমার নাতির গায় হাত দেওয়ার মজা বুজাইয়া দিমু।’

সত্যেনের কাজ শেষে নেয়ামত দেখল সুমনের কনুইতে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে খুব সুন্দরভাবে বেঁধে দিয়েছে সে। সুমনের মুখে হাসি দেখে চেহারায় রাগী ভাব কিছুটা কমে গিয়ে নেয়ামতের মুখেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সত্যনের দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কত অইছে সত্য?’
‘লাগবে না দাদা। এইডু কামের লইগ্যা তোমার দারে টাহা নিমু!’
‘আ! অ কও কী! তোমার খরচ অইছে না?’
‘অউক, তুমি সুমনরে লইয়া বাড়ি যাও। সপ্তাহখানেক পরে নিয়া আইও, মুই আবার ওষুদ লাগাইয়া দিমুনে।’
নেয়ামত হাসিমুখে বলল, ‘ঠিক আছে সত্য, তোমারে একদিন মুই মিষ্টি খাওয়ামু।’
সত্যেন মৃদু হাসল। ‘আচ্ছা দাদা, খাওয়াইও।’
হরেনের দোকানের লোকজন সব পালিয়েছে। কেবলমাত্র বছর বারো বয়সী একটি ছেলে মাটিতে পড়ে যাওয়া মিষ্টি ও অন্যান্য খাবারগুলো তুলে জায়গাটা পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। ইসমাইল হাওলাদার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,
‘অ্যাঁই, হরি কই?’ 
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাপড়ের দোকানদার ফারুক আকন্দ উত্তর দিলো, ‘নেয়ামত আইতেছে হুইন্যাই পলাইছে।’
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘হালার-ফো হালায় কোন দিগে গ্যাছে রে?’
ফারুক আকন্দ উত্তর দিল, ‘পেছনের দরজা দিয়া নাইম্যা ধান খ্যাতের মধ্যে দিয়া পলাইছে।’
ততক্ষণে সুমনকে নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে নেয়ামত। ফারুকের কথার পিঠে সে বলে উঠল, 
‘হালার-ফো হালা পলাইছে। যাবি আর কই, তোরে হাতের দারে পাইয়া লই। কেনু যে একখান দিমু! সোজা অইয়া খাড়াইতে তিন মাস লাগবে তোর।’

