Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বসাহিত্যে অপূরণীয় ক্ষতি

মারা গেলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ইয়োসা

মারা গেলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ইয়োসা
নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা আর নেই। ৮৯ বছর বয়সে রোববার (১৩ এপ্রিল) পেরুর রাজধানী লিমায় পরিবার-পরিজনের মাঝে শান্তিপূর্ণভাবে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

তার মৃত্যুতে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক ‘বুম’ আন্দোলনের শেষ প্রধান নক্ষত্রটি নিভে গেলো, যিনি তার অসাধারণ উপন্যাস ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পাঠক ও সমালোচকদের মন জয় করেছিলেন।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর বরাতে জানা যায়, রোববার ইয়োসার ছেলে আলভারো বার্গাস ইয়োসা সোশ্যাল মিডিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, গভীর শোকের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার বাবা মারিও বার্গাস ইয়োসা আজ লিমায় মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিদায় নিয়েছেন। তার তিন সন্তান—আলভারো, গনজালো ও মোরগানা—এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, তার প্রিয়জন, বন্ধু ও পাঠকরা জেনে সান্ত্বনা পাবেন যে, তিনি দীর্ঘ, ঘটনাবহুল ও ফলপ্রসূ জীবন যাপন করেছেন এবং তার রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্ম তাকে চিরজীবী করে রাখবে।

১৯৩৬ সালের ২৮ মার্চ পেরুর দক্ষিণাঞ্চলের আরেকিপা শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন ইয়োসা। শৈশবের একটি অংশ তিনি বলিভিয়ার কোচাবাম্বায় কাটান, যেখানে তার দাদা পেরুর কনসাল ছিলেন। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর দশ বছর বয়সে পেরুতে ফিরে তিনি লিমার একটি সামরিক স্কুলে ভর্তি হন, যা পরবর্তীতে তার প্রথম উপন্যাসের প্রেরণা হয়ে ওঠে। লিমার স্যান মার্কোস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার পর তিনি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন এবং প্যারিসে বসবাস শুরু করেন, যেখানে তার সাহিত্যিক জীবন পূর্ণতা পায়।

ইয়োসার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালে ‘লা গাইড দেল ইনকা’ নামে একটি নাটক দিয়ে। তবে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘লা সিউদাদ ই লস পেররোস’ (ইংরেজিতে ‘দ্য টাইম অব দ্য হিরো’) তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। এ উপন্যাসটি তার সামরিক স্কুলের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, যা পেরুর সামাজিক ও জাতিগত বিভেদকে তুলে ধরে। এরপর তিনি ‘কনভারসেশন ইন দ্য ক্যাথেড্রাল’ (১৯৬৯), ‘আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার’ (১৯৭৭), ‘দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯৮১), ‘দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট’ (২০০০) এবং ‘ডেথ ইন দ্য অ্যান্ডিস’ (১৯৯৩)-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। তার ‘আন্ট জুলিয়া’ অবলম্বনে ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় ‘টিউন ইন টুমরো’ চলচ্চিত্র, যেখানে অভিনয় করেন কিয়ানু রিভস ও বারবারা হারশি।

ইয়োসার লেখনী কেবল গল্প বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না; তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক অবিচার, এবং ব্যক্তির প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের গল্পকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তার উপন্যাসগুলো পেরুর সামরিক শাসন, শাইনিং পাথ গেরিলা আন্দোলন, এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোর শাসনের মতো জটিল বিষয়গুলোকে তুলে ধরে। ২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানকালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তার ‘ক্ষমতার কাঠামোর ভূ-সংনির্মাণ এবং ব্যক্তির প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও পরাজয়ের তীক্ষ্ণ চিত্রায়নের’ জন্য প্রশংসা করে। তিনি ফরাসি সাহিত্যিক গুস্তাভে ফ্লবার্তকে তার প্রধান প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

সাহিত্যের পাশাপাশি ইয়োসা রাজনীতি ও সমাজচিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একসময় কিউবার বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু পরে ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনের সমালোচক হন, যা তার বন্ধু ও সহকর্মী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে বিখ্যাত বিরোধের জন্ম দেয়। ১৯৭৬ সালে মেক্সিকো সিটির একটি সিনেমা হলের বাইরে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা সাহিত্যজগতে কিংবদন্তি হয়ে আছে। ১৯৯০ সালে তিনি পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন, কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে আলবের্তো ফুজিমোরির কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনের সময় তিনি মৃত্যুর হুমকি ও প্রচারকর্মীদের হত্যার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। পরাজয়ের পর তিনি স্পেনে চলে যান এবং ১৯৯৩ সালে স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি স্প্যানিশ সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান সেরভান্তেস পুরস্কার লাভ করেন।

ইয়োসার লেখনী উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। তিনি প্রবন্ধ, নাটক, সাংবাদিকতা, এবং সমালোচনার মাধ্যমেও বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি স্পেনের ‘এল পাইস’ পত্রিকায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলাম লিখেছেন। ২০২২ সালে তিনি তার প্রথম শিশুতোষ বই ‘ফনচিতো অ্যান্ড দ্য মুন’ প্রকাশ করেন এবং পেরুভিয়ান জনপ্রিয় সংগীত নিয়ে একটি উপন্যাসের কাজ করছিলেন বলে জানান। ২০২৩ সালে তিনি ফরাসি অ্যাকাডেমি ফ্রঁসেজে প্রথম সদস্য হিসেবে যোগ দেন, যিনি কখনো ফরাসি ভাষায় বই লেখেননি।

ইয়োসার মৃত্যুতে পেরুর প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বজুড়ে সাহিত্যমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। পেরুর প্রেসিডেন্ট কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলে, তার সাহিত্যকর্ম আমাদের জাতীয় গর্ব, যা পৃথিবীজুড়ে পেরুকে পরিচিত করেছে। তার সন্তানরা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, বাবার পাঠকরা তার দীর্ঘ, ঘটনাবহুল ও সৃষ্টিশীল জীবন ও সাহিত্যকর্মের জন্য গর্বিত হবেন। তার রেখে যাওয়া সাহিত্যসম্ভারই তাকে অমর করে রাখবে।

ঢাকার শোভাযাত্রায় ‘ফ্যাসিবাদের অবসান’র বার্তা যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকে প্রতিফলিত করছিল, তখন ইয়োসার মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তার সাহিত্যও ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানুষের প্রতিরোধের গল্প বলেছে। তার উপন্যাসগুলো, যেমন ‘দ্য ফিস্ট অব দ্য গোট’, স্বৈরশাসনের নিষ্ঠুরতা ও মানুষের সংগ্রামকে তুলে ধরে, যা বাংলাদেশের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম সংযোগ স্থাপন করে। উভয়ই স্বাধীনতা, ন্যায় ও সৃজনশীলতার পক্ষে দাঁড়ায়।

মারিও বার্গাস ইয়োসার বিদায় বিশ্বসাহিত্যের জন্য একটি যুগের অবসান। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্ম—যা ক্ষমতা, প্রতিরোধ ও মানবিকতার গল্প বলে—তাকে চিরকাল জীবন্ত রাখবে। ঢাকার নববর্ষের উৎসব যেমন বাঙালির ঐক্য ও আশার প্রতীক, তেমনি ইয়োসার লেখনী বিশ্বজুড়ে পাঠকদের জন্য একটি চিরন্তন প্রেরণা হয়ে থাকবে।

সবার দেশ/এমকেজে