ইসমাইল হাওলাদার নেয়ামতের কাঁধে হাত রাখল। সুমনের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা হরির বিচার পরে করমু আনে। তুই এহন সুমনরে নিয়া বাড়ি যা। আইজ আর কাম করন লাগবে না।’
পরপর দু’দিন বাজারে দেখা মেলেনি হরেন ঘোষের। কর্মচারীরা নিজেদের মতো করে দোকান সামলিয়েছে। লোকজন দিয়ে দিনে কয়েকবার খবর নিয়েছে নেয়ামত। এখনও রাগে ফুঁসছে সে। মনে মনে কেবল আওড়ায়- ‘অরে কয়েক ঘা না দেয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাইতেছি না।’
সফিক গাজী সান্ত¡না দেয়। ‘থাউক, আর কিছু কইস না। যেই ডরান ডরাইছে, জীবনেও ও আর তোর নাতিরে কিছু কইবে না।’
‘হালার-ফো হালারে মোর দারে মাফ চাইতে অইবে, নাইলে অরে ছাড়মু না।’
কয়েকদিন দিন পর এক দুপুরে- স-মিলে একমনে কাজ করছে নেয়ামত। নিঃশব্দ পায়ে ভয়ে ভয়ে ইসমাইল হাওলাদারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল হরেন। নিচু স্বরে ইসমাইলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘দাদা গো, তুমি একটু নেয়ামতরে বুজাও না! এক সপ্তাহ দইরা মোর ব্যবসাডা লাডে ওডার দশা।’
ইসমাইল হাওলাদার কপট ধমকের সুরে নিচু স্বরে বলল, ‘এমন একটা কাম করনের আগে মনে আছিলো না? তুই নেয়ামতরে চিনোস না?’   
‘মুই খেয়াল করতে পারি নাই যে পোলাডা নেয়ামতের নাতি। হেইলে কি আর এমন করতাম!’ 
 ‘নেয়ামতের নাতি অউক আর যে-ই অউক, এত ছোড পোলাপানের গায়ে কেউ হাত তোলে! তুই তো চামারের মতোন কাম করছোস।’ ভর্ৎসনার সুরে বলল ইসমাইল হাওলাদার।   
আবার কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেল হরেন। সামনে তাকিয়ে দেখল নেয়ামত সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ইসমাইল হাওলাদারের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, 
‘দাদা, তুমি একটু নেয়ামতরে সামলাও। মুই দরকার অইলে অর পাও দইরা মাফ চামু।’
হঠাৎ নেয়ামতের দিকে চোখ পড়ল ইসমাইল হাওলাদারের। রাগত ভঙ্গিতে হরেনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ইশারায় নেয়ামতকে কাছে ডাকল সে। নেয়ামত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হরেনের দিকে। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ ইসমাইল হাওলাদারের ডাক উপেক্ষা করল না সে। কাছে এগিয়ে আসতেই হরেন দৌড়ে গিয়ে নেয়ামতের পা জড়িয়ে ধরল।
‘দাদা গো, ভুল অইয়া গ্যাছে। মুই খেয়াল করি নাই পোলাডা তোমার নাতি আছিলো। জীবনে আর কোনোদিন এমন কাম করমু না।’
ইসমাইল হাওলাদার ইশারায় নেয়ামতকে চুপ থাকতে বলল। তারপর হরেনের উদ্দেশ্যে বলল, 
‘হরি, এরপর যদি তোর নামে কোনোদিন হুনি যে তুই কারো লগে খারাপ ব্যবহার করছোস, তইলে তোর খবর আছে। মনে রাখিস। খালি মোর কথা হুইনা আইজ নেয়ামত তোরে ছাইড়া দিলো। সাবধান।’
‘হ দাদা। কতা দিলাম, আর কোনোদিন এমন কাম করমু না।’ 
নেয়ামত পা সরিয়ে নিলো। ‘দাদা, এহন থেইক্যা তোমার নাতির লইগ্যা মোর দোহান ফ্রি। ওর যহন যা খুশি খাইবে, পয়সা লাগবে না।’ ভয়ে ভয়ে নেয়ামতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল হরেন।
‘সর হালার-ফো হালা। মুই কি খয়রাতি? মোর নাতির ফ্রি খাওন লাগবে ক্যা? পয়সা দিয়াই খাইবে, তয় তোর দোহানে না। বাজারে তুই ছাড়া ভালো মিষ্টি কেউ কি ব্যাচে না?’ নেয়ামত পাল্টা ধমকের সুরে বলল। 

হরেন আর কথা বাড়াল না। ধীরে ধীরে তার দোকানের দিকে পা বাড়াল।
সুমনের ছড়ে যাওয়া কনুই এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। হালকা একটা দাগ রয়ে গেছে শুধু। চিন্তিত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে নেয়ামত। ব্যাপারটা খেয়াল করে সত্যেন বলল, 
‘দাদা, চিন্তা কইরো না, কয়েকদিন গ্যালে এই দাগ আর থাকপে না। এই যে মুই শেষ ওষুদ লাগাইয়া দিলাম। আর ওষুদ লাগবে না।’
নেয়ামতের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। ‘সত্য, লও আইজ তোমারে মুই মিষ্টি খাওয়ামু। না হরতে পারবা না। তয় এই হারামি হরির দোহানে না। জয়নালের দোহান থেইক্যা খাওয়ামু।’
সত্যেন হাসিমুখে বলল, ‘আইচ্ছা লও। তুমি শান্তি পাইলে যেইহান থেইক্যা খাওয়াইবা, হেইহানেই খামু।’
তিনজনে জয়নালের মিষ্টির দোকানের দিকে হেঁটে যায়। সুমন নানার কানে কানে বলল, ‘নানা, মুইও একটা মিষ্টি খামু।’
হো হো করে হেসে উঠল নেয়ামত। ‘তুমি তো খাবাই। হেই লগে মুইও খামু। মোরা তিনজনেই খামু।’
নেয়ামতের কাঁধে চড়ে বাড়ির পথে যাচ্ছে সুমন। তার কাছে পরম নির্ভরতার একটা স্থান নানার এই কাঁধ। নেয়ামত একমাত্র নাতি সুমনকে এভাবেই আগলে রাখে। প্রতিজ্ঞা করে- সৃষ্টিকর্তা তাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখবে, তার মেয়ের রেখে যাওয়া একমাত্র আমানতকে যেভাবেই হোক রক্ষা করবে সে।

পল্লবী, ঢাকা 

আরও পড়ুন: ঝড় ও জলের জীবন